নিজস্ব প্রতিবেদক
সরকার আনন্দময় পরিবেশে শিক্ষা গ্রহণ ও হোমওয়ার্ক কমিয়ে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বাড়ানোর পাশাপাশি বিষয়বস্তু ও পাঠ্যসূচি সহজ করতে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের সংস্কার আনতে যাচ্ছে।
নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষাই থাকছে না। প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক সমাপনী পরীক্ষাও বাতিল হচ্ছে। দশম শ্রেণি শেষে হবে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা। একইসঙ্গে মাধ্যমিক পর্যায়ে আর থাকছে না বিভাগ বিভাজন। অর্থাৎ নবম-দশম শ্রেণিতে সমন্বিত পাঠ্যক্রমে পড়ালেখা করবে শিক্ষার্থীরা।
সোমবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মলনে পরিবর্তিত এই শিক্ষাক্রম তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি জানান, জাতীয় শিক্ষাক্রমের এই রূপরেখায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুমোদন দিয়েছেন। এরপরই শিক্ষাক্রমের রূপরেখার বিস্তারিত তুলে ধরে ব্রিফিং করেন শিক্ষামন্ত্রী।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বার্ষিক কোনো পরীক্ষাও থাকছে না। একইসঙ্গে পঞ্চম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি ও ইবতেদায়ি) এবং অষ্টম শ্রেণি শেষে জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষা থাকছে না। এই সিদ্ধান্তের ফলে দশম শ্রেণি শেষ করে প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে শিক্ষার্থীদের। তবে এখন নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর মাধ্যমিক পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষা তথা এসএসসি, দাখিল ও সমমানের পরীক্ষা হয়ে থাকে। নতুন শিক্ষাক্রমে এ ক্ষেত্রেও থাকছে ভিন্নতা। কেননা, নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচি হবে আলাদা। দশম শ্রেণি শেষে পাবলিক পরীক্ষাটি হবে কেবল দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর ভিত্তি করেই।
এদিকে, মাধ্যমিক তথা নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচিতেও আসছে বড় ধরনের পরিবর্তন। বর্তমানে নবম শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান, মানবিক বা বাণিজ্য বিভাগের কোনো একটি বেছে নিতে হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে এসব বিভাগ তুলে দেওয়া হচ্ছে। আলাদা আলাদা বিভাগের বদলে এই পর্যায়েও থাকবে একটি সমন্বিত পাঠ্যক্রম।
ব্রিফিংয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, এ বছরেই পরিবর্তিত এই শিক্ষাক্রম পরীক্ষামূলকভাবে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু গত বছরের মার্চ মাস থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে কাজ করতে হয়েছে। ফলে এই শিক্ষাক্রমের রূপরেখার পরীক্ষামূলক বাস্তবায়নে আমরা যথাসময়ে যেতে পারিনি। এখন আমরা ২০২২ সালে এর পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু করব। এর জন্য প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণি বেছে নিয়েছি। ২০২৩ সালে শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হবে।
নতুন শিক্ষাক্রমের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে শিক্ষামন্ত্রী বলেন— পরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে শতভাগ। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞান— এ বিষয়গুলোতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ, বাকি ৪০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। অর্থাৎ কোনো বিষয়ে ১০০ নম্বর থাকলে পরীক্ষা দিতে হবে ৪০ নম্বরের, বাকি ৬০ নম্বর আসবে শিখনকালীন মূল্যায়ন থেকে। এর বাইরে শারীরিক, মানসিক, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা ও শিল্পকলায় মূল্যায়ন হবে শতভাগ।
ষষ্ঠ ও অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে শিখনকালীন মূল্যায়নও হবে ৬০ শতাংশ, আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে ৪০ শতাংশ। এর বাইরে জীবন জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, স্বাস্থ্য, সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতি মূল্যায়ন হবে শতভাগ। তবে নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে শিখনকালীন আর সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে অর্ধেক করে, অর্থাৎ ৫০ শতাংশ। বাকি বিষয়গুলোর শিখনকালীন মূল্যায়ন ১০০ শতাংশ।
এদিকে, একাদশ ও দ্বাদশে আবশ্যিক বিষয়গুলোতে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৩০ শতাংশ, বাকি ৭০ শতাংশ হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন। অর্থাৎ পাবলিক পরীক্ষায় গিয়ে ১০০ নম্বরের মধ্যে পরীক্ষা দিতে হবে ৭০ নম্বরের, বাকি ৩০ নম্বর আসবে শিখনকালীন মূল্যায়নের মধ্য দিয়ে। তবে প্রায়গিক বিষয় বা ঐচ্ছিক বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন থাকবে শতভাগ। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর প্রতি বছর শেষে একটি করে পরীক্ষা হবে। এই পরীক্ষার ফলাফলের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হবে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ২০২৩ সালে প্রাথমিকে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে যাবে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি, মাধ্যমিকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি। ২০২৪ সালে প্রাথমিকে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি আর মাধ্যমিকে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে শুরু হবে এই শিক্ষাক্রম। ২০২৫ সালে গিয়ে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন শুরু হবে। অর্থাৎ পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন হবে এই নতুন শিক্ষাক্রম।
পাবলিক পরীক্ষার বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, এখন থেকে শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষা হবে তিনটি। দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি শেষে এই তিনটি পাবলিক পরীক্ষায় বসতে হবে শিক্ষার্থীদের। এই তিন পরীক্ষার ফল মিলিয়ে প্রকাশ করা হবে এইচএসসির ফল।
নতুন এই শিক্ষাক্রমের উদ্দেশ্য জানিয়ে দীপু মনি বলেন, নতুন এই শিক্ষাক্রমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে অভিযোজনের জন্য জ্ঞান, দক্ষতা মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অর্জিত সক্ষমতাসম্পন্ন করে একজন শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলাই লক্ষ্য। আমরা চাই, মুখস্থ নির্ভরতার বদলে শিক্ষার্থীদের শিখন প্রক্রিয়া হোক আনন্দময়।
Discussion about this post