শিক্ষার আলো ডেস্ক
জুমার দিন মুসলিম উম্মাহর জন্য বিশেষ নেয়ামত। দিনটি অসংখ্য আমলে ভরপুর। জুমার দিনের শ্রেষ্ঠ আমল হলো- নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে আগে আগে মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ আদায় করা। এছাড়াও রয়েছে অনেক আমল। যা বছরজুড়ে ইবাদতের সাওয়াবের পাশাপাশি গুনাহ মাফের অন্যতম কারণও বটে। জুমার দিনের শ্রেষ্ঠ আমলসহ গুরুত্বপূর্ণ কিছু আমল আছে। আমলগুলো কী?
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘দুনিয়াতে আমাদের আসার সময় সব জাতির পরে আর কেয়ামতের দিন আমরা সবার অগ্রবর্তী (সবার আগে আমাদের হিসাব-নিকাশ হবে)। অবশ্য আমাদের আগে ওদেরকে (ইয়াহুদি ও নাসারাকে আসমানি) কিতাব দেওয়া হয়েছে। আমরা কিতাব পেয়েছি সবার পরে। এই (জুমার) দিনের তাজিম ওদের উপর ফরজ করা হয়েছিল। কিন্তু ওরা তাতে মতভেদ করে বসলো। পক্ষান্তরে আল্লাহ আমাদের তাতে একমত হওয়ার তাওফিক দান করেছেন। সুতরাং সব মানুষ আমাদের থেকে পশ্চাতে। ইয়াহুদি আগামী দিন (শনিবার)কে তাজিম করে (জুমার দিনের মতো মনে করে) এবং নাসারারা তার পরের দিনকে (রোববার)।’ (বুখারি, মুসলিম,মিশকাত)
১. জুমার দিনের শ্রেষ্ঠ আমল
জুমা সপ্তাহের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাপূর্ণ একটি দিন। এই দিনের নামাজই সর্বশ্রেষ্ঠ আমল আল্লাহ তাআলা এ দিন নামাজের ব্যাপারে এভাবে নির্দেশ দেন-
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا نُوْدِيَ لِلصَّلاَةِ مِنْ يَّوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ، ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُوْنَ
‘হে ঈমানদারগণ! যখন জুমার দিন নামাজের জন্য আহবান করা হবে, তখন তোমরা দ্রুত আল্লাহর স্মরণের জন্য উপস্থিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় বর্জন কর। এটিই তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা উপলব্ধি কর।’ (সুরা জুমা : আয়াত ৯)
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, সূর্য উদিত হওয়ার দিনগুলোর মধ্যে জুমার দিন সর্বোত্তম। এই দিনে আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিনে তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এই দিনে তাঁকে জান্নাত থেকে বের করা হয়েছে।’ (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যে ব্যক্তি জুমার দিন গোসল করে উত্তম পোশাক পরবে এবং সুগন্ধি ব্যবহার করবে, যদি তার কাছে থাকে। তারপর জুমার নামাজে আসে এবং অন্য মুসল্লিদের গায়ের ওপর দিয়ে টপকে সামনের দিকে না যায়। নির্ধারিত নামাজ আদায় করে। তারপর ইমাম খুতবার জন্য বের হওয়ার পর থেকে সালাম পর্যন্ত চুপ করে থাকে। তাহলে তার এই আমল পূর্ববর্তী জুমার দিন থেকে পরের জুমা পর্যন্ত সব সগিরা গুনাহর জন্য কাফ্ফারা হবে।’ (আবু দাউদ)
জুমার নামাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ আরও আমল হলো-
১. মিসওয়াক করা।
২. জুমার নামাজের প্রস্তুতির জন্য ফরজ গোসলের মতো উত্তমরূপে গোসল করা।
৩. জুমার নামাজের জন্য উত্তম পোশাক পরা।
৪. সুগন্ধি ব্যবহার করা।
৫. মনোযোগের সঙ্গে খুতবাহ শোনা।
