ড. মিল্টন বিশ্বাস , অধ্যাপক, কলামিস্ট
‘নয়া উন্নয়ন পরিকল্পনার এক যুগ (২০০৯-২০২১) ড. শামসুল আলম সম্মাননা গ্রন্থ’ চলতি বছরের(২০২১) অন্যতম একটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থে বর্তমান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী, পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সাবেক সদস্য ও সিনিয়র সচিব অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সম্পর্কে ৭০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখনি সংকলিত হয়েছে।শামসুল আলমের জীবন ও কর্ম নিয়ে স্মৃতি রোমন্থনও রয়েছে। তাঁদের মধ্যে আছেন মন্ত্রী, এমপি, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ দেশের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ। একজন মানুষ কতটা ভালো মনের মানুষ হলে এবং দেশ ও সমাজের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হলে তাঁকে নিয়ে এমন সম্মাননা গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তা পাঠকসমাজের কাছে অজানা নয়।
এছাড়া আছে তাঁর নিজের লেখা বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধ, নিজের জীবনী, বিভিন্ন টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারের অনুলিপি। নিজের শিক্ষা জীবন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যেসকল গবেষণাকর্ম করেছেন এবং প্রকাশ পেয়েছে তার একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। একুশে পদকপ্রাপ্তি সম্পর্কে বিভিন্ন ব্যক্তির মন্তব্যও যুক্ত রয়েছে। ড. শামসুল আলমের জন্ম থেকে আজ অবধি বিভিন্ন কাজ ও ভ্রমণের আলোকচিত্রও আছে এখানে। যেসকল ব্যক্তিবর্গ শামসুল আলম সম্পর্কে স্মৃতি রোমন্থন করেছেন তাঁরা বেশিরভাগই শামসুল আলমের পরিচিত ব্যক্তিবর্গ, তাঁর ছাত্র, সহকর্মী, বন্ধু, আত্মীয়। তবে আরো আছেন অজানা দেশের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ । তিনি শুধু বাংলাদেশের নয় দেশের বাইরেও বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে একজন পরিচিত মুখ। তিনি আছেন বাংলাদেশের কোটি মানুষের মুখে ও হৃদয়ে।
বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য থাকাকালীন তিনি যে কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন দেশের মাঝে সেই পরিকল্পনার সমস্তই তাঁর হাত ধরে এগিয়েছে। ১০০ বছরের বদ্বীপ পরিকল্পনা, রূপকল্প ২০৪১, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা তাঁর হাত ধরেই এসেছে। বাংলাদেশে নতুন ইতিহাস লেখা হয়েছে তাঁকে ঘিরেই। ইতিহাস তাঁকে ঘিরে আছে তাঁর কাজে কর্মে। অনন্ত ইতিহাস হয়ে তিনি অনন্তকাল মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন এ দেশের পাঠকের এমনটাই প্রত্যাশা।
সম্মাননা গ্রন্থের লেখকগণ তাঁকে নিয়ে কখনো স্মৃতি কখনো বা অনুভূতি বর্ণনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ বন্ধু, ছাত্র ও সহকর্মী। তাঁরা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন মন্তব্য করে তুলে এনেছেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে শুরু করে আজ অবধি তাঁর নিভৃত কর্ম-পরিকল্পনা ও নিবেদিতপ্রাণময়তার স্বরূপ।উপরন্তু তাঁর আচার-ব্যবহার, জ্ঞান আরো বিভিন্ন বিষয়। এই গ্রন্থে আরো আছে ড. শামসুল আলম-এর সংক্ষিপ্ত জীবনী, প্রকাশিত বইয়ের তালিকা, প্রকাশিত গবেষণাকাজের তালিকা, প্রকাশিত কলামের একটা অংশ, বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর দেওয়া সাক্ষাৎকার এবং বিভিন্ন আলোচনার শিরোনাম। সেসব শিরোনাম পড়লেই বুঝতে পারা যায় একজন আদর্শ মানুষ কর্মবীর যোদ্ধা মানুষের ভালোবাসা পেতে, মানুষের শ্রদ্ধা পেতে মানুষকে কাছে টানতে, ইতিহাসের অংশ হতে, শ্রম আচরণ-ব্যবহার কেমন হতে হয় এগুলোই শামসুল আলমকে দেখে বোঝা যায় যা সকলের কাছে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্র হিসেবে তিনি মহিমান্বিত। দেশ ও বিদেশের লেখকদের মধ্যে কিছু মানুষ তাঁর গুণকীর্তন করেছেন। সেই গুণকীর্তন অঙ্কিত হয়েছে এই বইয়ের বিভিন্ন পাতায় পাতায়।
