নিজস্ব প্রতিবেদক
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ওপর পড়ালেখার চাপ কমাতে এবং শিক্ষাকে আনন্দময় করতে নতুন জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুমোদন করেছে সরকার। আগামী বছর থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১০০টি করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষামূলক ভাবে এই শিক্ষাক্রম শুরু হবে। ২০২৩-২০২৫ সালের মধ্যে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন হবে নতুন শিক্ষাক্রম।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকবে না। নবম-দশম শ্রেণিতে থাকবে না বিভাগের বিভাজন। শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পরীক্ষা নিয়ে, সেসবের ভিত্তিতে দেওয়া হবে এইচএসসির ফল।
জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপরেখা আজ সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে উপস্থাপন করা হয়। তিনি তাঁর পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে রূপরেখাটি অনুমোদন করেছেন বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন শিক্ষাক্রমের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন তিনি।
শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী, নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করা হয়েছে। এর আগে সব শিক্ষাক্রমই প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য আলাদা আলাদা ছিল। এক স্তর থেকে আরেক স্তরে যাওয়াটা যেন মসৃণ হয় সে উদ্দেশ্যেই এই শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে।
নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষেই যেন অধিকাংশ পড়া শেষ করতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। হোমওয়ার্ক থাকবে খুব সীমিত।
নবম শ্রেণিতে আর বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থাকবে না। নবম ও দশম শ্রেণিতে বাধ্যতামূলকভাবে ১০টি করে বিষয় পড়তে হবে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টমে প্রি-ভকেশনাল কোর্স পড়বে শিক্ষার্থীরা। একাদশ শ্রেণিতে উঠে শিক্ষার্থীরা বিভাগ পছন্দ করে ঐচ্ছিক বিষয় বেছে নিতে পারবে।
বিভিন্ন স্তরে শিখন সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে। পরীক্ষা নিয়ে মূল্যায়নের পাশাপাশি ধারাবাহিক মূল্যায়নেও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কোন পর্যায়ে কতটা সামষ্টিক ও কতটা ধারাবাহিক মূল্যায়ন হবে তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
মূল্যায়ন পদ্ধতি
প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে কোনো পরীক্ষা না নিয়ে শিখনকালীন ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে। এরপর থেকে সব ক্লাসেই সমাপনী পরীক্ষা হবে। চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান এবং সামাজিক বিজ্ঞানে ৬০ ভাগ শিখনকালীন এবং ৪০ ভাগ সামষ্টিক মূল্যায়ন (পরীক্ষা নিয়ে) হবে। অন্য বিষয়ে হবে শুধু ধারাবাহিক মূল্যায়ন।
ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ে ৬০ ভাগ শিখনকালীন এবং ৪০ ভাগ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। ষষ্ঠ-সপ্তমের অন্য বিষয়গুলোতে শতভাগ মূল্যায়ন হবে শিখনকালীন। নবম-দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, সামাজিক বিজ্ঞানে ৫০ ভাগ শিখনকালীন ও ৫০ ভাগ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। এই দুই শ্রেণির অন্য বিষয়গুলোতে শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে।
আর দশম শ্রেণি শেষে শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির আলোকে পাবলিক পরীক্ষা (এসএসসি) নেওয়া হবে। যেখানে বর্তমানে নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর ভিত্তি করে পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হয়।
একাদশ ও দ্বাদশের আবশ্যিক বিষয়ে ৩০ ভাগ শিখনকালীন আর ৭০ ভাগ সামষ্টিক মূল্যায়ন হবে। একাদশ-দ্বাদশে প্রায়োগিক ও ঐচ্ছিক বিষয়ে শুধু শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর প্রতি বর্ষে একটি করে পরীক্ষা হবে। একাদশ ও দ্বাদশের ফলাফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারণ করা হবে।
নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পঞ্চম ও অষ্টমে শুধু ক্লাসপরীক্ষা হবে। অর্থাৎ পিইসি এবং জেএসসি পরীক্ষা থাকবে না। তবে প্রাথমিক শেষে একটা, অষ্টম শ্রেণি শেষে আরেকটা সনদ দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি। পাবলিক পরীক্ষা না নিয়ে স্কুলের পড়া শেষ করলে সার্বিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে সনদ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হতে পারে। অর্থাৎ প্রতিটি ক্লাসেই মূল্যায়ন হবে, এটির ভিত্তিতে একটা স্তর শেষ করার পর সনদ দেওয়ার চিন্তাভাবনা আছে।
নতুন শিক্ষাক্রমে সামষ্টিক মূল্যায়নের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক, ব্যবহারিক ও অন্যান্য উপায়েও শিখনকালীন মূল্যায়নের সুযোগ রাখা হয়েছে।
অন্যান্য দেশের পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে নতুন এই শিক্ষাক্রম করা হয়েছে। ফলে ফলাফল দেওয়া গ্রেডিং পদ্ধতিও ‘৫’-এর বদলে ‘৪’-এ নামিয়ে আনা হবে। শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। শিক্ষক গাইডও তৈরি করা হবে।
বাস্তবায়ন করা হবে যেভাবে
আগামী বছর (২০২২) থেকে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১০০টি করে প্রতিষ্ঠানের প্রথম ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পাইলটিং হিসেবে নতুন রূপরেখা বাস্তবায়ন করা হবে। ছয় মাস পাইলটিং শেষে ২০২৩ সাল থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হবে। ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণি এবং ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে এই শিক্ষাক্রম শুরু হবে। ২০২৫ সালের মধ্যে পুরো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করা হবে।
অবশ্য চলতি বছরই (২০২১) এই শিক্ষাক্রম পাইলটিংয়ে যাওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারির কারণে তা সম্ভব হয়নি।
Discussion about this post