খন্দকার রেজাউল করিম
মহাবিশ্বের একটা অংশ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যে অংশটা অনুপস্থিত, ওটাই সবচেয়ে বড়। বিজ্ঞানীরা এত দিন শুধুই মহাবিশ্বের লেজ ধরে টানাটানি করেছেন, আসল মহাবিশ্বের দেখা মেলেনি এখনো। সেই অচেনা মহাবিশ্ব নাকি কালো পদার্থ (Dark matter) এবং কালো শক্তি (Dark energy) দিয়ে তৈরি! নামটা একেবারেই ঠিক হয়নি। কালোকে সহজেই চেনা যায়, মহাবিশ্বের অজানা অংশটা মোটেই কালো নয়। ও কালো নয়, ও আলো নয়, ও পদার্থ নয়, ওর পরিচয় দেওয়ার মতো শব্দ কোনো অভিধানে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ও কী তা কেউ জানে না! কোনো বস্তুর ওপর আলো এসে পড়লে তার কিছু অংশ প্রতিফলিত হয়, বাকিটা শোষিত হয়। যে বস্তু বেশির ভাগ আলো শোষণ করে এবং সামান্য কিছু প্রতিফলন করে তাকেই বলে কালো বস্তু। কিন্তু এই কালো পদার্থ আলোকে শোষণ করে না, প্রতিফলিত করে না। তাই একে কালো পদার্থ নয়, গুপ্ত পদার্থ বলা যেতে পারে।
তেমনি ডার্ক এনার্জিকে বলা যেতে পারে গুপ্ত শক্তি। তবে গুপ্ত পদার্থের আলো শোষণে যত অনীহাই থাক, মহাকর্ষের হাত থেকে কালো পদার্থের নিস্তার নেই। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বমতে, মহাকর্ষ আলোকে বাঁকিয়ে দেয়। মহাকর্ষ স্থানকালকেই বাঁকিয়ে দেয়, গুপ্ত পদার্থ আর সবার চোখে ধুলো দিলেও এই বাঁকা পথের ফাঁদ থেকে ওর রেহাই নেই!
মহাবিশ্বের যেটুকু আমরা চিনি তার ভেতরে যে আরেক অচেনা মহাবিশ্ব বিরাজ করছে, তার ইঙ্গিত প্রথম পাওয়া যায় ১৯৩৩ সালে। একটা হিসাব একেবারেই মিলছিল না। মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোর ভর এবং তাদের গতির হিসাব! সূর্য একটি নক্ষত্র, ১০ লাখ পৃথিবী সূর্যের পেটে সহজেই ঢুকে পড়তে পারে।
আমাদের গ্যালাক্সি আকাশগঙ্গায় (Milky Way) আছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি নক্ষত্র। আকাশগঙ্গার এপার থেকে ওপারে যেতে আলোর ১ লাখ ২০ হাজার বছর লাগে। সূর্য এবং এই ৩০ হাজার কোটি নক্ষত্র নিয়ে গড়া বিশাল ছায়াপথ প্রতি ২৫ কোটি বছরে নিজের কেন্দ্রের চারদিকে একবার পাক খায়। কতগুলো গ্রহ নিয়ে যেমন সৌরজগত্, কতগুলো গ্যালাক্সি নিয়ে তেমনই গ্যালাকটিক দল (Cluster)। ছায়াপথ যে দলের সদস্য তার নাম লোকাল গ্রুপ। এই দলে আছে ৪০টি গ্যালাক্সি।
পৃথিবী থেকে ৩২ কোটি আলোকবর্ষ দূরে আছে এক বিশাল গ্যালাকটিক দল, নাম কমা ক্লাস্টার। ওই দলে আছে প্রায় এক হাজার গ্যালাক্সি। মহাকর্ষের টান এই গ্যালাক্সিগুলোকে দলবদ্ধ করে রাখে। তবে একটি গ্যালাক্সির গতিবেগ বেশি হলে মহাকর্ষের টানকে উপেক্ষা করে ও দল ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারে!
পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশে দাঁড়িয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১১.২ কিলোমিটার বা তার চেয়ে বেশি বেগে একটি ঢিল ছুড়লে সেটা আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। একে বলে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের টান থেকে মুক্ত হওয়ার গতি বা মুক্তিবেগ (Escape velocity)। সূর্যের চারদিকে পৃথিবীর ঘোরার গতিবেগ এক সেকেন্ডে ৩০ কিলোমিটার। গতিবেগ ওর চেয়ে বেশি হলে পৃথিবী সূর্যের আকর্ষণ ছিঁড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়বে। তেমনি সূর্য আমাদের গ্যালাক্সি আকাশগঙ্গার কেন্দ্রের চারদিকে ঘুরছে সেকেন্ডে ২০০ কিলোমিটার বেগে।
সূর্যের ঘোরার বেগ ওর চেয়ে বেশি হলে সূর্য গ্যালাক্সি ছেড়ে পালিয়ে যাবে। গ্যালাকটিক দলের গ্যালাক্সিগুলোর গতিবেগ যদি একটি নির্দিষ্ট মাত্রার বেশি হয়ে যায়, তবে গ্যালাক্সিগুলোও দল ছেড়ে সরে পড়বে।
১৯৩৩ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফ্রিজ কমা ক্লাস্টার গ্যালাক্সিগুলোর গতিবেগ মেপে দেখেন, গ্যালাক্সিগুলো এত বেগে ছুটছে যে এদের দলবদ্ধ হয়ে থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই গ্যালাক্সিগুলোর ভেতরে এবং বাইরে নিশ্চয় অনেক অচেনা পদার্থ আছে, যাদের মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব গ্যালাক্সিগুলোকে দলবদ্ধ করে রেখেছে। ফ্রিজ এই না-দেখা পদার্থের নাম দেন ডার্ক ম্যাটার।
বস্তুর ঘোরাঘুরিকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে, কঠিন বস্তুর মতো ঘোরা (Rigid body rotation) এবং গ্রহের মতো ঘোরা (Planetary rotation)। একজন লাঠিয়াল লাঠি ঘোরাচ্ছে। তার হাত লাঠির যেখানে স্পর্শ করে আছে সেটা হলো ঘোরার কেন্দ্রবিন্দু। লাঠির কোন অংশ কেন্দ্রবিন্দু থেকে যতই দূরে হবে, তার গতিবেগ হবে ততই বেশি।
একে বলা হয় কঠিন বস্তুর মতো ঘোরা। গ্রহের মতো ঘোরার নিয়ম এর উল্টো! সূর্যের চারদিকে গ্রহগুলো ঘুরছে, যে গ্রহ সূর্য থেকে যত দূরে, তার গতিবেগ ততই কম। বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের গতিবেগ এক সেকেন্ডে যথাক্রমে ৪৭, ৩৫, ৩০, ২৪, ১৩, ১০, ৬, এবং ৫ কিলোমিটার। যে গ্রহ সূর্যের যত কাছে, তার ওপর সূর্যের মহাকর্ষ বল তত বেশি, তাই ওকে অবস্থান ধরে রাখার জন্য তত জোরে ঘুরতে হয়। এ ধরনের ঘোরাঘুরিকে বলে গ্রহের মতো ঘোরা।
আমাদের গ্যালাক্সি ছায়াপথের ঘোরাঘুরি কেমন হওয়া উচিত? কঠিন বস্তুর মতো, নাকি সৌরজগতের গ্রহের মতো?
গ্যালাক্সিকে কঠিন বস্তু বলে ভাবা সম্ভব নয়, এই বিশাল ছায়াপথের প্রায় সবটাই ফাঁকা। ছায়াপথের আয়তনের তুলনায় একটি নক্ষত্র প্রায় বিন্দুর মতো! সূর্যের ব্যাস পৃথিবীর চেয়ে ১০৮ গুণ বড়, পৃথিবীর তুলনায় সূর্যকে বেশ বড় মনে হতে পারে, কিন্তু ছায়াপথের তুলনায় সূর্য একটি কণার মতো ক্ষুদ্র। সূর্যের ব্যাস মাপতে আমরা কিলোমিটার ব্যবহার করি, ওদিকে দুটি নক্ষত্রের মাঝের দূরত্ব মাপা হয় আলোক বছরে। সূর্যের সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী, নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টরি, ৪ দশমিক ২৪ আলোক বছর দূরে।
তাই ছায়াপথের ঘোরাঘুরি সৌরজগতের মতো হওয়া উচিত, ছায়াপথের প্রতিটি নক্ষত্র ছায়াপথের কেন্দ্রের চারদিকে গ্রহের মতো ঘোরার কথা, যে নক্ষত্র কেন্দ্র থেকে যত দূরে তার গতিবেগ ততই কম হওয়া উচিত। কিন্তু তা একেবারেই হচ্ছে না। ছায়াপথের মাঝের খানিকটা অংশ কঠিন বস্তুর মতো ঘুরছে, গ্রহের মতো নয়, বাকি অংশটার ঘোরাঘুরি কারও মতোই নয়! এ ছাড়া আছে আরেক ঝামেলা। সর্পিল গ্যালাক্সিগুলো এত বেগে ঘুরছে যে গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলোর ছিটকে বেরিয়ে আসার কথা। কিন্তু এই গ্যালাক্সিগুলো কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে টিকে আছে। কেমন করে?
মহাবিশ্বে অনেক ধরনের গ্যালাক্সি আছে: সর্পিল (Spiral), লাঠি-সর্পিল (Barred spiral), ডিম্বাকার (Elliptical), অগোছালো (Irregular) ইত্যাদি। এদের অনেকের ঘোরাঘুরি মেপে দেখা গেছে, ওরা গ্রহের মতো ঘুরছে না! এটা একটা অবাক হওয়ার মতো ঘটনা। গলদটা কোথায়? পদার্থবিদদের সমীকরণে?
গ্যালাক্সির পদার্থের মাপামাপির হিসাবে? যে সমীকরণগুলো এত দিন নির্ভুল উত্তর দিয়ে এসেছে, যাদের ওপর ভরসা করে মানুষ চাঁদে গেছে, উড়োজাহাজ আকাশে উড়ছে, রেলগাড়ি-মোটরগাড়ি চলছে, শিশুদের দোলনা থেকে শুরু করে আকাশের গ্রহ-উপগ্রহের চলাফেরার সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হয়েছে, তা সব হঠাৎ করে ভুল হয় কী করে? মহাবিশ্ব যেসব মৌলিক কণা দিয়ে গঠিত, কোয়ার্ক ও লেপ্টন কণিকার দল, তাদের আচরণ আমাদের বেশ জানা।
এই চেনা কণিকাদের বাইরে অচেনা সব কণিকা মহাবিশ্বে বাস করে কি? তারাই হয়তো গ্যালাক্সিগুলোকে কঠিন বস্তুর মতো ঘোরাচ্ছে। ওদের খোঁজ মিলবে কী করে? সে জন্য মাটির নিচে বিজ্ঞানীরা ফাঁদ পেতে বসে আছেন ওদের ধরার আশায়, আকাশের কোনায় কোনায় টেলিস্কোপে চোখ রেখে প্রহর গুনছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওদের দেখা মেলেনি।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
Discussion about this post