অনলাইন ডেস্ক
প্রায় ২০ বছর আগে পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। এরপরও বন্ধ হয়নি ক্ষতিকর পলিথিনের ব্যবহার। ফুটপাত থেকে শুরু করে শপিং মলে অবাধে চলছে এর ব্যবহার। কাঁচাবাজারে সামান্য কাঁচা মরিচ কিনলেও সঙ্গে মেলে ছোট ও পাতলা পলিথিন ব্যাগ। খাবারের হোটেল, চাল, ডাল, মাছ, মাংস থেকে শুরু করে সবজি বেচাকেনায় ব্যবহৃত হচ্ছে পলিথিন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘বৈধ’ পলিথিন যারা উৎপাদন করেন তাদের কারখানায়ই উৎপাদিত হয় অবৈধ পলিথিন।
বৈধ পলিথিনের সংজ্ঞা কী—খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, ৫৫ মাইক্রন পুরত্বের নিচে সব পলিথিন অবৈধ বিবেচনা করা হয়। তবে ৫৫ মাইক্রনের বেশি পলিথিন উৎপাদন করা হয় বিভিন্ন প্যাকেজিং কাজে ব্যবহার করার জন্য। কিন্তু শর্ত হচ্ছে, সেটি কী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে তা উল্লেখ করতে হবে।
রাজধানীর লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর এলাকায় এমন প্লাস্টিকের কারখানা আছে প্রায় কয়েকশ’। লালবাগের চান্দিরঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুরোটাই প্লাস্টিক উৎপাদনের কারখানায় ভরপুর। এখানে যেমন ‘বৈধ’ পলিথিন উৎপাদিত হয় তেমনই অনেকটা প্রকাশ্যেই চলে অবৈধ পলিথিনের উৎপাদন ও বিক্রি। এই এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পুরো এলাকায় কারখানা আছে অন্তত ৫০-৬০টি। তবে পলিথিন ব্যাগ কিনতে চাইলে খুঁজতে হয় এজেন্টকে। যার কাছে থাকে সব কোয়ালিটির পলিথিনের তথ্য। আবার যারা পরিচিত তারা কোয়ালিটির খোঁজ করেই চলে আসেন এই এলাকায়।
চান্দিরঘাট এলাকার একজন দোকানদারের কাছে অতিরিক্ত পরিমাণে পলিথিন কিনতে চাইলে প্রথমেই তিনি জানতে চান, ‘কোয়ালিটি কার? যার কোয়ালিটি লাগবে সেখানেই পৌঁছে দেবো।’ যে ধরনের কোয়ালিটি লাগবে সেটাই পাওয়া যাবে বলে আশ্বস্ত করেন তিনি।
শুধু রাজধানীতে ব্যবহৃত পলিথিন ব্যাগ থেকে উৎপাদিত মোট বর্জ্য প্রায় পাঁচ হাজার ৯৯৬ টন। সারাদেশে এটি প্রায় ৭৮ হাজার ৪৩৩ টন। আর অবৈধ পলিথিন ব্যাগের দৈনিক উৎপাদন ৫০ লাখ বেড়ে গেছে বলে জানা গেছে সমীক্ষায়। গত জুন মাসে বেসরকারি সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডো) এক সমীক্ষায় এই হিসাব উঠে এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশজুড়ে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির প্রায় এক হাজার ২০০ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পুরান ঢাকার অলিগলিতে রয়েছে অন্তত ৩০০ কারখানা। কেরানীগঞ্জ, জিঞ্জিরা, কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর, কাওরান বাজার, তেজগাঁও, দক্ষিণখান, টঙ্গীতে ছোট-বড় বেশ কিছু কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা থেকে সারাদেশে সরবরাহ করা হয় পলিথিন।
বাংলাদেশে ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর প্রেক্ষিতে পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন এবং পরিবহন নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনও ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিনসামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হতে পারে। সেইসঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়।
পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, পলিথিনের ব্যাগ উৎপাদন নিষিদ্ধ করলেও ৫৫ মাইক্রনের অধিক পলিথিনজাতীয় পণ্য বা মোড়ক উৎপাদনের অনুমোদন আছে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনুমোদিত কাঁচামাল আমদানি করেই নিষিদ্ধ পলিথিন উৎপাদন হচ্ছে। অনুমোদিত কারখানার মালিকরা ছোট কারখানাগুলোর কাছে কাঁচামাল বিক্রি করছে। এছাড়া বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য তৈরির পর উচ্ছিষ্ট কাঁচামাল রিসাইকেল করে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ তৈরি হচ্ছে।
