শিক্ষার আলো ডেস্ক
শিক্ষার্থীদের যাতায়াত, থাকা নিয়ে অনিশ্চয়তা, অর্থ ব্যয়সহ বিভিন্ন ভোগান্তি লাঘবের জন্য এ বছর প্রথমবারের মতো গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেন দেশের ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য- এই তিন ইউনিটের মধ্যে প্রথম দুটির পরীক্ষা ও ফলাফল প্রদান এরই মধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। তবে হঠাৎ করে বিভাগ পরিবর্তন ইউনিট না রাখার সিদ্ধান্ত, ফি বাড়িয়ে দ্বিগুণের অধিক করা, পরীক্ষা কেন্দ্র অনেকের নিজ এলাকায় না পড়া, কর্মদিবসে পরীক্ষা, ফলাফলে অসামঞ্জস্য এবং অভিযোগ গ্রহণের নির্দিষ্ট জায়গা না থাকায় এ পরীক্ষা নতুন করে দুর্ভোগ তৈরি করেছে। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের অনেকরই অভিযোগ- পরীক্ষা গ্রহণ থেকে ফলাফল পর্যন্ত পদে পদে তারা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন।
অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যাতায়াতসহ অন্যান্য ভোগান্তি লাঘব হবে ভেবে তারা গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরীক্ষার প্রস্তুতির দীর্ঘদিন পর সিদ্ধান্ত হয় বিভাগ পরিবর্তন ইউনিট থাকবে না। তখন শিক্ষার্থীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ বিভিন্ন জায়গায় মানববন্ধন করেন। তবে সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। এরপর পরীক্ষা দেওয়ার জন্য প্রাথমিক ও চূড়ান্ত ধাপে ফলাফল নির্দিষ্ট শর্ত দেওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী বাদ পড়ে যান।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, পৃথকভাবে পরীক্ষা হলে একই ফলাফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা যেত। কিন্তু গুচ্ছ পদ্ধতির কারণে তারা সে সুযোগ পাননি। এ কারণে উপাচার্যদের গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটি পরীক্ষার প্রাথমিক আবেদনে ৮-১০ লাখ আবেদন প্রত্যাশা করলেও তিন বিভাগ মিলে সাড়ে ৩ লাখের মতো পড়ে।
এরপর গুচ্ছের চূড়ান্ত আবেদনে পরীক্ষার ফি বাড়ানো হলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে ৫০০ টাকা ফি নেওয়ার কথা বলা হলেও পরে ১০০ টাকা বাড়ানো হয়। সর্বশেষ ২১ আগস্ট উপাচার্যদের মিটিংয়ে আরও ৬০০ টাকা বৃদ্ধি করে মোট ১২০০ টাকা করা হয়। অভিভাবকরা তখন ব্যয় হ্রাসের পরীক্ষায় দফায় দফায় ফি বৃদ্ধি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
ভর্তি হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা জানান, প্রথমে আয়োজক কমিটি থেকে বলা হয়, রংপুরের শিক্ষার্থী রংপুরের ভেতরে বা পাশের বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে পারবে। কিন্তু কেন্দ্র পছন্দ দেওয়ার পরও রংপুর, চট্টগ্রাম, বরিশাল কিংবা সিলেটের শিক্ষার্থীর পরীক্ষা ঢাকায়, ঢাকার শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বাইরে এমন দেখা যায়। এছাড়া পরীক্ষা ছুটির দিনে না পড়ে কর্মদিবসে পড়ায় চাকরিজীবী অভিভাবকদের ভোগান্তি ও যাতায়াতে সমস্যায় পড়তে হয়।
গত ২৪ অক্টোবর গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের পরীক্ষার পর ২৬ অক্টোবর বিকেল ৫টায় ফল প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ফল নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অভিযোগ, তাদের দেওয়া উত্তরের সঙ্গে ফলাফলের মিল নেই। তারা যে ক’টি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন, ফলাফলে উত্তরের সংখ্যা কারও বেশি কারও কম। এতে কেউ উত্তরের থেকে বেশি নম্বর, আবার কেউ কম নম্বর পেয়েছেন।
