আন্তর্জাতিক ডেস্ক
দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের মাইক্রোনেশিয়া অঞ্চলের একটি ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্র নাউরু। এর নিকটতম দ্বীপ হলো ৩০০ মাইল পূর্বে অবস্থিত কিরিবাতির বানাবা দ্বীপ। নাউরু বিশ্বের ক্ষুদ্রতম দ্বীপ রাষ্ট্র (ক্ষেত্রফল মাত্র ২১ বর্গ কিলোমিটার)। এর পাশাপাশি এটি বিশ্বের ক্ষুদ্রতম স্বাধীন প্রজাতন্ত্র, এবং একমাত্র দেশ যার কোনো রাজধানী নেই।
এখানকার আদি বাসিন্দারা হল মাইক্রোনেশীয় ও পলিনেশীয় জাতির মানুষ। জার্মানি উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এটিকে দখল করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর এটি অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ও যুক্তরাজ্যের অধীনে একটি ম্যান্ডেট বা প্রশাসিত এলাকায় পরিণত হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান এটি দখল করে। যুদ্ধের শেষে এটি আবার অধীনস্থ প্রশাসিত এলাকায় পরিণত হয় এবং ১৯৬৮ সালে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে।
নাউরু ফসফেট খনিজে সমৃদ্ধ। ১৯০৭ সাল থেকে এখানকার অর্থনীতির প্রধান আয় আসে ফসফেট খনিজ আহরণের মাধ্যমে। তবে বর্তমানে খনিজ ফসফেট প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, আর এই খনিজ আহরণ করতে গিয়ে পরিবেশগত বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছে।
নাউরুর জনসংখ্যা মাত্র ১৩,০৪৮ জন (২০০৫ সালের হিসাব)। এর মধ্যে ৫৮ শতাংশ নাউরুর আদি অধিবাসী, ২৮ শতাংশ অন্যান্য দ্বীপের অধিবাসী, ৮ শতাংশ চীনা, এবং ৮ শতাংশ ইউরোপীয়।
বর্তমানে নাউরুর না আছে কোনো আবাদি জমি, না আছে এখানকার জনগণের কোনো নিশ্চিন্ত জীবন। মাত্র দুই দশকেই বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী রাষ্ট্র থেকে ভাড়াটে বা ‘হাত পাতা’ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে নাউরু।
কয়েক লাখ বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক পাখির অভরায়ণ্য ছিল প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে এই নাউরু অঞ্চলটি। তাদের ফেলে যাওয়া বর্জ্য কয়েক লাখ বছর ধরে জমতে জমতে উৎকৃষ্ট মানের ফসফেটের টিলায় পরিণত হয়। পরবর্তীকালে এই ফসফেটের টিলা নাউরুর জন্য ‘স্বর্ণের খনি’ হয়ে ধরা দেয়। ফসফেট কৃষিকাজের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান এবং নাউরুতে যে ফসফেট পাওয়া যেত, সেগুলো ছিল পুরো পৃথিবীতে সর্বোৎকৃষ্ট মানের। একটি দেশের যেখানে আবাদি জমি প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ সেখানে রয়েছে চাষাবাদের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট উপাদানটি।
১৯০৬ সালে জার্মানরা প্রথম নাউরুর এই ফসফেট খনির সন্ধান পায়। ‘প্যাসিফিক ফসফেট কোম্পানি’ এর নামে এখান থেকে তারা ফসফেট উত্তোলন শুরু করে। এ অবস্থা চলতে থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা পরাজিত হলে ‘ব্রিটিশ ফসফেট কমিশন’ এর নামে নাউরু থেকে ফসফেট উত্তোলন চলতে থাকে। আর এর সুবিধা নেয় ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও অবস্থা প্রায় একই ছিল।
