মোহাম্মদ মাহবুবুল হক |
মুক্তিযুদ্ধের সূচনাতেই ২৬ মার্চ দুপুরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার বেতার ঘোষণা প্রচারের জন্য ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এর গোড়াপত্তন হয়। পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পরিচালিত সামরিক গণহত্যার খবর, বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এ বেতারকেন্দ্র থেকেই প্রচারিত হয়। এ বেতারকেন্দ্র থেকে সর্বশক্তি দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য আহ্বান জানানো হয়। গণহত্যা শুরুর আগে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বিদেশি সাংবাদিকদের বহিষ্কার এবং সংবাদ প্রচার ও প্রকাশের ওপর সামরিক আইনের কড়াকড়ির কারণে এ সময়ের আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমকে বাংলাদেশ বা পূর্ব পাকিস্তানের বিষয়গুলোর জন্য প্রধানত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিষয়ের ওপরই নির্ভর করতে হয়। পাকিস্তান সরকারের প্রচারণার বিরুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রচারযুদ্ধে নেমে মুক্তিযুদ্ধের ‘দ্বিতীয় ফ্রন্ট’ হিসেবে কাজ করে।
চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র আগ্রাবাদে অবস্থিত বেতার ভবন ও কালুরঘাট ট্রান্সমিটার—এ দুটির সমন্বয়ে গঠিত। আগ্রাবাদ বেতার ভবন থেকে অনুষ্ঠান টেলিফোন লাইন, এফএম ট্রান্সমিটার অথবা এক্সটিএলের মাধ্যমে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে পাঠানো হতো। কালুরঘাট ট্রান্সমিটার তা গ্রহণ করে ৩৪৪.৮ মিটার বা ৮৭০ কিলোহার্জে তা প্রচার করে। কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্রে একটি ছোট স্বয়ংসম্পূর্ণ ইমারজেন্সি স্টুডিও ছিল। চট্টগ্রাম বেতারের প্রচারক্ষমতা ছিল ১০ কিলোওয়াট, ইমার্জেন্সি স্টুডিও ব্যবহারের সময়ও ওই ১০ কিলোওয়াট ক্ষমতাই ব্যবহূত হতো। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারক্ষমতাও ছিল ১০ কিলোওয়াট। কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্রটির অবস্থান চান্দগাঁও এলাকায়, বর্তমানে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনালের উত্তর পাশে অবস্থিত।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিনতম সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। সেদিন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। সেই ইতিহাস সৃষ্টির দিনেও তিনি আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছিলেন চট্টগ্রামের ওপর এবং তার বিশ্বস্ত জহুর আহমদ চৌধুরীর ওপর।
২৬ মার্চ ১৯৭১, ইতোমধ্যে রাজধানীতে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে পাকিস্তানি হানাদারেরা। গ্রেফতার হবেন বা কিছু একটা ঘটবে, তিনি বুঝে গিয়েছিলেন। তাই স্বাধীনতা ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধু। স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন বটে, কিন্তু সেটা দেশবাসীকে জানানোর কোনো মাধ্যম ছিল না। একে একে সব সহকর্মীকে বিদায় দিয়েছেন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে তিনি একা। টেলিফোনে কাউকে জানাবেন, সে পথও বন্ধ। কারণ তার টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন। সেই সংকটময় মুহূর্তে তার মনে পড়েছিল দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধু ও বিশ্বস্ত সহচর জহুর আহমদ চৌধুরীর কথা। চট্টগ্রাম তার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। কোনোভাবে তার কাছে পাঠিয়ে দিতে পারলে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের ব্যবস্থা করবেন।
