শিক্ষার আলো ডেস্ক
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এন্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের তথ্য মতে, করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ সরকারি নির্দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হওয়ার আগে সারাদেশে ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন চালু ছিল। যেখানে পড়ালেখা করতো প্রায় ১ কোটির বেশি শিক্ষার্থী। আর শিক্ষক ও অন্যান্য স্টাফদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লাখ।
কিন্তু গত ১২ সেপ্টেম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর দেখা গেল প্রায় ২০ হাজার কিন্ডারগার্টেন তাদের শিক্ষাকার্যক্রম চালুই করতে পারেনি। অন্যদিকে ৪০ হাজার কিন্ডারগার্টেন কোনভাবে চালু হলেও শিক্ষার্থীর উপস্থিতি নেমে এসেছে ৪০ শতাংশে। যেখানে বন্ধের আগেও শিক্ষার্থীদের নূন্যতম উপস্থিতি ছিল ৯০ শতাংশ।
জানা যায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিংয়ের ৪ নম্বর সড়কের ফুলকুঁড়ি কিন্ডারগার্টেনটি এরই মধ্যে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করেছে। এই স্কুলের উদ্যোক্তা বিক্রির নোটিশ দিয়েও কোনো ক্রেতা পাননি। পরে তিনি স্কুলটি বন্ধ করে দেন। রাজধানীর মাটিকাটায় আইডিয়াল পাবলিক স্কুল, জুরাইনে নলেজ হ্যাভেন আইডিয়াল স্কুল, জুরাইন আইডিয়াল স্কুল, মিরপুরে আশার আলো বিদ্যানিকেতন, সাভারের বাইপাইলে সৃজন সেন্ট্রাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, রাজধানীর কালাচাঁদপুরে লন্ডন ইন্টারন্যাশনাল মডেল একাডেমিসহ অসংখ্য স্কুল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এসব কিন্ডারগার্টেন এই বছর আর খোলার পরিকল্পনা নেই।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এন্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার এ প্রসংগে বলেন, আমাদের হিসাব মতে সারাদেশে ২০ হাজার কিন্ডারগার্টেন পুনরায় চালু হতে পারেনি। এ বছর আর তাদের ক্লাসে ফেরা সম্ভব না। এর মধ্যে অর্ধেক প্রতিষ্ঠান আগামী বছর কোনমতে চালু হলেও হতে পারে। কিন্তু বাকী ১০ হাজার কিন্ডারগার্টেন আর কখনোই খুলবে না।
ইকবাল বাহার জানান, স্কুলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে অনেক শিক্ষার্থীর পরিবার শহর ছেড়ে গ্রামে চলে গেছে। পারিবারিক সমস্যার কারণে অনেক শিক্ষার্থী শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়েছে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের অনেকে বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। যার ফলে স্কুল খোলার পর আশঙ্কাজনকভাবে উপস্থিতি কমে গেছে।
অন্যদিকে দীর্ঘ সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষকদের অনেকেই অন্য পেশায় চলে গেছে। যার ফলে স্কুল চালু করা হলেও দেখা দিয়েছে শিক্ষক সংকট। এর সাথে যোগ হয়েছে দীর্ঘদিনের শিক্ষকদের বেতন, বকেয়া ঘর ভাড়া এবং অন্যান্য বিল।
ঢাকার পপুলার ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক আমেনা বেগম তামান্না বলছেন, স্বল্প সংখ্যাক শিক্ষক নিয়ে শুরু করলেও এখন স্কুলে শিশুদের ফিরিয়ে আনা বড় চ্যালেঞ্জ।আমার স্কুলের ৫০ থেকে ৬০ ভাগ স্টুডেন্ট বিভিন্ন কাজে নিজেদের নিয়োজিত করেছে। আমি নিজে ৩০টা পরিবারে গিয়েছি স্কুলে আসার জন্য তাদের অভিভাবকদের রাজি করাতে। কিন্তু তারা নিম্নবিত্ত পরিবারের। ফলে কাজ থেকে তারা আর স্কুলে ফিরবে না। এখন স্টুডেন্ট যদি না আসে তাহলে আমি স্কুল চালাবো কীভাবে!” বলেন মিস তামান্না।
চট্টগ্রামের ভিশন ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রধান শিক্ষক আমজাদ হোসেন বলেন, ২১জন শিক্ষক এবং সাড়ে চারশো শিক্ষার্থী নিয়েে আমাদের স্কুল চলছিল। তবে চরম প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে বাধ্য হতে হয়েছি স্কুলটি বন্ধ করে দিতে।
“গত বছর রোজার পর আমরা সরকারের নির্দেশ মতো অনলাইন ক্লাসের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কাছ থেকে কোন সাড়া পাইনি। ঘর ভাড়া, গ্যাস ও কারেন্ট বিল, শিক্ষক, কর্মচারীদের বেতন- এসব কুলিয়ে উঠতে না পাড়ার কারণে ২০২১ সালে এসে আমরা স্কুলটা বন্ধ করতে বাধ্য হলাম,” বলেন মি. হোসেন।
বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এন্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের সহ সভাপতি অধ্যাপক হাবিব রহমতউল্লাহ বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সবই ভাড়াবাড়িতে চলে। ওই ভাড়া এবং শিক্ষক বেতনের সংস্থান হয় টিউশন ফি থেকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করতে পারেননি। তাই শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা দেয়া দূরের কথা, বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য খরচ চালাতে পারছেন না। এ অবস্থায় অনেকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার অনেকে বিক্রির নোটিশ দিয়েছেন। দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিন্ডারগার্টেনের সাথে যুক্ত ১০ লাখ শিক্ষক ও স্টাফ অর্থ কষ্টের শিকার হয়েছে। অনেকেই বদলিয়েছেন পেশা। এখন নতুন করে প্রতিষ্ঠান খুললেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না শিক্ষক।
কিন্ডারগার্টেন সেক্টরের এই সংকট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে সরকারি প্রণোদণা চান সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু ক্ষতির শিকার বেসরকারি স্কুলগুলোর জন্য সরকারের কাছে ১০০ কোটি টাকা ঋণ সাহয্য চাইলেও তা পাওয়া যায়নি বলে জানান কিন্ডারগার্টেন মালিকরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এন্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার বলেন, সরকারের কাছে আবেদন জানাই, আমাদের প্রণোদনা দিয়ে কাজে ফেরার ব্যবস্থা করে দিন। শিক্ষকতা পেশাকে উৎসাহ দিন।
Discussion about this post