সাবমেরিন ক্যাবলে কারিগরি ত্রুটি বা দেশে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে জরুরি মুহূর্তে ইন্টারনেট সেবা দেবে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সরকারি-বেসরকারি সব টেলিভিশন চ্যানেল সম্প্রচারিত হচ্ছে। বাংলাদেশ বেতারের সম্প্রচার কার্যক্রমও চলছে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। দেশের দুর্গম ও উপকূলীয় এলাকার ৩১টি দ্বীপ এখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ব্যান্ডউইথের আওতায়। সেখানে ফ্রি ইন্টারনেট সেবা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া এটিএম বুথ, টেলিমেডিসিন ও টেলিএডুকেশনের কার্যক্রমও পরিচালিত হবে এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। কেবল বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নয়, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের কাজ এগিয়ে নিচ্ছে সরকার। আর ওই আর্থ অবজারেভেশন স্যাটেলাইট পুরো বাংলাদেশকে পাহারা দেবে।— সম্প্রতি সারাবাংলা ডটনেটের সঙ্গে আলাপকালে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিএসসিএল) চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্নাহী কর্মকর্তা ড. শাহজাহান মাহমুদ এসব তথ্য জানান।
ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটলাইটের অনুষ্ঠানিক কার্যক্রমের দুই বছর পার হয়েছে। আমরা এখন তা সেলিব্রেট করব। আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই এই উৎসব করা হবে। আমরা এখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর জন্য কাজ করা শুরু করেছি। আমাদের যে পরামর্শক ছিল ওরাও তাদের রিপোর্ট দিয়েছে। তাদের যে ডকুমেন্টাশন সেটা সরকারের কাছে দিয়েছে, সরকার তা গ্রহণ করেছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ এর জন্য প্রি-ডিপিপি হয়ে গেছে। তা সাবমিট করা হয়েছে। এটি হয়ে গেলেই আমরা কাজে হাত দেব। সরকারের নির্দেশনা হচ্ছে, এটি একটি জিটুজি প্রজেক্ট হবে। এটি একটি ট্রাঙ্কি প্রজেক্ট হবে। ট্রাঙ্কি প্রজেক্ট হচ্ছে- আমাদের এখানে কোনো শেয়ার থাকবে না। যারা সাপ্লাই দেবে তারা সবকিছু করে আমাদের বুঝিয়ে দেবে।’
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর সফলতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সফলতা অনেক। দেশের সবগুলো টিভি চ্যানেল, সরকারি ও বেসরকারি এবং বাংলাদেশ বেতার- সবই এখন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর মাধ্যমে সম্প্রচারিত হচ্ছে। আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে খুব শিগগিরই ঢুকব। অভ্যন্তরীণ বাজার বলতে বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম মেশিন, টেলিমেডিসিন ও টেলিএডুকেশন। আমরা এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে টেলিমেডিসিন ও টেলি এডুকেশনর কার্যক্রম পরিচালনা করব।’
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ তো কমিউনিকেটিভ স্যাটেলাইট, এর সঙ্গে ইন্টারনেটের সম্পৃক্ততা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেটের সম্পর্ক আছে। কিন্তু আমরা দেব না। এটাতে দিলে পরে খরচ হয় অনেক বেশি। ইন্টারনেট তো অবশ্যই আছে। ইমার্জেন্সির জন্যে আমরা ইন্টারনেট দেব। দুর্গম এলাকায় যখন বিভিন্ন দুর্যোগে চিরাচরিত বা ট্রাডিশনাল ইন্টারনেট কাজ করবে না অথবা ক্যাবল ছুটে গেল বা অন্য কিছু হলো- তখন স্ট্যান্ড বাই হিসাবে এটাকে নিয়ে আসব। এই স্যাটেলাইট থেকেও ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ দেওয়া যায়। কিন্তু এখন আমরা দিচ্ছি না। কারণ এর ব্যান্ডউইথের দাম অনেক বেশি। এর যে ব্যান্ডউইথ আছে আমরা তা শুধু টেলিভিশনকে দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘দ্বিতীয় যে স্যাটেলাইট হবে সেটা কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট হবে না, সেটা হবে আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট। পৃথিবীর ওপর থেকে বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখবে। আমাদের ব্লু ইকোনমি, মানে বিরাট সমুদ্র অঞ্চল, যার আয়তন বাংলাদেশের চেয়েও বেশি- সেই অঞ্চল পাহারা দেওয়ার জন্য দ্বিতীয় স্যাটেলাইটকে কাজে লাগাব। তারপর দেশের ফসলের কী অবস্থা, কোনখানে ভালো ফসল হচ্ছে, কোনখানে খারাপ ফসল হচ্ছে- সব এক নিমিষে দেখা যাবে। এছাড়া দুয়েক দিন আগেই বন্যার পূর্বাভাস আমরা দিতে পারব। সার্বক্ষণিকভাবে এটা বাংলাদেশকে নজরদারি করতে পারবে।’