যেমনটি ভাবা, সেভাবেই কাজ করলেন… পরেরটা ইতিহাস। পাশের এক প্রতিবেশীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠালেন চট্টগ্রামের জহুর আহমদ চৌধুরীর কাছে। ওয়্যারলেসেও পাঠালেন। রাত ১২টা ৩০ মিনিটের দিকে ঢাকার পিলখানা থেকে ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর সেই বার্তা পান চট্টগ্রামের হালিশহরে তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের (ইপিআর) ৫ নম্বর সেক্টর সদর দফতরের সিগন্যালম্যান হিসেবে কর্মরত আবুল খায়ের।
ওই বার্তাতেই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা। ওপরে লেখা ছিল- ‘মেসেজ ফ্রম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’। নিচে লেখা- ‘দিস মেসেজ পাস টু বেঙ্গলি অফিসার’। বার্তাটি তিনি চট্টগ্রাম ইপিআরে দায়িত্বরত বাঙালি অ্যাডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের (পরবর্তীকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন) কাছে হস্তান্তর করেন। রফিকুল ইসলাম সেই রাতে সেক্টর সদর দফতরে ডিউটিতে ছিলেন। এই মেসেজের আলোকেই কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করা হয়।
এদিকে লোকমারফত পাওয়া বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাটি প্রচারের গুরুদায়িত্ব নেন জহুর আহমদ চৌধুরী। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নেতার দেয়া দায়িত্ব সেদিন তিনি যথাযথভাবে পালন করতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণার অজস্র কপি সাইক্লোস্টাইল মেশিনে ছাপিয়ে জনসাধারণের মাঝে বিলির ব্যবস্থা করেন। চট্টগ্রামের মানুষ মুহূর্তের মধ্যে জেনে যায়, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
ইংরেজিতে লেখা সেই ঘোষণা পত্রে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘This may be my last message, from today Bangladesh is Independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved’.
এর বাংলা অনুবাদ দাঁড়ায় এমন: ‘এটাই হয়ত আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য আমি তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।’ (সূত্র: অসমাপ্ত আত্মজীবনী)।
২৫ মার্চ মধ্যরাতের পর, অর্থাত্ ২৬ মার্চের প্রথমার্ধে স্বাধীনতার ঘোষণা পাওয়ার পর চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতারা, এমনকি স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাধারণ জনগণ তা হাতে লিখে, সাইক্লোস্টাইল করে, মাইকিং করে ব্যাপকভাবে প্রচার করে। ২৬ মার্চ সকালে আওয়ামী লীগ ও চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা আখতারুজ্জামান বাবুর বাসভবন ‘জুপিটার হাউস’-এ এক বৈঠকে মিলিত হন এবং স্বাধীনতার ঘোষণা চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেন। ডা. জাফর ঘোষণাটি বাংলায় মুসাবিদা করেন এবং কমিটি তা অনুমোদন করে। সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরীসহ চট্টগ্রামের এমএনএ/এমপিএদের মধ্যে যাঁরা চট্টগ্রাম শহরে আছেন, তাঁরা একত্রে বেতারকেন্দ্রে যাবেন এবং জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে প্রচার করবেন।
উল্লেখ্য, ২৬ মার্চ প্রভাতি অধিবেশনের জাতীয় অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে সামরিক আইনের ধারাসমূহ প্রচারিত হওয়া মাত্রই চট্টগ্রাম বেতারের কর্তব্যরত স্বাধিকার চেতনায় উদ্বুদ্ধ কর্মীরা তাত্ক্ষণিকভাবে আগ্রাবাদ বেতার ভবন ও কালুরঘাট সম্প্রচার ভবন ত্যাগ করেন।
২৬ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মোট ১৩টি অধিবেশন সম্প্রচার করে বলে জানা যায়। এর মধ্যে ২৬ মার্চের তিনটি ও ২৭ মার্চের প্রভাতি অধিবেশনের উদ্যোক্তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ ছিল না এবং তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ বেতারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্রের স্বয়ংসম্পূর্ণ স্টুডিও সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না। এ জন্য এ পর্যায়ের উদ্যোক্তারা বেতার চালু করার জন্য প্রথমে আগ্রাবাদ বেতার ভবনে যান। আগ্রাবাদ বেতার ভবন চট্টগ্রাম বন্দরের কাছাকাছি স্থানে অবস্থিত। চট্টগ্রাম বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক, সহকারী আঞ্চলিক পরিচালক, আঞ্চলিক প্রকৌশলীদের পরামর্শে চট্টগ্রাম বন্দরে অবস্থানরত পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজের শেলিং আওতা থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থিত কালুরঘাটের ইমার্জেন্সি স্টুডিও থেকে বেতার চালু করা হয়। পরবর্তী অধিবেশনগুলো এখান থেকেই প্রচারিত হয়।