১৯৬৮ সালে নাউরু স্বাধীনতা লাভের পর দৃশ্যপট পুরো পাল্টে যায়। আপনারা হয়তো ভাবছেন, এখন থেকে তারা নিজেদের সম্পদ টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে সচেতন হবে- এত বছরের ক্ষতি কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করবে। কিন্তু না! ‘ব্রিটিশ ফসফেট কমিশন’ কিনে নিয়ে ‘নাউরু ফসফেট করপোরেশন’ নাম দিয়ে তারা পুরোদমে ফসফেট উত্তোলন চালাতে থাকে। আর সেই ফসফেট বিক্রি করতে থাকে পশ্চিমা বিশ্বের কাছে। জাহাজে পণ্য তোলার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে গড়ে তুলে বিশাল আকৃতির ক্রেন। সহজেই নাউরুর সরকারের হাতে আসতে থাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ।
১৯৭৫ সালে নাউরুর সরকারি ব্যাংকে জমা হয় ২৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! স্বাধীনতার পর এক যুগের অর্ধেক সময়ে কোনো রাষ্টের এত বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক হওয়া বিরল। আর সে সময় নাউরুর জনসংখ্যা ছিল সাত হাজারের কাছাকাছি। নাউরুর জনগণের মাথাপিছু আয় এত বেশি ছিল যে, তাদের সামনে একমাত্র ধনী রাষ্ট্র ছিল কুয়েত। নাউরুকে তখন বলা হতো প্যাসিফিকের কুয়েত। তেল রাজ্য কুয়েতের মতোই সহজ অর্থ আয় করতে থাকে নাউরু।
নাউরুর এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে তাদের পরবর্তী কয়েক প্রজন্মকে আরামেই খাইয়ে-পরিয়ে রাখা যেত। কিন্তু তাদের এই অর্থ দেশের উন্নয়নের জন্য খরচ করা ছিল অত্যন্ত জরুরি। উন্নত চিকিৎসা, উচ্চ শিক্ষা, মানসম্মত বাসস্থান- এসব কাজে খরচ করার জন্য এই অর্থ ছিল যথেষ্ট। কিন্তু নাউরু কর্তৃপক্ষের কাছে অন্যরকম পরিকল্পনা ছিল। তারা দামি বাড়ি, বিলাসবহুল হোটেল এবং গলফ কোর্ট বানায়। নাউরু কর্তৃপক্ষ এমনভাবে টাকা উড়াচ্ছিল, যেন তা কোনোদিনই শেষ হবে না।
তারা একটি বিমানবন্দর বানায়, যার উদ্দেশ্য হলো পশ্চিমা দেশ থেকে খাদ্য আমদানি করা। নিজেদের দেশে খাদ্য উৎপাদন করার চেয়ে তারা বহির্দেশ থেকে খাবার আনার দিকেই বেশি মনোযোগ দিতে থাকে। সে জন্য তারা সাতটি বোয়িং বিমান কেনে, যা একসঙ্গে নাউরুর ১০ শতাংশ জনগণ বহন করতে সক্ষম।
তাদের এই বিলাসিতা যেন শেষ হওয়ার নয়। সবকিছু একসঙ্গে দেখভাল করার জন্য তারা একটি নাউরু ট্রাস্ট গঠন করে। কিন্তু অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, অবাস্তব পরিকল্পনা- সবকিছু নাউরুকে নিঃস্ব করে দিতে শুরু করে। সরকারি লোকজন রাষ্ট্রের টাকায় বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করতে শুরু করে। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, লন্ডন এবং ফিজির মতো দেশগুলোতে তৈরি করে নিজেদের বিলাসবহুল হোটেল। এর ফলে তারা প্রচুর পরিমাণ অর্থ পাচার করতে থাকে।
কিন্তু তাদের এই ফসফেটের সম্পদ তো একসময় ফুরিয়ে আসবে। হলোও তা-ই। ফসফেট রপ্তানি ছাড়া নাউরুর যেহেতু আর কোনো রাষ্ট্রীয় উপার্জন নেই এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগারও বলতে গেলে ফাঁকা হয়ে পড়েছে, তাই নাউরু সরকার এখন অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছে হাত পাততে বাধ্য হলো। অন্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে অর্থ ধার নিয়ে তারা রাষ্ট্র চালাতে থাকে।
বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী রাষ্ট্র থেকে কীভাবে অল্প সময়েই নাউরুকে পথে বসতে হলো? সবকিছু এখানেই শেষ নয়। অন্য রাষ্ট্রের থেকে ধার করা অর্থ তো নাউরুকে ফেরত দিতে হবে। সে জন্য তাদের অর্থ উপার্জনের অন্য রাস্তা খোঁজা দরকার। নাউরুর একজন অর্থ বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিলেন, লন্ডনভিত্তিক ব্যান্ড ‘ইউনিট ফোর প্লাস টু’ কে দিয়ে সংগীত অনুষ্ঠান আয়োজন করতে। লন্ডনে তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান থেকে উঠে আসবে নাউরুর রাষ্ট্র চালানোর অর্থ। কতটুকু ভারসাম্যহীন হলে একটি রাষ্ট্র তাদের ভবিষ্যৎ ছেড়ে দেয় একটি সংগীত দলের অনুষ্ঠানের ওপর, তা নাউরু সরকারকে না দেখলে বোঝা যাবে না। মাত্র দু সপ্তাহ চলার পর সেই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সেইসঙ্গে নাউরুর ওপর পড়ে ৭০ লাখ ডলারের ঋণের বোঝা।
