শিশির মোড়ল
তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন বা পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে, তা পূরণ বা বাস্তবায়নে সম্মুখসারিতে আছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। স্বাস্থ্যে সফল ডিজিটাল প্রযুক্তি প্রয়োগের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘ ২০১১ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ডিজিটাল হেলথ ফর ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট’ পুরস্কার দেয়।
দেশের স্বাস্থ্য খাত নতুন স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, স্বাস্থ্যপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্যকৌশল, স্বাস্থ্যনীতি আত্মস্থ করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কোথায় কী ঘটছে, তার ওপর নজর রেখেছেন এই খাতের সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তা, বিজ্ঞানী ও গবেষকেরা। নতুন কিছু পেলেই তা দেশে এনে নিজেদের মতো করে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, বিশ্বের খুব কম দেশই আছে, যারা ই–হেলথ এবং স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা (হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম) বাংলাদেশের মতো এগিয়ে নিতে পেরেছে।
স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের কাজটি করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন একটি বিভাগ—হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস)। এমআইএসের লক্ষ্য স্বাস্থ্য তথ্য ব্যবস্থা, ই–হেলথ ও মেডিকেল বায়োটেকনোলজির উন্নতি করা। এসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল আছে এমআইএসের। এমআইএসের পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার একটি রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি আছে। আমরা সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে কাজ করছি। কাজ করার সময় প্রধামন্ত্রীর কার্যালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, আইসিটি বিভাগ থেকে প্রভূত সহায়তা পেয়েছি। আইটি বিশেষজ্ঞদের একটি দল আমরা তৈরি করতে পেরেছি। বর্তমান সাফল্য ধরে রাখার পাশাপাশি আমরা হাসপাতাল অটোমেশনের দিকে যাচ্ছি।’
সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা
২০১৫ সালে স্বাস্থ্য বাতায়ন নামে কল সেন্টার চালু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর নম্বর ১৬২৬৩। ২৪ ঘণ্টা এই সেন্টার খোলা থাকে। এখানে ফোন করে বিনা মূল্যে চিকিৎসকের পরামর্শ ও স্বাস্থ্যতথ্য পাওয়া যায়। এখানে কর্মরত চিকিৎসকেরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ বছর ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ১ কোটি ৮৬ লাখ ৫৮ হাজার ১৭৯ জন স্বাস্থ্য বাতায়নে ফোন করে সেবা নিয়েছেন।
করোনার সময় স্বাস্থ্য বাতায়নের মতো কল সেন্টারের গুরুত্ব আরও বেশি অনুভূত হয়েছে। হাসপাতাল, ক্লিনিক বা চিকিৎসকের কাছে যেতে না পারা মানুষ স্বাস্থ্য বাতায়নে ফোন করে চিকিৎসাসেবা ও পরামর্শ নিয়েছেন। দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত কল এসেছে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৫৫ হাজার ২৭৭টি। করোনাকালে স্বাস্থ্য বাতায়ন ডিজিটাল হাসপাতাল হিসেবে কাজ করেছে। স্বাস্থ্য বাতায়নের কর্মকর্তারা বলেছেন, স্বাভাবিক সময়ে ২৪ ঘণ্টায় কল আসে ৫ থেকে ১০ হাজার। মহামারিকালে কল এসেছে ৮০ থেকে ৯০ হাজার। এই বিপুলসংখ্যক কলের জবাব দেওয়ার জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক সেখানে যুক্ত করা আছে।
টেলিমেডিসিন সেবা চালু আছে প্রায় ১০০ হাসপাতালে। এর মাধ্যমে উপজেলা হাসপাতালে থাকা রোগী ঢাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পান। তবে এসব উদ্যোগ বা ব্যবস্থা যদি কাজে না লাগে অথবা প্রয়োজনের সময় মানুষ যদি সেবা না পান, তা হলে সরাসরি অভিযোগেরও ব্যবস্থা আছে।
ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তি
স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া ছাড়াও স্বাস্থ্য খাত ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
জাতীয় পর্যায়ের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল থেকে শুরু করে চালু ১৩ হাজারের বেশি কমিউনিটি ক্লিনিকে একটি করে কম্পিউটার এবং ২৪ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীকে টেবলেটসহ ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে মাঠ থেকে হালনাগাদ তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও টেলিমেডিসিন সেবা, ভিডিও কনফারেন্স, স্বাস্থ্যশিক্ষা, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ নিয়মিত করা হয়। এমআইএস বর্তমানে হেলথ সিস্টেম স্ট্রেনদেনিং নামে একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মসূচিতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতিটি সেবা প্রতিষ্ঠানের মান, দক্ষতা ও কার্যকারিতা যাচাই করা হয়। তার ভিত্তিতে প্রতিবছর সেরা প্রতিষ্ঠানকে ‘হেলথ মিনিস্টারস’ পুরস্কার দেওয়া হয়।
বিশ্বের ৬৩টি দেশের স্বাস্থ্য খাতে ডিএসআইএস–২ নামে একটি সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের ইলেকট্রনিক তথ্য, স্বাস্থ্য জনবল, হাসপাতাল অটোমেশন, জনস্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহের একটি নেটওয়ার্ক চালু করেছে এমআইএস। দেশগুলোর মধ্যে সফটওয়্যারটি সবচেয়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করছে বাংলাদেশ।
ডিএসআইএস–২ ব্যবহারকারী সর্ববৃহৎ দেশ হওয়ায় জার্মান সরকার ২০১৪ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগকে ‘বেস্ট প্র্যাকটিস অ্যাওয়ার্ড’ দেয় এবং আ কোয়াইট রেভল্যুশন ইন হেলথ ইনফরমেশন সিস্টেম ইন বাংলাদেশ নামের একটি বইও প্রকাশ করে।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ ও স্বাস্থ্য খাতের এসডিজি লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের পরিধি ও মান বাড়াতে হবে।
Discussion about this post