২৬
মার্চের
প্রথম
অধিবেশন:
স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে প্রচারের লক্ষ্যে ১২টার পর আতাউর রহমান খান কায়সার, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, মীর্জা আবু মনসুর, ডা. এম এ মান্নান, এম এ হান্নান, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, রাখাল চন্দ্র বণিক প্রমুখ আগ্রাবাদ বেতার ভবন হয়ে কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্রে যান। অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ছাত্রনেতা রাখাল চন্দ্র বণিককে। বেলা দেড়টা-দুইটার দিকে রাখাল চন্দ্র বণিক বেতারে ঘোষণা করেন, ‘চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র। একটি বিশেষ ঘোষণা। একটু পরেই জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক জনাব এম এ হান্নান। আপনারা যাঁরা রেডিও খুলে বসে আছেন, তাঁরা রেডিও বন্ধ করবেন না।’ এ ঘোষণাটি রাখাল চন্দ্র বণিকের কণ্ঠে বারবার প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাসহ ডা. জাফরের মুসাবিদাকৃত ভাষণটি এম এ হান্নান প্রচার করেন। এ ভাষণটি ডা. মান্নানসহ আরও কয়েকজনের কণ্ঠে প্রচার করা হয়েছিল বলে জানা যায়। অনুষ্ঠান ঘোষণাসহ এ অধিবেশনের স্থায়িত্বকাল ছিল প্রায় ১৫ মিনিট। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এই প্রথম এ অধিবেশনে কারিগরি সহায়তা দিয়েছিলেন আঞ্চলিক প্রকৌশলী মীর্জা নাসির উদ্দিন, বেতার প্রকৌশলী আবদুস সোবহান, বেতার প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন এবং মেকানিক আবদুস শুকুর।
লক্ষণীয় যে ২৬ মার্চ সকালে সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত ছিল: জহুর আহমদ চৌধুরী স্বাধীনতার ঘোষণা বেতারে প্রচার করবেন; কিন্তু (কলামিস্ট) ইদরিস আলমের ভাষ্যমতে, জহুর আহমদ চৌধুরী একজন সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক স্বাধীনতার বেতার ঘোষণা প্রচারের ওপর জোর দেন। অতঃপর নেতারা প্রথমে ক্যাপ্টেন রফিকের (পরে মেজর ও মন্ত্রী) সঙ্গে যোগাযোগ করেন; কিন্তু তিনি রণাঙ্গন ছেড়ে শহরতলিতে অবস্থিত বেতারকেন্দ্রে যেতে রাজি হননি। এরপর মেজর জিয়ার (পরে লে. জেনারেল ও রাষ্ট্রপতি) সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
দ্বিতীয় অধিবেশন:
২৬ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম বেতারের পাণ্ডুলিপিকার বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁর বন্ধু ফটিকছড়ি কলেজের উপাধ্যক্ষ আবুল কাসেম সন্দীপ, বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক আবদুল্লাহ আল ফারুক সংগ্রাম পরিষদের আনুকূল্যে বেতার চালু করার উদ্দেশ্যে স্টেশন রোডে শহর আওয়ামী লীগের অফিস ও সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র ‘রেস্ট হাউসে’ যান। এখানে অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমদ তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁরা বেতারের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে দেখা করেন। অতঃপর বেতার চালু করার জন্য কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্র হয়ে আগ্রাবাদ বেতার ভবন হয়ে পুনরায় কালুরঘাটে গিয়ে বেতার চালু করেন। বেতার চালু করা পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন কাজী হোসনে আরা, ডা. আনোয়ার আলী, ওয়াপদার ইঞ্জিনিয়ার আসিকুল ইসলাম, ডা. সুলতান-উল-আলম, কবি আবদুস সালাম, ডা. আবু জাফর ও এম এ হান্নান।