এ ঋণের বোঝা বহন করা নাউরুর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না। এ জন্য অনুষ্ঠানের পেছনে যেসব প্রতিষ্ঠান অর্থ খরচ করেছিল, তারা নাউরুর সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়। সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয়ে যায় পুরো জাতির ভবিষ্যৎ। পথে বসতে বাধ্য হয় পুরো নাউরু জাতি।
নাউরুর কাছে এখন আছে ২১ বর্গ কিলোমিটারের জমি, যার কোথাও ফসল আবাদ করা সম্ভব না। মাত্রাতিরিক্ত খোঁড়াখুঁড়ির ফলে আশেপাশের সব পানি দূষিত হয়ে পড়েছিল। আর সেই সঙ্গে আছে সাত হাজার লোক, যারা সবাই মিলে একটি জেলখানায় আটকা পড়ে গিয়েছে। এদের সবার মৌলিক চাহিদা পূরণ করা নাউরু সরকারের জন্য এক অসম্ভব ব্যাপার।
নাউরু সরকার ঘোষণা দিল, ২০ হাজার ডলার দিয়ে যে কেউ চাইলে নাউরুতে ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে পারবে। কিন্তু এতে হলো হিতে বিপরীত। নাউরুর অতি সাদাসিধে ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনাকে কাজে লাগিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের মাফিয়া গোষ্ঠী ৭০ বিলিয়ন ডলারের অর্থ পাচার করে বসে। নাউরুর করুণ দশা এখানেই থেমে থাকেনি। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে কসোভা এবং আবখাজিয়াকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার জন্য নাউরু রাশিয়ার কাছ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলার অর্থ আত্মসাৎ করেছে। যদিও জাতিসংঘে নাউরু এ ঘটনা অস্বীকার করে এবং মানবিক দিক বিবেচনায় পুতিন সরকার নাউরুকে ৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে বলে জানায়।
দিনে দিনে নাউরু আরও দুর্দশার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়া সরকার নাউরুতে উদ্বাস্তু শিবির কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। যারা অস্ট্রেলিয়াতে পালিয়ে আসত কিংবা কোনো কঠিন অপরাধে অস্ট্রেলিয়া সরকার যাদের দেশ থেকে বিতারিত করার নির্দেশ দিত, তাদের ঠিকানা হতো নাউরু। এ জন্য নাউরুকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ভাড়া দিত অস্ট্রেলিয়া সরকার। কিন্তু নাউরুর পরিবেশ এতই বাজে যে, সেখানে নিয়মিত খাবার পানি পেতেও মারামারি করা লাগত। জীবনের নিরাপত্তার তো প্রশ্নই ওঠে না।
নানা আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত ২০০৮ সালে বন্ধ করে দেয়া হয় সেই উদ্বাস্তু কেন্দ্র। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালে কিছুটা উন্নতি করে আবার এই কেন্দ্র চালু করা হলেও, অবস্থা সেই আগের মতোই আছে।
বর্তমান নাউরুর দিকে তাকালে দেখা যাবে, সেখানে ৭০ শতাংশ জমি আছে যাতে কোনোপ্রকার চাষাবাদ সম্ভব না, নিম্নমানের খাবার এবং নানা রোগে ভুগতে থাকা জনগণ। নাউরুর ৯৭ শতাংশ পুরুষ এবং ৯৩ শতাংশ নারী স্থূলতার শিকার। মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ নাগরিকের রয়েছে টাইপ-২ ডায়াবেটিস। কিডনি বিকল এবং হৃদরোগ সেখানে খুবই স্বাভাবিক। সেই সাথে নাউরুর ৯০ শতাংশ নাগরিকই বেকার।
সূত্র: ব্রাট ন্যাচার, রোয়ার বাংলা, উইকিপিডিয়া
Discussion about this post