নিজস্ব প্রতিবেদক
২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে দুই সেমিস্টারে ভর্তি করানোর নির্দেশনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমন নির্দেশনায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এখতিয়ার নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্রাস্টি, উপাচার্য ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন—বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক চাপ বাড়াতে এ আইনের ব্যত্যয় ঘটানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের ‘ইউনিক স্টুডেন্ট আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার’ ম্যানুয়াল তৈরির জন্য গত ৯ আগস্টের চিঠিতে বলা হয়, কোনোক্রমেই ২০২১ সালের পর বছরে দুই সেমিস্টার ছাড়া শিক্ষার্থী ভর্তি কমিশনের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। এই নির্দেশনার পর ইউজিসির পক্ষ থেকে আবার বলা হয়েছে ২০২২ সালের জুলাই থেকে দুই সেমিস্টার চালু হবে।
ইউজিসির এই নির্দেশনাকে অপকৌশল উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি আইনের সুস্পষ্ট ব্যত্যয়। অ্যাকাডেমিক বিষয়ে এমন নির্দেশনা দেওয়ার আগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতে হতো। তা না করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ওপর ইউজিসির এক ধরনের খবরদারি।
২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের ক্ষমতা ও দায়িত্ব অনুচ্ছেদের ২০ (১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিষয়ক প্রধান কর্তৃপক্ষ হবে।’
অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের ক্ষমতা ও দায়িত্বের বিষয়ে ২০ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘সংশ্লিষ্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভর্তি, শিক্ষাদান, শিক্ষা এবং পরীক্ষার মান উন্নয়ন ও তা বজায় রাখার বিষয়ে অ্যাকডেমিক কাউন্সিল দায়ী থাকবে এবং এ সকল বিষয়ের ওপর কাউন্সিলের নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা থাকবে।’
২০ ধারার ২ উপধারায় আরও বলা হয়েছে, ‘সিন্ডিকেটের অনুমোদন সাপেক্ষে এই আইন এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সংশ্লিষ্ট নীতিমালা এবং বিশ্ববিদ্যালয়-সংবিধির বিধান অনুসারে পাঠ্যসূচি ও পাঠক্রম প্রণয়ন ও গবেষণার বিষয় নির্ধারণ করা যাবে। সংবিধি দ্বারা অর্পিত অন্যান্য ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করবে বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে সিন্ডিকেটকে পরামর্শ দেবে।’
২০১৭ সালের বাংলাদেশ অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল আইনের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, সরকারি বা বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রমগুলোর জন্য প্রণীত কারিক্যুলাম এবং ওই কারিক্যুলাম অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গৃহীত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনার পর তা মানসম্মত ও ফ্রেমওয়ার্কের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উচ্চশিক্ষা দিতে সক্ষম বলে কাউন্সিল স্বীকৃতি দেবে।
সংজ্ঞায় আরও জানানো হয়, অ্যাক্রিডিটেশন কমিটি সরকারি ও বেসরকারি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণ করে মূল্যায়ন করার জন্য আইনের অধীনে বিধি তৈরি করবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বলছে— ২০১০ সালের সেরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে স্পষ্ট বলা হয়েছে অ্যাকাডেমিক বিষয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। তাহলে আলোচনা না করেই অ্যাকাডেমিক বিষয়ে ইউজিসি হঠাৎ নির্দেশনা দিলো দুই সেমিস্টারে ভর্তি করাতে। বছরে তিন সেমিস্টারে ভর্তির বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চলমান থাকলেও ২০২২ সালের জুলাই থেকে দুই সেমিস্টারে ভর্তির নির্দেশনা আসে হুট করে।
আবার অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল আইন অনুযায়ী অ্যাকাডেমিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করা কারিক্যুলাম এবং ওই কারিক্যুলাম অনুযায়ী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও পর্যালোচনা করবে ইউজিসি। মানসম্মত ও ফ্রেমওয়ার্কের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ উচ্চশিক্ষা দিতে সক্ষম কিনা তা যাচাই করবে সংস্থাটি। কিন্তু বাস্তবে ইউজিসি এসবের তোয়াক্কা না করে উল্টো খবরদারি করছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষার্থীদের ওপর আর্থিক চাপ তৈরিতেই যেন দুই কারিক্যুলামে ভর্তি নিতে বাধ্য করাতে চাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে।
জানতে চাইলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যখন আইন করেছিলেন, তখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। দুই সেমিস্টার করার যে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে তা আইনের বাইরে। ইউজিসির সদস্যদের মধ্যে মাত্র একজন সদস্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। বাকি সবাই সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের। ইউজিসির সদস্য নিয়োগে সমতা আনা প্রয়োজন। ইউজিসির আইন-কাঠামো পরিবর্ধন, সংশোধন করা উচিত।’
শেখ কবির হোসেন আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি, আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। খণ্ডকালীন সদস্য হিসেবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি থাকলে এ ধরনের কাজ তারা করতে পারতো না। আমি মন্ত্রীকে জানাবো দুই সেমিস্টার বা তিন সেমিস্টার যাই হোক, আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিক্যুলাম কারা করবে এবং অনুমোদন কারা দেবে এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ফরমালি এ বিষয়ে আমি কথা বলতে চাচ্ছি না।’ তবে দুই সেমিস্টার চালু হলে শিক্ষার্থীরদের ওপর আর্থিক চাপ বাড়বে সেটা স্পষ্ট করেছেন তিনি।
ইউজিসির নির্দেশনার বিষয়ে অধ্যাপক ড. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘তারা তো আমাদের সঙ্গে কোনও কনসাল্ট করে না।’
এসব বিষয়ে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘২০২২ সালের জুলাই থেকে দুই সেমিস্টার চালু হবে। প্রয়োজনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেকশন করতে পারে, আসন বাড়াতে পারে। শিক্ষক ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বিবেচনায় তা করা যেতে পারে। কিন্তু তিন সেমিস্টারে ভর্তি করানো যাবে না।’
দুই সেমিস্টার করলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিক্যুলামে বিশৃঙ্খলা হতে পারে কিনা জানতে চাইলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘দুই সেমিস্টারের কারিক্যুলামের জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’
শিক্ষাক্রম কারা প্রণয়ন করবে এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কারিক্যুলাম অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল তৈরি করে ইউজিসিতে পাঠাবে, ইউজিসি সেটার অনুমোদন দেবে।’
Discussion about this post