বিভিন্ন সময়ে নিষিদ্ধ এই পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হলেও করোনার কারণে তা থেমে যায়। আর তাতে বেড়ে যায় পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার–এমনটাই মনে করেন কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পরিবেশ অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা জানান, মনিটরিংয়ে দুর্বলতা থাকতে পারে। লোকবল একটা কারণ। তাছাড়া দূষণ তো শুধু পলিথিনের কারণে হচ্ছে না। পরিবেশ দূষণের অনেক কারণ আছে, যেমন: ইটভাটা, কারখানা, কেমিক্যাল, ব্যাটারি। পলিথিনের পাশাপাশি সেগুলোও মনিটরিং করতে হয়।
পলিথিনের বিরুদ্ধে অভিযানে চালিয়ে কেন বন্ধ করা যাচ্ছে না—জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সিনিয়র সহকারী সচিব কাজী তামজিদ আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে বন্ধ হচ্ছে কিনা সেটি তদারকি করা অধিদফতরের কাজ। আমাদের কাজ অভিযান পরিচালনা করা, জরিমানা করা। আমাদের কাছে অভিযোগ দেওয়া হলে অভিযোগকারীর কথা অনুযায়ী অভিযান পরিচালনা করি। মনিটরিং যারা করেন তাদের তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অভিযান পরিচালনা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘অভিযানের সময় আমরা প্রায়ই দেখি যে, এক ধরনের অনুমোদন নিয়ে আরেক ধরনের কাজ করা হচ্ছে। যখন তাদের অনুমোদন নবায়ন করা হয় তখন আমরা দেখি আসলে তারা কী ধরনের প্রোডাক্ট তৈরি করছে? আমাদের আকস্মিক পরিদর্শন কিংবা মোবাইল কোর্টে ধরা পড়লে তারা শাস্তির আওতায় আসে। পলিথিন ৫৫ মাইক্রনের নিচে সবই অবৈধ, ৫৫ মাইক্রনের ওপরে কিছু আছে যেগুলো মাছের পোনা কিংবা গার্মেন্টস রফতানির কাজে ব্যবহৃত হয়।’
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কেয়া খান বলেন, ‘২০০২ সালে আইন করে প্লাস্টিক ব্যবহার বন্ধ করা হয়। যদিও বিভিন্ন সময় তা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি, তবে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধ করার জন্য সরকার নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এছাড়া আমাদের প্লাস্টিক রিসাইকেল কমানো এবং প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে নানা অ্যাকশন প্ল্যান নেওয়া হয়েছে প্লাস্টিক বন্ধে।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নির্বাহী সহ-সভাপতি ড. মো. আব্দুল মতিন বলেন, ‘২০ বছর হয়ে গেলো তবুও পলিথিন বন্ধ করা যায়নি। বিকল্পের কথা সরকার বলে। পলিথিনের বিকল্প পাট, সেটা চালু করতে কি ২০ বছর সময় লাগে? প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের পাটের দেশ। কতবার বলা হয়েছে পাটের ব্যাগ বানাতে। মূল বিষয় হচ্ছে পলিথিন ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হোক, এটা সরকার চায় না।’
‘অনেক সিদ্ধান্ত ব্যবসায়ীদের বিপক্ষে যায়, সেগুলো বাস্তবায়ন করতে চায় না সরকার। ব্যবসায়ীদের কাছে সরকারের দুর্বলতা এই পলিথিন দিয়ে বুঝা যায়। জনগণের স্বার্থে সরকারকে শক্ত অবস্থান নিতে হবে,’ বলেন বাপা নির্বাহী সহ-সভাপতি।
সর্বশেষ গত বছরের জানুয়ারিতে পলিথিন ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক (ওয়ান টাইম) পণ্যের ব্যবহার বন্ধে ব্যবস্থা নিতে এক বছর সময় বেঁধে দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত।
এক বছরের মধ্যে দেশের উপকূলীয় এলাকায় পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগ এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার, বহন, বিক্রি ও বাজারজাতকরণ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে আইন অনুসারে নিষিদ্ধ পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার বন্ধের বিষয়টি কঠোরভাবে কার্যকর করতে বাজার তদারকি, উৎপাদন, কারখানা বন্ধ ও যন্ত্রপাতি জব্দ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। পলিথিন বা প্লাস্টিক ব্যাগ ও একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক পণ্যের যত্রতত্র ব্যবহার, উৎপাদন ও বিক্রির বৈধতা নিয়ে ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতিসহ (বেলা) ১১টি সংগঠন ওই রিট করেছিল। সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post