উঠে এসেছে তাঁর জীবন কর্ম, বেড়ে ওঠা, চলাফেরা ইত্যাদি বিষয়ে । বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের স্মৃতি তুলে এনেছেন বন্ধু নজরুল ইসলাম। তিনি লিখেছেন, মোহনে মোহনীয় হয়ে থাকতো সবাই। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এমন শান্ত ও সুদর্শন বন্ধু আমার আর নেই। আচার ব্যবহারে চিন্তায় ভিন্ন হলেও আমাদের দেখা হতো সব সময় । পড়াশোনাতেই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, কাজই ছিল তাঁর প্রাণ, মনের আনন্দ ।
ব্যক্তিজীবনে শামসুল আলম ছিলেন শিক্ষার্থীবান্ধব ও বন্ধুত্বসুলভ। শিক্ষা ছিল তাঁর চিন্তা আর চেতনা। কাজকে ভালোবাসতেন খুব। কাজই তাঁর জীবন। শিক্ষকতা পেশায় তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। তাঁর ছাত্ররা সেগুলোই লিখেছেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন একজন সুদর্শন, সুবচনী যিনি সুন্দর করে কঠিন বিষয় বুঝিয়ে দিতেন। এমন আদর্শ শিক্ষক এখন খুব কমই দেখা যায়।
প্রকৃতপক্ষে ডক্টর শামসুল আলমকে মানুষ যেভাবে দেখেছেন সেটাই বলেছেন তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষীরা, এগুলোই স্থান পেয়েছে বিভিন্ন দৃষ্টিতে। জানতে পারা যাবে এ বই পাঠে একজন সত্যিকরের মানুষকে, পাঠক জানতে পারবেন নির্লোভ, সৎ ও আদর্শ শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে। নিরলসভাবে কাজ করলে তার ফল কখনো বৃথা যায় না। তারই উদাহরণ আবারও আমাদের সামনে উঠে এসেছে এই স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থের স্মৃতি আলেখ্যে।
একজন নিভৃত কর্মবীর ডক্টর শামসুল আলম দেশ ও জাতির জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন সারাটি জীবন। মহাকাল তাঁকে স্থান দিবে ইতিহাসের পাতায়।এই সম্মাননা প্রকাশনাটি একটি অনুপ্রেরণামূলক বই। এ বই পাঠ করে মানুষের মধ্যে অনুপ্রেরণা জাগবে আদর্শবান ব্যক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। সত্যিকরের মানুষ হবার অনুপ্রেরণা এ সময়ে খুবই দরকার। এই অনুপ্রেরণামূলক কথা শামসুল আলমের কাজে, আচার-ব্যবহারে ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। আর এইগুলো উঠে এসেছে তাঁকে চোখে দেখা, তাঁর সাথে কাজ করা, তাঁর ছাত্রদের মুখে, তাঁর ছাত্রদের লেখায়।এগুলো জানতে হলে আলোচ্য বইটি পাঠ করতে হবে।
আসুন আমরা আরো কিছু জানি এই বই সম্পর্কে, ডক্টর শামসুল আলম সম্পর্কে বলা কিছু মানুষের উক্তি স্মরণীয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন শামসুল আলম সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছেন, ‘‘জীবনে অনেকের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ ও বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে কজনার স্মৃতি আলোড়িত করে আমাকে সেই তুলনায় মোটামুটি স্বল্প পরিসরে জানাশোনার মধ্যে ডক্টর আলম আমার কাছে স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।’ প্রথমে তাঁকে দেখেই তিনি বলেছেন, শামসুল আলাম একজন নিবেদিত আমলা।
অধ্যাপক সেলিম জাহান শামসুল আলম সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেন, ‘‘অধ্যাপক শামসুল আলম তাঁর কাজের প্রতি অসম্ভব রকমের অঙ্গীকারাবদ্ধ। পেছনের বছরগুলোতে বাংলাদেশের বেশ ক’টি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কর্ণধার ছিলেন তিনি।’’ তিনি আরো বলেন, ‘‘অধ্যাপক শামসুল আলম একলা চলো নীতিতে বিশ্বাস করেন না । একটি অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সবাইকে নিয়েই তিনি কাজ করেন।’’ নূহ-উল-আলম লেলিন বলেন, ‘‘ড. শামসুল আলম দেশের উন্নয়ন-কৌশল, দারিদ্র্য নিরসন এবং ব্যক্তি খাতের বিকাশে তাঁর নিজস্ব মৌলিক চিন্তাভাবনা প্রকাশে দ্বিধাহীন । রাজনীতিবিদদের সঙ্গে এখানেই তার পার্থক্য।’’
