অনলাইন ডেস্ক
‘পাক সেনারা আমাকে ও আমার ভাইকে রাস্তা থেকে ধরে বড়ইতলা নিয়ে যায়। হত্যাযজ্ঞ শুরু হলে একজন পাকসেনা বেয়নেট দিয়ে মাথায় আঘাত করলে জ্ঞান হারিয়ে লাশের স্তূপে পড়ে যাই। পাক সেনারা ভেবে নেয়, আমি মারা গেছি। তাই তারা লাশের স্তূপেই ফেলে রেখে যায়।’
কথাগুলো বলছিলেন কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার বড়ইতলা গ্রামের বাসিন্দা মোমতাজ উদ্দিন। ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর এই গ্রামে ঘটে নৃশংস এক ঘটনা। সেই দিন রাজাকারদের সহযোগিতায় কয়েকশ’ মানুষকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। জ্বালিয়ে দেওয়া হয় কয়েকটি গ্রাম।
ওই দিন ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান মোমতাজ উদ্দিন। ভয়ঙ্কর সেই দিনের ঘটনার বর্ণনায় তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুরো একদিন আমি লাশের স্তূপের মধ্যে পড়েছিলাম। পরদিন এক নারী আমাকে উদ্ধার করে। সেদিন এলাকাটি পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে কারবালা হয়েছিল। কয়েকশ মানুষকে হত্যার পর উল্লাস করেছিল হানাদাররা।’
৫০ বছর আগের দিনটির কথা মনে হলে মোমতাজ উদ্দিনের মতো আজও ভয়ে শিউরে ওঠেন এলাকার প্রবীণরা। ভয়ঙ্কর সেই দিনের কথা মনে করিয়ে দেয় শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ।
প্রতিবছর দুঃস্বপ্নের মতো বড়ইতলা গ্রামে ফিরে আসে ১৩ অক্টোবর। সেদিন কিশোরগঞ্জের যশোদল ইউনিয়নের বড়ইতলা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে ৩৬৫ জনকে। আর এ গণহত্যায় মদদ জোগায় রাজাকাররা। বছর ঘুরে দিনটি ফিরে এলে স্বজনহারা লোকজন নীরবে চোখের পানিতে ভাসে।
স্থানীয়রা জানান, পাক সেনাদের একটি ট্রেন ১৩ অক্টোবর সকালে এসে থামে বড়ইতলা গ্রামের কাছে। তারপর তারা ট্রেন থেকে নেমে স্থানীয় রাজাকারদের নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে একটি সমাবেশ করার চেষ্টা চালায়। এ সময় এক পাক সেনা দলছুট হয়ে পড়ায় রাজাকাররা গুজব রটিয়ে দেয়, তাকে হত্যা করা হয়েছে। এরপরই হিংস্র পশুর মতো নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি বাহিনী।
বড়ইতলা, চিকনিরচর ও দামপাড়াসহ আশপাশের এলাকার পাঁচ শতাধিক লোককে ধরে এনে কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেল লাইনের পাশে জড়ো করে তারা। এক পর্যায়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয় ৩৬৫ জনকে। এ সময় আহত হয় দেড় শতাধিক মানুষ।
৪৯ বছর আগের দিনটির কথা মনে হলে আজও শিউরে ওঠেন এলাকার প্রবীণরা
স্মৃতিসৌধটি যে জমির ওপর সেটা দান করেছিলেন বড়ইতলা গ্রামের মো. মর্ত্তুজ আলী। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ১৩ অক্টোবর ছাড়া স্মৃতিসৌধটির খোঁজ কেউ রাখে না। তবে দীর্ঘদিনের জরাজীর্ণতা কেটেছে। বর্তমান উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপে স্মৃতিসৌধটির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা এলাকাবাসীর বহুদিনের দাবির প্রতিফলন। আশা করবো, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই স্মৃতিসৌধ ও বড়ইতলা গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরতে অবিলম্বে একটি পাঠাগারও নির্মাণ করা হবে।
কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শামীম আলম জানান, নতুন প্রজন্মের কাছে ১৯৭১ সালের এই গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরতে আমরা কাজ করছি। পাকহানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল নিরীহ মানুষ। অনেক বড় গণহত্যার ঘটনা ছিল এটি। জেলার সকল বধ্যভূমি যথাযোগ্য মর্যাদায় সংরক্ষণেও আমরা কাজ করছি। সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post