২৬ মার্চ সন্ধ্যা সাতটা ৪০ মিনিটে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি’—এ বাক্য উচ্চারণের মাধ্যমে শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় অধিবেশন। কবি আবদুস সালাম কর্তৃক কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হয় মূল অধিবেশন। এরপর ডাক্তার আনোয়ার আলীর কাছ থেকে পাওয়া বঙ্গবন্ধুর নামাঙ্কিত ‘জরুরি ঘোষণা’ শীর্ষক স্বাধীনতার ঘোষণা-সম্পর্কিত প্রচারপত্রটি বিভিন্ন কণ্ঠে বারবার প্রচারিত হয়। বহির্বিশ্বের সাহায্য কামনায় ইংরেজিতে নিউজ বুলেটিনে কণ্ঠ দেন বেতারের প্রযোজক আবদুল্লাহ্ আল ফারুক। কবি আবদুস সালাম স্বাধীনতার পক্ষে ও পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলার সর্বস্তরের জনগণকে যার হাতে যা আছে তা নিয়ে প্রতিরোধযুদ্ধে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দেন। এ সময় এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পুনঃপ্রচার করেন। গণসংগীতের মাধ্যমে আধা ঘণ্টা স্থায়ী এ অধিবেশনের সমাপ্তি ঘটে। পরদিন সকাল সাতটায় আবার অনুষ্ঠান প্রচারের ঘোষণা দিয়ে অধিবেশনের সমাপ্তি ঘোষিত হয়। বেতারে কারিগরি সহায়তা দেন বেতার প্রকৌশলী মুসলিম খান, দেলোয়ার হোসেন, মোহাম্মদ মুছা ও মেকানিক আবদুস শুকুর।
তৃতীয়
অধিবেশন:
বেলাল মোহাম্মদের বন্ধু মাহমুদ হোসেন, বেতারের নিজস্ব শিল্পী রঙ্গলাল দেব চৌধুরী ও ঘোষক কবির, আগ্রাবাদ হোটেলের কর্মাধ্যক্ষ ফারুক চৌধুরী প্রমুখের উদ্যোগে রাত ১০টার দিকে তৃতীয়বারের মতো বেতার চালু হয়। এ অধিবেশন সম্পর্কে বিশেষ তথ্য পাওয়া যায় না। ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচার পায়।
২৭
মার্চের
প্রথম
অধিবেশন:
২৭ মার্চ সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ প্রতিরোধ কেন্দ্রের ছাত্রনেতারা বেতার চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। ছাত্রনেতাদের মধ্যে আলোচনাক্রমে মেডিকেল কলেজের মাহফুজুর রহমান, বেলায়েত হোসেন, আবু ইউসুফ চৌধুরী, শাহ-ই-জাহান চৌধুরী, পলিটেকনিক্যালের (ভিপি) আবদুল্লাহ আল হারুন, আজিজ, খুরশিদসহ অনেকে কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্রে যান। এ সময় ডা. এম এ মান্নান এমপিএ ও আবুল কাসেম সন্দীপ তাঁদের সঙ্গে যোগ দেন। বেতারকেন্দ্র চালু করে প্রথম ভাষণ দেন ডা এম এ মান্নান। এরপর সংবাদ পাঠ করেন শাহ-ই-জাহান চৌধুরী ও মাহফুজুর রহমান, ইংরেজি সংবাদ পাঠ করেন বেলায়েত হোসেন এবং মাহফুজুর রহমান সংবাদ বুলেটিন পড়েন। আবদুল্লাহ আল হারুন একটি ভাষণ দেন। সবশেষে ইউসুফ চৌধুরী একটি প্রতিবেদন পড়েন। এ অধিবেশনে দেশাত্মবোধক গানও প্রচার করা হয়। ঘণ্টা দু-তিনেক থাকার পর উদ্যোক্তারা শহরে যুদ্ধের অন্যান্য কাজে চলে যান। এ অধিবেশনে মেকানিক আবদুস শুকুরও উপস্থিত ছিলেন।
২৭
মার্চের
২য়
(সান্ধ্য)
অধিবেশন:
মেজর
জিয়ার প্রথম
ঘোষণা:
২৭ মার্চ সকালে সংগঠকদের মধ্যে বেলাল মোহাম্মদ তাঁর বন্ধু মাহমুদ হোসেন, কাজী হাবিব উদ্দীন, এয়ার মাহমুদ, ফারুক চৌধুরী, ওসমান গণিকে নিয়ে বেতারের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে বোয়ালখালীর ফুলতলীতে অবস্থানরত মেজর জিয়ার কাছে যান। মেজর জিয়া বেতারের নিরাপত্তার জন্য একটি সেনাদল পাঠান। বিকেল পাঁচটার মধ্যে সেনারা বেতারকেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে এলাকাটির নিরাপত্তা জোরদার করেন। সন্ধ্যার মধ্যে মেজর জিয়া বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে বেতারকেন্দ্রে উপস্থিত হন। এরপর মেজর জিয়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর প্রথম ঘোষণাটি দেন।
মেজর
জিয়ার
দ্বিতীয়
ঘোষণা:
২৮ মার্চ মেজর জিয়া নিজেকে ‘অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান’ দাবি করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর দ্বিতীয় ঘোষণাটি দেন।
মেজর
জিয়ার
তৃতীয়
ঘোষণা:
২৮ মার্চের অধিবেশনে মেজর জিয়া নিজেকে ‘Provisional head of the Swadhin Bangla
Liberation Government’ বলে ঘোষণা করলে রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সচেতন মহলে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধকে সেনা-অভ্যুত্থান হিসেবে প্রচার করার সুযোগ পেত। এ জন্য তাঁরা এটার সংশোধনী প্রচারে সক্রিয় হয়েছিলেন। পাকিস্তানের একসময়কার শিল্পমন্ত্রী ও বিশিষ্ট শিল্পপতি এ কে খান এবং চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতারা, বিশেষ করে জহুর আহমদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী, মীর্জা মনসুর, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, এম এ হান্নান প্রমুখ যৌথভাবে একটি ঘোষণা তৈরি করেন। ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ও মীর্জা মনসুর ২৯ মার্চ রাতে এ ঘোষণাটি নিয়ে মেজর জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। মেজর জিয়াসহ তাঁরা তিনজন বেতারকেন্দ্রে আসেন, কিন্তু তখন সেখানে বেতারের কর্মীরা ছিলেন না। মেজর জিয়া, মীর্জা মনসুর ও মোশাররফ হোসেন বেতার চালু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তখন মেজর জিয়া সেনাদের বেতারকর্মীদের ধরে আনার নির্দেশ দেন। ২৯ মার্চ রাতে সেকান্দর হায়াত খান ও তাঁর ভাই হারুন-অর-রশীদ খান তাঁদের বাড়িতে বেতারকর্মীদের থাকা ও খাওয়ার আয়োজন করেছিলেন। ২৯ মার্চ সান্ধ্য অধিবেশনের পর বেতারকর্মীরা বেতারকেন্দ্র বন্ধ করে সেকান্দর হায়াত খানদের বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেনারা তাঁদের গভীর রাতে সেখান থেকে ধরে বোয়ালখালীতে মেজর জিয়ার কাছে নিয়ে যান। ৩০ মার্চ প্রভাতি অধিবেশনে মেজর জিয়া ২৮ মার্চের ঘোষণা সংশোধন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সরকার গঠন এবং তাঁর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
স্বাধীন
বাংলা
বেতার
কেন্দ্র
থেকে
প্রচারিত
উল্লেখযোগ্য
অন্যান্য
বিষয়:
২৫ মার্চের মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের পর ২৭ মার্চ পাকিস্তান সরকার বেতারে বঙ্গবন্ধুর গ্রেপ্তারের খবর প্রচার করে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে শুনলে জনগণের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ও হতাশা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা ছিল। এ জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তা অস্বীকার করে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় বিপ্লবী পরিকল্পনা কেন্দ্র থেকে মুক্তিবাহিনীকে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। স্পষ্টতই এ পরস্পরবিরোধী বক্তব্য বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করেছিল। ২৮ মার্চ পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের সচিত্র খবর সংবাদপত্রে প্রকাশ করে তা প্রমাণ করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তা বরাবরই অস্বীকার করে, এমনকি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সরকার গঠন এবং তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় বিপ্লবী পরিকল্পনা কেন্দ্রে অবস্থান করছেন বলে প্রচার করা হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিভিন্ন প্রোপাগান্ডার মধ্যে অন্যতম ছিল মুক্তিবাহিনী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান ও তাঁর সঙ্গীদের নিহত হওয়ার খবর। এ-সম্পর্কিত প্রথম খবরটি প্রচারিত হয় ২৭ মার্চ। এ প্রোপাগান্ডায় বিবিসিসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী গণমাধ্যম প্রভাবিত হয়েছিল।
বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ইত্যাদির বরাত দিয়েও বেশ কিছু প্রোপাগান্ডা চালানো হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে অন্তর্বিরোধের খবরও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে একাধিকবার প্রচার করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলার মুখে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামে বাঙালি একা নয়, বিশ্বজনমত বাঙালির পক্ষে—স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগণের মনোবল চাঙা রাখার জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এ ধরনের কিছু খবর প্রচার করা হয়।
২৮ মার্চের প্রভাতি অধিবেশন থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নিয়মিত অধিবেশন প্রচারিত হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়: প্রথম অধিবেশন সকাল নয়টার পর, দ্বিতীয় অধিবেশন বেলা একটার পর এবং সন্ধ্যা সাতটার পর তৃতীয় অধিবেশন। নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠান প্রচার সম্ভব ছিল না বলে শ্রোতাদের উদ্দেশে এভাবে আগাম ঘোষণা দেওয়া হয়।
আওয়ামী লীগ ও চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ চালু করলেও তার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ কিংবা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। অবশ্য বেতার চালু হওয়ার শুরু থেকে এর সঙ্গে সামগ্রিকভাবে জড়িত ছিলেন কালুরঘাট সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক সেকান্দর হায়াত খান। তিনি ও তাঁর ভাই হারুন-অর-রশিদ খানের নেতৃত্বে বেতারকেন্দ্রের আশপাশের লোকজন বেতারকর্মী ও নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের খাবারের ব্যবস্থা করত।
প্রথম দিকে বেতারের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন ইপিআর সেনারা। ২৭ মার্চের বিকেল থেকে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বেতারের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়। ২৭ মার্চের সান্ধ্য অধিবেশনের পূর্ব পর্যন্ত কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম কিংবা কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা ছিল না। এর পর থেকে বেতারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়াও সামরিক কর্মকর্তারা বেতারে প্রচারিতব্য বিষয়গুলো পড়ে অনুমোদন করে দিতেন।
৩০ মার্চ প্রভাতি অধিবেশনে অনুষ্ঠানের সূচনায় ও সমাপ্তিতে ঢাকা রেকর্ডের ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটির এপিঠ-ওপিঠ বাজানো হয়। সূচকসংগীত হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে শেষ দিন পর্যন্ত ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গানটির প্রচার চালু ছিল। নভেম্বর থেকে সমাপ্তিতে জাতীয় সংগীত প্রচার করা হয়। ৩০ মার্চ প্রভাতি অধিবেশন থেকেই সমাপ্তি ঘোষণায় ‘আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন, আমি তখনই কোনো জাতিকে সাহায্য করি, যখন সে জাতি নিজেকে সাহায্য করে’—এ বাক্যটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শেষ দিন পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
৩০ মার্চ দুপুরে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বোমা হামলায় বেতারকেন্দ্রের বিদ্যুত্ সরবরাহ, বৈদ্যুতিক চ্যানেলগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। কালুরঘাট সম্প্রচারকেন্দ্রে ১০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার ছাড়াও এক কিলোওয়াটের একটি স্বতন্ত্র ট্রান্সমিটার ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচার অব্যাহত রাখার জন্য এ ট্রান্সমিটারটি ডিসমেটাল করে প্রথমে পটিয়া, পরে পটিয়া থেকে রামগড় হয়ে ভারতের আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। শুরু হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্যায়।