৬. বেচাকেনা বন্ধ রাখা
জুমার দিন আজানের পর বেচাকেনা বন্ধ রাখা দিনটির গুরুত্বপূর্ণ আমল। আল্লাহ তাআলা বলেন-
‘হে মুমিনগণ! জুমার দিনে যখন নামাজের আজান দেওয়া হয়, তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে দ্রুত ছুটে যাও এবং বেচাকেনা বন্ধ করো। এটা তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা বোঝো।’ (সুরা জুমা : আয়াত ৯)
৭. দ্রুত মসজিদে যাওয়া
জুমার দিনের একটি উত্তম আমল হচ্ছে দ্রুত মসজিদে যাওয়া। আল্লাহ তাআলার নির্দেশও এটি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘জুমার দিন মসজিদের দরজায় ফেরেশতারা অবস্থান করেন এবং ক্রমানুসারে আগে আগমনকারীদের নাম লিখতে থাকেন। যে সবার আগে আসে সে ওই ব্যক্তির মতো যে একটি মোটাতাজা উট কোরবানি করে। এরপর যে আসে সে ওই ব্যক্তি যে একটি গাভি কোরবানি করে। এরপর আগমনকারী ব্যক্তি মুরগি দানকারীর মতো। তারপর ইমাম যখন বের হন তখন ফেরেশতাগণ তাদের লেখা বন্ধ করে দেন এবং মনোযোগ সহকারে খুতবা শুনতে থাকেন। (বুখারি)
৭. সুরা কাহফ তেলাওয়াত
জুমার দিন তথা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে জুমার দিন সূর্য ডেবার আগ পর্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ এই দিনের বিশেষ একটি আমল হচ্ছে সুরা কাহফ তেলাওয়াত করা। হাদিসে এসেছে-
‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহফ পাঠ করবে তার জন্য দুই জুমা পর্যন্ত (নূর) উজ্জ্বল করা হবে।’
কেউ যদি পুরো সুরাটি তেলাওয়াত করতে না পারে তবে সে যেন সুরাটির প্রথম ও শেষ ১০ আয়াত তেলাওয়াত করে। শেষ ১০ আয়াত পাঠ করা প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে-
‘যে ব্যক্তি জুমার দিন সুরা কাহাফ পড়বে তা জুমার মধ্যবর্তী সময়ে তার জন্য আলোকিত হয়ে থাকবে। আর যে ব্যক্তি এই সুরার শেষ ১০ আয়াত পাঠ করবে এরপর দাজ্জাল বের হলে তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। যে ব্যক্তি অজুর পর এই দোয়া পড়বে তার নাম একটি চিঠিতে লেখা হবে। এরপর তাতে সিল দেওয়া হবে, যা কেয়ামত পর্যন্ত আর ভাঙা হবে না।’ (তারগিব, মুসতাদরাকে হাকেম)
৮. বেশি বেশি দরূদ পড়া
জুমার দিন বেশি বেশি দরূদ পড়া গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, দিনসমূহের মধ্যে জুমার দিনই সর্বোত্তম। এই দিনে হজরত আদম আলাইহিস সালামকে সৃষ্টি করা হয়েছে। এই দিনে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। এই দিনে শিঙায় ফুঁ দেওয়া হবে। এই দিনে সব সৃষ্টিকে বেহুঁশ করা হবে। অতএব, তোমরা এই দিনে আমার ওপর বেশি বেশি দরূদ পড়। কেননা তোমাদের দরূদ আমার সম্মুখে পেশ করা হয়।’ (আবু দাউদ)
যে ব্যক্তি জুমার দিন আসরের নামাজের পর ৮০ বার এ দরুদ পড়বে-
اَللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ النَّبِيِّ الْأُمِّيِّ وَعَلَى آلِهِ وَسَلِّم تَسْلِيْمَا
উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আ’লা মুহাম্মাদিনিন নাবিয়্যিল উম্মিয়্যি ওয়া আ’লা আলিহি ওয়া সাল্লিম তাসলিমা।’
তার ৮০ বছরের গোনাহ্ মাফ হবে এবং ৮০ বছর ইবাদতের সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হবে। সুবহানাল্লাহ!
