শিক্ষার আলো ডেস্ক
১৯৮৬ সালে সহকারী শিক্ষক হিসেবে শুরু করেছিলেন নিজের কর্মজীবনটা। এরপর শিক্ষকতা করেছেন একটানা ৩৫ বছর। তবে সাড়ে তিন দশকের শিক্ষকতা জীবনে একদিনের জন্যও নেননি ছুটি ! যশোরের অভয়নগর উপজেলার ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সেই শিক্ষক সত্যজিৎ বিশ্বাস অবশেষে ছুটি পেলেন, তার কর্মজীবন শেষ হয়ে অবসর নেয়ার মাধ্যমে তিনি ছুটি পেলেন।
শনিবার (৯ অক্টোবর) সত্যজিৎ বিশ্বাসের শেষ কর্মদিবস ছিল তার প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। রোববার (১০ অক্টোবর) বিদায় সংবর্ধনার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে তাকে বিদায় জানিয়েছে ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। শিক্ষকতার জন্য তাই আর কোনোদিন বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দেখা যাবে না স্থানীয় কিংবদন্তীতে পরিণত হওয়া এই শিক্ষককে।
সত্যজিৎ বিশ্বাসের বাড়ি যশোরের মনিরামপুর উপজেলার কুচলিয়া গ্রামে। ১৯৮৪ সালে বিএসসি পাস করার পর সত্যজিৎ বিশ্বাস ১৯৮৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পড়াতেন নবম ও দশম শ্রেণির গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞান।
সত্যজিৎ স্যারের স্ত্রী গৃহিণী। ছেলে কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে চাকরির অপেক্ষায় আছেন। মেয়ে পশুপালনের ওপর স্নাতকোত্তর পড়ছেন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
কর্মক্ষেত্রে যোগদানের সময়ই বিশ্বজিৎ বিশ্বাস প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, একদিনও কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকবেন না। সেই অঙ্গীকার রক্ষা করেছেন তিনি। ঝড়-বৃষ্টি-বিয়ে-স্বজনের মৃত্যু-কোনো কিছুই তাকে আটকাতে পারেনি স্কুলে উপস্থিতির ক্ষেত্রে। ৩৫ বছরে স্কুলে অনুপস্থিত থাকেননি এক দিনের জন্যও।
১৯৯৩ সালে এক সোমবার সকালে বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান বিশ্বজিৎ বিশ্বাসের বাবা মাধব চন্দ্র বিশ্বাস। গ্রামের লোকজনকে ডেকে নিজের প্রতিজ্ঞার কথা জানিয়ে মৃত বাবাকে রেখে চলে যান ক্লাসে। স্কুল শেষে বিকেলে ফিরে এসে বাবার সৎকার করেন রাতে।
৬০ বছর বয়সী সত্যজিৎ বিশ্বাস বলেন, শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার সময় প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, জীবনে কোনোদিন স্কুল ফাঁকি দেবো না। বিধাতা আমাকে এই কাজে সাহায্য করেছেন। প্রতিদিন হাজির হয়েছি স্কুলে। শুধু দুই দিন স্কুলে পৌঁছানোর পর কিছুটা অসুস্থ বোধ করি। একদিন ক্লাস শুরুর আগে সমাবেশ চলাবস্থায় মাথা ঘুরে পড়ে যাই মাঠে। পরে অফিসে নিয়ে মাথায় পানি দিলে আমি সুস্থ হই।
গুণী এই শিক্ষক বলেন, ছোটবেলা থেকেই আমি এমন। গ্রামের দিগঙ্গা কুচলিয়া হরিদাসকাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। স্কুলজীবনে অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে কোনোদিন অনুপস্থিত থাকিনি। অসুস্থতার জন্য শুধু দশম শ্রেণিতে দুই দিন অনুপস্থিত ছিলাম।
বিয়ের পর স্ত্রী আরতী বিশ্বাস প্রথম দিকে একটু রাগ করতেন। পরে সেরা শিক্ষক হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কার পেলে সত্যজিৎ স্যারের ত্যাগকে শ্রদ্ধা করে আসছেন তিনি।
অবসরজীবন কীভাবে কাটাবেন— এমন প্রশ্ন শুনে সত্যজিৎ বিশ্বাসের চেহারা বিষণ্ণ হয়। বলেন, তখন বাড়ি বসে কর্মজীবনের কথা ভাবা ছাড়া গতি নেই। আমার গ্রামের মানুষও আমাকে ঠিকভাবে চেনেন না। মনিরামপুর উপজেলায় বাড়ি হলেও আমার সব পরিচিতি স্কুলকে ঘিরে।
সত্যজিৎ বিশ্বাসের বিদায়ে বিষণ্নতা ছুঁয়ে যাচ্ছে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদেরও। ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ছাত্রী সাদিয়া খাতুন বলেন, স্যার অন্যরকম মানুষ। আমাদের গণিত পড়ান। কোনো কিছু না বুঝলে বার বার বুঝিয়ে দেন। স্যার আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন, এটা ভাবতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।
ধোপাদী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম বলেন, ১৯৯০ সালে প্রধান শিক্ষক হিসেবে আমি এখানে যোগ দিয়েছি। সেই থেকে সত্যজিৎ বিশ্বাস আমার সহকর্মী। কোনোদিন দেখিনি ঝড়-বৃষ্টি বা অসুস্থতার কথা বলে তাকে ছুটি নিতে। কোনো বছর ঐচ্ছিক ছুটিও কাটাননি তিনি। আজ সত্যজিৎ বিশ্বাসকে আমাদের বিদায় দিতে হয়েছে। তাকে ছাড়তে হচ্ছে— এটা ভেবে খারাপ লাগছে। তারপরও তাকে সম্মানের সঙ্গে আমরা বিদায় জানাই। প্রার্থনা করি, তার মঙ্গল হোক।
Discussion about this post