স্বাধীন
বাংলা
বেতার
কেন্দ্রের
নামকরণ:
২৬ মার্চের প্রথম অধিবেশনে সংগঠকেরা এ বেতারকেন্দ্রকে ‘চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র’, ‘বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ ইত্যাদি বলে উল্লেখ করেন। রাখাল চন্দ্র বণিক বলেন, প্রথমে ‘চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র’ বলে ঘোষণা দিলেও পরে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ বলে তিনি ঘোষণা করেন। এ প্রসঙ্গে তত্কালীন বেতারের মেকানিক আবদুস শুকুর বলেন, তাঁরা খুব নার্ভাস ছিলেন এবং তাড়াহুড়ো করছিলেন। অন্যকিছু না বলে ‘বিপ্লবী বেতার থেকে বলছি’ বলে একজন তরুণ ঘোষণা দেয়। ২৬ মার্চের দ্বিতীয় অধিবেশনে এটাকে একটি গুপ্ত বেতারকেন্দ্র হিসেবে শুধু বেতারকেন্দ্রের নাম ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ বলে প্রচার করা হয়। ২৬ মার্চ সন্ধ্যা সাতটা ৪০ মিনিটে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি’—এ বাক্যের মাধ্যমে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের’ দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হয়। ২৬ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ নামকরণ করা হলেও এ নামটি সব সময় হুবহু ব্যবহার করা হয়নি। যেমন, ২৮ মার্চের প্রভাতি অধিবেশনে আবুল কাসেম সন্দীপের পড়া সংবাদ বুলেটিনে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’, ‘বাংলা বেতার কেন্দ্র’, ‘বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ ইত্যাদি নাম উল্লেখ করা হয়। ২৮ মার্চের দুপুরের অধিবেশন থেকে মেজর জিয়ার নির্দেশে লে. শমশের মবিনের (পরে পররাষ্ট্রসচিব ও রাষ্ট্যদূত) প্রস্তাবক্রমে বেতারের নাম থেকে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। বেতারের নাম হয় ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ঘোষণা থেকেই বাংলাদেশ ও বিশ্বের জনগণ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলাদেশে পরিচালিত বর্বর গণহত্যা এবং এ পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা জানতে পারে। স্বাধীনতার বেতার ঘোষণা ছাড়াও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ‘স্বাধীন বাংলা মুক্তিবাহিনী’ গঠন এবং ‘বাংলাদেশ সরকার’ প্রতিষ্ঠার কথা প্রথম প্রচারিত হয়—এ দুটি সংগঠন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অনেক পরে। ১০ কিলোওয়াটের ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এর প্রচারক্ষমতা ছিল মাত্র ৬০ বর্গকিলোমিটার। এ জন্য পুরো দেশের জনগণ এ কেন্দ্রের অনুষ্ঠান সরাসরি শুনতে পায়নি। তবে বৈশ্বিক গণমাধ্যম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ঘোষণাগুলো ব্যাপকভাবে প্রচার করায় দেশবাসী ও বিশ্ববাসী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূচনাপর্বের কথা জানতে পারে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠালগ্নে বেতার প্রকৌশলী আবদুস সোবহান ও দেলোয়ার হোসেন এবং কাস্টসম কর্মকর্তা এম এ হালিমও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। বেলাল মোহাম্মদের মতে, নিম্নোক্ত দশজন বেতারকর্মী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সূচনা থেকে শেষ পর্যন্ত স্বতঃপ্রণোদিতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন: মোহাম্মদ আমিনুর রহমান, কাজী হাবিব উদ্দীন আহমদ, আ ম শারফুজ্জামান, মোহাম্মদ রেজাউল করিম চৌধুরী, সৈয়দ আবদুস শাকের, মুস্তফা আনোয়ার, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, রাশেদুল হোসেন, আবদুল্লাহ আল ফারুক ও বেলাল মোহাম্মদ। তাঁরা ‘শব্দসৈনিক’ নামে পরিচিত।
ড. মোহাম্মদ মাহবুবুল হক: অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post