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার বিদেশে ভাড়া দেওয়া যাচ্ছেওনা কেন?— জানতে চাইলে বিএসসিএল চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ‘দেশের বাইরে ব্যান্ডউইথের দাম কম থাকায় এখন আর ট্রান্সপন্ডার ভাড়া দেওয়া হবে না। এ কারণেই আমরা এখন অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি করছি। আমরা প্রায় এক তৃতীয়াংশ ট্রান্সপন্ডার ব্যবহার করছি। বাকিগুলো অব্যবহৃত আছে। অভ্যন্তরীণ বাজার যদি ঠিকমতো তৈরি করতে পারি বাকিগুলো কাজে লেগে যাবে।’
বিভিন্ন টেলিভিশন ও আকাশের কাছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের যে বকেয়া বিল ছিল এখন তা আর বাকি নেই বলে জানান তিনি। ড. শাহজাহান মাহমুদ বলেন, ‘মাঝ খানে অনেক বাকি পড়ে ছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের হস্তক্ষেপে এখন এটা আপডেট আছে। ওরা ফুল পে করেছে। এখন আর ওদের কাছে কোনো বিল বাকি নেই।’
স্যাটেলাইটের পেছনে যে অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে সেই অর্থ উঠে আসবে কি না?— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা যত তাড়াতাড়ি আসার কথা ছিল তত তাড়াতাড়ি আসবে না। এখনও স্যাটেলাইটের ট্রান্সন্ডারের ওয়ান থার্ড অব্যবহৃত।’ নির্দিষ্ট সময়ে বিনিয়োগ না উঠে আসার কারণ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে তো আমাদের হাত নেই। বাইরে ব্যাডউইথের দাম কমে গেলে তো আমাদের কিছু করার নেই। তাই আমরা এখন অভ্যন্তরীণ বাজার নিয়ে কাজ করছি। এটিএম মেশিনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হবে না। তবে আমরা দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। ওরা ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবলে যেমন দাম দেয়, আমরা তার চেয়ে দাম কমিয়ে আনার চেষ্টা করছি। তবে সবগুলো ব্যাংক এলে আমরা পুরো সাপোর্ট দিতে পারব না। এত এটিএম মেশিন আছে যে, সবগুলোতে দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের নেই।’
২০১৮ সালের ১২ মে বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ২টা ১৪ মিনিটে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে দেশের প্রথম উপগ্রহ ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’র সফল উৎক্ষেপণ হয়। নিজ কক্ষপথ ১১৯ দশমিক ১ ডিগ্রিতে পৌঁছানোর পর এর ইন অরবিট টেস্টসহ (আইওটি) নানাধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হয়, পাওয়া যায় সফল সংকেত। উৎক্ষেপণের ছয় মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর মালিকানা ও দেখভালের দায়িত্ব বুঝে নেয় বাংলাদেশ। এরপর থেকে বাংলাদেশ কমিউনেকশন স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেডের (বিসিএসসিএল) অধীনে স্যাটেলাইটটির সম্পূর্ণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
ওই বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত সাফ চাম্পিয়নশিপ সরাসরি সম্প্রচারের ক্ষেত্রে সফলতা দেখায় দেশের প্রথম এই স্যাটেলাইট। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর মাধ্যমে বিটিভিতে খেলা দেখানো হয়। মাত্র এক বছরের মধ্যেই স্যাটেলাইটটির বাণিজ্যিক কার্যক্রমও শুরু হয়। দেশের সবকটি টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও এখন স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সম্প্রচার কার্যক্রম চালাচ্ছে। স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ক্যাবল ছাড়া টিভি দেখার ডিটিএইচ সেবাও চালু হয়েছে। এখন পর্যন্ত বেশ জনপ্রিয় এইসেবা।
এদিকে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের লক্ষ্যে এগিয়ে চলছে কার্যক্রমও। ইতোমধ্যে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য পরামর্শকও নিয়োগ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহার অনুযায়ী, ২০২৩ সালের মধ্যে এর কার্যক্রম চালুর ঘোষণা রয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ উৎক্ষেপণের লক্ষ্যে কাজ করছে বিসিএসসিএলও।
বিসিএসসিএল’র তথ্যমতে, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটে ৪০টি ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। ইতোমধ্যে ডিরেক্ট টু হোম’ (ডিটিএইচ) সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান আকাশ ছয়টি ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নিয়েছে। এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সবচেয়ে বড় গ্রাহক তারাই। বাইরের কয়েকটি দেশ বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নিতে আগ্রহ দেখালেও এখন পর্যন্ত কোনো সুখবর মেলেনি।
Discussion about this post