ড. মো. তৌহিদুল ইসলাম
বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বহুমুখী প্রক্রিয়ায় সর্বস্তরের শিক্ষা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সম্প্রসারণ, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষাকে গণমুখীকরণের মাধ্যমে সর্বসাধারণের কাছে শিক্ষার সুযোগ পৌঁছে দেওয়া, সর্বোপরি দক্ষ মানবসম্পদ গড়ার লক্ষ্যে ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর (৬ কার্তিক, ১৩৯৯) বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়-বাউবি প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদান পদ্ধতির মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। এখানে শিক্ষাদানের বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি যেমন- ফিল্ম ক্যাসেট, টেলিভিশন অনুষ্ঠান, বেতার অনুষ্ঠান, বক্তৃতা, টিউটোরিয়াল, আলোচনা, সেমিনার, পরিদর্শন এবং ল্যাবরেটরি, ওয়ার্কশপ, কৃষিজমিতে ব্যবহারিক শিক্ষাসহ বাস্তব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
স্নাতক থেকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদানের পাশাপাশি এ বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে ডিপ্লোমা এবং সার্টিফিকেট কোর্স প্রদানের পরিকল্পনা গ্রহণ ও প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। প্রয়োজনবোধে বিশ্ববিদ্যালয়টি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিষ্ঠান, পেশাধারী সংগঠন এবং সংস্থাকে সহযোগিতা প্রদান; একই সঙ্গে তাদের কাছ থেকেও যে কোনো ধরনের সহযোগিতা গ্রহণ করতে পারবে। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই বাউবি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বিশেষ করে ‘ড্রপ আউট’ শিক্ষার্থী এবং বয়স্কদের পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তা ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পদোন্নতি পাওয়ার লক্ষ্যে এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি বা সার্টিফিকেট প্রোগ্রাম সফলভাবে সম্পন্ন করতে দেখা যায়। এখানে সাপ্তহিক ছুটির দিনে শিক্ষা কার্যক্রম চলায় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা শিক্ষা ছুটি না নিয়েও শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রযুক্তিনির্ভর হলেও মূলত দুটো প্রধান প্রযুক্তি- টেলিভিশন ও বেতার অনুষ্ঠাননির্ভর অধিকাংশ প্রোগ্রাম পরিচালিত হয়। তবে সম্প্রতিক বাউবির ওয়েব টিভি শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন স্কুলে প্রায় ১৪০ জন ফুলটাইম শিক্ষক নিয়োজিত, যাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বিভিন্ন বিষয়ের ফরমাল ও নন্-ফরমাল প্রোগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে। দেশের আনাচে-কানাচে গড়ে ওঠা বাউবির অসংখ্য স্টাডি সেন্টারে বিভিন্ন প্রোগ্রামে নানাবয়সী প্রায় ১০ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে, যাদেরকে শিক্ষাদানে স্কুল থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষক বাউবিতে টিউটর হিসেবে নিয়োজিত। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রযুক্তিনির্ভর এবং কর্মমুখী বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রাম যেমন বিএসসি ইন কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুড সায়েন্স অ্যান্ড নিউট্রিশন, বিবিএ, এমবিএ, মাস্টার্স ইন এগ্রিকালচারাল সায়েন্স, মাস্টার্স ইন সাসটেইন্যাবল এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল লাইভলিহুড, মাস্টার্স ইন পাবলিক হেলথ এবং সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে অর্নাস ও মাস্টার্স প্রোগ্রাম চালু করেছে, যেখানে প্রবীণদের থেকে নবীন তথা চলতি শিক্ষার্থীদেরই বেশি আগ্রহ দেখা যায়।
শিক্ষাদান পদ্ধতি বা মাধ্যম যাই হোক; বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান মূলত দুটো উদ্দেশ্যের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে, যার একটি শিক্ষা, অপরটি গবেষণা। গবেষণার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবেন- এ উপলব্ধিকে ধারণ করে সম্প্রতি বাউবি শিক্ষাদানের পাশাপাশি আধুনিক সরঞ্জাম সজ্জিত এগ্রিকালচারাল, বায়োলজিক্যাল, সফ্টওয়্যার, নেটওয়ার্কিং, ডিজিটাল হার্ডওয়্যার এবং ইলেকট্রনিপ গবেষণাগার গড়ে তুলেছে। এসব গবেষণাগার পিসিআর, ইলেকট্রনিক মাইক্রোস্কোপ, এইচপিএলসি, মাইক্রোওয়েব ওভেন, অটোক্ল্যাব, ডিজিটাল ব্যালান্স, ল্যামিনার ফ্লো, মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড রেফ্রিজারেটর, কম্পিউটার, গ্রোথ চেম্বার, স্পেকট্রোফটোমিটার ইত্যাদি আধুনিক সরঞ্জামের সমন্বয়ে সজ্জিত করা হয়েছে, যা এক সময় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের স্বপ্টম্ন ছিল। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাসে ছোট পরিসরে কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন স্কুলের অধীনে একটি ‘মাঠ গবেষণাগার’ স্থাপন করা হয়েছে। এসব গবেষণাগার থেকে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী মাস্টার্স পর্যায়ের গবেষণা সম্পন্ন করে ডিগ্রি অর্জন করেছে।
ছাত্র-শিক্ষক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রাণ। নিজস্ব ক্যাম্পাসে একটি একাডেমিক ভবন নির্মাণ বাউবির ছাত্র-শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি। দেখতে দেখতে শিশু বাউবি কৈশোর পেরিয়ে ২৯ বছরের যুবকে পরিণত হলেও এখন পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি কোনো একাডেমিক ভবন। একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে একাডেমিক ভবন না থাকা যেন একেবারেই বেমানান। প্রতি বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক প্রোগ্রামের তালিকায় সংযোজিত হচ্ছে নিত্যনতুন প্রোগ্রাম, অথচ একাডেমিক ভবন না থাকায় এসব প্রোগ্রাম চালানো অনেক সময় কষ্টসাধ্য হয় বিধায় বহু টাকার বিনিময়ে বেসরকারি ভবন ভাড়া করে চালাতে হয় একাডেমিক প্রোগ্রাম। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাসটি গাজীপুরে ৩৫ একর জমির ওপর নির্মিত, যেখানে বেশ কিছু জমি এখনও পতিত। আবার কিছু পুরোনো ভবন রয়েছে, যেগুলো ব্যবহারের প্রায় অনুপযোগী। যদি পতিত জমি অথবা পুরোনো ভবন ভেঙে ৩৫ একরের ক্যাম্পাসে অন্তত এক বিঘা জমিও বের করা যায়, তাহলে সেখানে একটি আধুনিক বহুতল একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা সম্ভব। এতে বেসরকারি ভবন ভাড়া বাবদ যে অর্থ অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় হচ্ছে, তা থেকে বাউবি অবমুক্ত হবে। কাজেই নিজস্ব ক্যাম্পাসে একটি একাডেমিক ভবন নির্মাণই হোক ৩০তম শুভ জন্মদিনে বাউবি পরিবারের অঙ্গীকার। ‘শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার’। আর এ অধিকার বাউবির পক্ষ থেকে সব শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্য নিশ্চিত করার মাধ্যমেই শুভ হোক বাউবির জন্মদিন।
লেখক- সহযোগী অধ্যাপক, কৃষি ও পল্লি উন্নয়ন স্কুল, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post