পরে সেদিন রাতেই ওয়েবসাইটে টেকনিক্যাল সমস্যা বলে ফলাফল প্রকাশ বন্ধ রেখে পরে নতুন করে সংশোধিত ফল প্রকাশ করা হয়। সংশোধিত ফলেও শিক্ষার্থীদের সমস্যা কাটেনি বলে ফল বাতিল চান তারা। কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভে এসে ক্ষোভে পরীক্ষার প্রবেশপত্র পোড়ান। ইংরেজির ফল বাংলায় আর বাংলার ফল ইংরেজিতে প্রকাশ হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
এমন একজন পরীক্ষার্থী রংপুর লায়ন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করা মোহাম্মদ নাহিদ। তিনি জানান, বাংলায় তিনি ৩৪টি প্রশ্নের বৃত্ত ভরাট করেছিলেন। কিন্তু ফলে দেখানো হয় ৩৮টি বৃত্ত ভরাট করা হয়েছে। আবার ইংরেজিতে ৩৩টি প্রশ্নের বৃত্ত ভরাট করলেও ২৩টি দেখানো হয়।
ফেসবুক লাইভে এসে প্রবেশপত্রে আগুন ধরিয়ে এই শিক্ষার্থী বলেন, এ রকম ফলের কোনো মানে হয় না। ওরা আমার ভবিষ্যৎ পুড়িয়েছে। কোন আস্থা আর বিশ্বাসে আমি আবার দ্বিতীয়বার ফলের জন্য আবেদন করব? ভেবেছিলাম গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা অনেক স্বচ্ছ হবে। প্রকৃত অর্থে কিছুই হয়নি।
মুন্সীগঞ্জের সরকারি হরগঙ্গা কলেজের সজিব হাসানের ইংরেজির ফলাফল বাংলায় আর বাংলারটা ইংরেজিতে আসে। সংশোধিত ফলাফলে ঠিক হলেও তিনি বলেন, ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির মতো পরীক্ষায় এটা বিরাট ভুল। প্রশ্নপত্রে শব্দগুলো একটা আরেকটার সঙ্গে লাগানো। অনেকে বুঝতে ভুল করেছে। আরও সজাগ হওয়া উচিত ছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন শিক্ষার্থী বলেন, তারা অভিযোগের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে তারা বলেন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানে। আবার তাদের কাছে গেলে তারা বলেন, প্রযুক্তিগত বিষয় ডিজিটাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য বলতে পারবেন। ২০ বিশ্ববিদ্যালয়ের কার কাছে অভিযোগ করা যাবে তা নির্দিষ্ট নয়। হটলাইনে ফোন দিলেও ধরা হয় না।
এদিকে গুচ্ছ পরীক্ষার দিন কেন্দ্র পরিদর্শক হিসেবে থাকা শিক্ষকরা আগের চেয়ে কম সম্মানী পাচ্ছেন জানিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের সভাপতি অধ্যাপক ড. জাকারিয়া মিয়া বলেন, গুচ্ছে যাওয়াটা সে সময় অনেক শিক্ষক মেনে নেননি। কারণ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে যায়নি। এবার ফলাফলসহ অনেক অব্যবস্থাপনা দেখা যাচ্ছে। সামনের বছর থাকবে কিনা এটা পরবর্তীকালে শিক্ষকরা মত দেবেন।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা আয়োজক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দীন আহমেদ উল্টো অভিযোগ করেন, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার বিরুদ্ধে একটি চক্রান্ত কাজ করছে।
তিনি দাবি করেন, ‘বি’ ইউনিটের ফলাফলে সাইবার হ্যাকাররা সমস্যা করেছিল। তবে রেজাল্ট ওলটপালটের যে অভিযোগ তা ঠিক করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের নিজ এলাকায় কেন্দ্র না পড়ার অভিযোগ স্বীকার করেন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দীন। তিনি বলেন, দূরের কেন্দ্রে মাত্র ২ শতাংশ শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিয়েছে। আমাদের প্রথম গুচ্ছ পরীক্ষা। কিছু ভুল থাকতে পারে। আগামীতে সেগুলো সংশোধন করা হবে।সৌজন্যে-সমকাল
Discussion about this post