বিনায়ক সেন ডক্টর শামসুল আলমের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন যে, ‘‘শামসুল আলমকে একসময় আমার সপ্তরথী পরিবেষ্টিত অভিমন্যুর মতো মনে হতো একা ও অসহায় সংগ্রামী । কিন্তু তিনি একা নন।’’ তিনি অভিমন্যুর সাথে ডক্টর শামসুল আলম স্যারের তুলনা করে ইতিহাসকে টেনে এনেছেন। ড. মাহফুজ কবির বলেছেন, ‘‘তিনি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে সফল ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাবিদ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় তাঁর হাত ধরে বাংলাদেশ আবার উন্নয়ন পরিকল্পনার যুগে ফিরে এসেছে। তাঁকে পরপর তিনটি বড় পরিকল্পনা প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল: ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ছাড়াও ২০৪১ রূপকল্প পরিকল্পনা।’’ ড. মো. জহিরুল ইসলাম শামসুল আলম সম্পর্কে লিখেছেন, ‘‘ড. শামসুল আলম শুধু একজন পরিকল্পনাবিদ ও বিজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তিই নন, তিনি একজন দক্ষ প্রশাসকও বটে।’’ তিনি আরো বলেন , ব্যক্তি জীবনে তিনি একজন স্বল্পভাষী সদালাপী অমায়িক মানুষ। কাজের বাইরে অতিরিক্ত কথা পছন্দ করতেন না। অফিসারদের সঙ্গে কখনো কোনো খারাপ আচরণ করতে শুনিনি। কাজের স্বার্থে তিনি অনেক কঠোর ছিলেন । কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে তিনি সকলকেই স্নেহ করতেন।’’
অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, ‘‘বাংলাদেশের অর্থনীতিকে দীর্ঘদিন থেকে অতি নিকট থেকে তিনি দেখে আসছেন। এ সময় বাংলাদেশ অর্থনীতি ও সঠিক বিষয় অন্য কেউ শামসুল আলমের থেকে বেশি জানেন বলে মনে হয় না। অন্য কেউ জানতে পারেন, তবে আমাদের নজরে পড়েনি । একজন শামসুল আলম সরকারের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। জ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, লেখক সর্বোপরি বিশ্বস্ত একজনকে সরকার পেয়েছে ড. শামসুল আলমের মতো।’’ তিনি আরো বলেন, শামসুল আলম স্বভাবে ভদ্র, বিনয়ী ও নীরব। কিন্তু কর্মে সরব।ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, ‘‘অপ্রিয় হলেও সত্য বলতে তিনি কখনো দ্বিধা করেন না। তিনি কাউকে খুশি করার জন্য তাঁর পেশাদারিত্ব বিসর্জন দেননি, যা অনেকের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করি।’’ তিনি আরো বলেন, শামসুল আলম একজন নিখাদ ভদ্রলোক। নম্রতা, বিনয়, নিরহংকারতা, সদা হাসিমুখ ও অন্যদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ তাঁর পেশাদার হিসেবে সফলতার একটি বড় কারণ বলে মনে করি। শামসুল আলম প্রচুর লেখালেখি করছেন । কয়েক ডজন বই লেখা হয়ে গেছে। এগুলো জাতির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বই।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘‘ড. শামসুল আলমকে সামষ্টিক অর্থনীতিবিদ ও জাতীয় পরিকল্পনাবিদ হিসেবে আমি যতোটুকু জেনেছি তা বিস্তারিত বলতে গেলে কয়েকটা বই লেখা যাবে। স্বভাবসুলভভাবে ছাত্র অবস্থা আর সেই মোহনই আছে যাকে কিনা ধীর-স্থির সৎ, স্বল্প ও নম্রভাষী, গোছানো ও সুশৃঙ্খল ব্যক্তি হিসেবে দেখেছি। আমার বিশ্বাস তাঁর এ স্বভাবগত চারিত্রিক গুণই মনে হয় আজ তাঁকে দেশের এক অবিস্মরণীয় কিংবদন্তি ব্যক্তিত্বে উন্নীত করেছে।’’
মূলত ‘‘নয়া উন্নয়ন পরিকল্পনার এক যুগ (২০০৯-২০২১) ড. শামসুল আলম সম্মাননা গ্রন্থ’’-টি বাংলাদেশের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মযজ্ঞ পরিকল্পনা ও চিন্তাভাবনা এবং ড. শামসুল আলমের জীবনের অনন্য প্রকাশনা। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি তাঁর সম্পর্কে যে অভিমত দিয়েছেন ও স্মৃতিকথা তুলে ধরেছেন তা পাঠক সমাজকে বিমুগ্ধ করবে- এটা লেখাবাহুল্য। এই বই সংগ্রহে রাখার জন্য এবং শামসুল আলম সম্পর্কে জানার জন্য প্রত্যেকের পাঠ্য হওয়া দরকার।
Discussion about this post