৯. বেশি বেশি দোয়া করা
দোয়া কবুলের অন্যতম দিন জুমা। দোয়া কবুলের বিশেষ একটি মুহূর্তও রয়েছে। জুমার দিন সূর্য উদয় হওয়ার পর (দুনিয়ায়) মানুষ এবং জিন ব্যতিত প্রত্যেক প্রাণীই কেয়ামতের ভয়ে আতংকিত থাকে। জুমার দিনে এমন একটি বরকতময় সময় আছে, যাতে মুসলিম বান্দা নামাজরত অবস্থায় আল্লাহর কাছে যা প্রার্থনা করবে, আল্লাহ্ তাকে তা দান করবেন। হাদিসে এসেছে-
‘জুমার দিনের ১২ ঘণ্টার মধ্যে একটি বিশেষ মুহূর্ত এমন আছে যে তখন কোনো মুসলমান আল্লাহর কাছে যে দোয়া করবে আল্লাহ তা কবুল করেন।’ (আবু দাউদ)
যাদুল মাআ`দ গ্রন্থে এসেছে, ‘এ মর্যাদাবান মুহূর্তটি হলো- জুমা`র দিন আছরের নামাজ আদায়ের পর (থেকে মাগরিব পর্যন্ত)।’ এ মতে পক্ষে হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদিস রয়েছে আর তা হলো-
কা’ব বিন মালিক এ হাদিসের বর্ণনাকারী হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে জিজ্ঞেস করলেন, এটি কি প্রত্যেক বছরে হয়ে থাকে?
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, বরং তা (এ সময়টি) প্রত্যেক জুমাতেই রয়েছে। অতঃপর কা’ব বিন মালিক তাওরাত (কিতাব) খুলে পাঠ করলেন এবং বললেন, আল্লাহর রাসুল সত্য বলেছেন।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন যে, অতঃপর আমি (তাওরাত কিতাবের পারদর্শী) হজরত আব্দুল্লাহ বিন সালামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। এবং তাঁকে কা’ব বিন মালিকের সঙ্গে আমার বৈঠকের কথা জানাই। তখন তিনি (হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম) বললেন, আমি সেই সময়টি সম্পর্কেও অবগত আছি।
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তার কাছ থেকে সেই সময়টি সম্পর্কে জানতে চান। তিনি বলেন-
‘এটি (দোয়া কবুলের সেই সময়টি) হচ্ছে জুমার দিনের শেষ মুহূর্ত।’
হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, এটি কি করে সম্ভব? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তো বলেছেন, ‘মুসলিম বান্দা তখন নামাজরত অবস্থায় আল্লাহর কাছে যা চাইবে আল্লাহ্ তাকে তা দান করবেন।’
আর (জুমার) দিনের শেষ মুহূর্তের সময়টিতে নামাজ পড়া বৈধ নয় (আসর নামাযের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নামায পড়া নিষিদ্ধ)। সুতরাং উহা তো নামাজের সময় নয়।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম তখন বললেন- ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেন নি যে ব্যক্তি কোনো মজলিসে বসে নামাজের অপেক্ষায় থাকে সে ব্যক্তি নামাজ পড়া (নামাজের ওয়াক্ত হওয়া) পর্যন্ত নামাজেই মশগুল থাকে?
সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, আগে আগে জুমার প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আজানের সঙ্গে সঙ্গে পায়ে হেঁটে মসজিদে আসা। দিনটি ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে অতিবাহিত করা্
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জুমার দিন নামাজ পড়াসহ আমলগুলো যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। জুমার দিনের কোরআন-সুন্নাহর দিকনির্দেশনাগুলো মেনে চলার তাওফিক দান করুন। আমিন।
Discussion about this post