অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন
শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। শিক্ষাবিদরা দীর্ঘদিন যাবত দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় বেশকিছু মৌলিক পরিবর্তনের কথা বলছেন। আশার দিক হলো, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর ঘোষণা এসেছে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে। শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি সুন্দর ও ইতিবাচক বদল আসতে চলেছে, যা প্রত্যেক সচেতন নাগরিকের জন্য আনন্দের সংবাদ। এই ইতিবাচক পরিবর্তন হলো, মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ বিভাজন উঠিয়ে নেয়া হচ্ছে।
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় নবম শ্রেণীতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থীকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়- সে বিজ্ঞান, মানবিক না বাণিজ্য বিভাগ বেছে নেবে। তবে প্রকৃত অর্থে স্কুলগুলোতে বিভাগ বাছাইয়ের পদ্ধতি আরও সেকেলে। সেখানে অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের বিগত বছরের ফল অনুযায়ী তাদের ওপর বিভাগ চাপিয়ে দেয়া হয়। অপেক্ষাকৃত কম নম্বর বা ফলধারী শিক্ষার্থী আগ্রহ থাকলেও অনেক সময় বিজ্ঞান বিষয়ে পড়তে পারে না। আবার নবম শ্রেণীর প্রথম স্থান অর্জন করা শিক্ষার্থী আগ্রহ থাকলেও মানবিক বিষয়ে পড়লে বিদ্যালয় ও পরিবার থেকে মনে করা হয়- ওই শিক্ষার্থীর বুঝি সর্বনাশ হলো। শিক্ষার্থীর আগ্রহের চেয়ে এখানে মূল্যায়ন করা হয় সামাজিক মানদ-, লোকে কি বলবে এসব বিষয়। নম্বরের হেরফেরের কারণে বিভাগ বিভাজনের সময় মোটা দাগে শিক্ষার্থীর পছন্দ হয় উপেক্ষিত। শিক্ষক ও অভিভাবকের পছন্দানুযায়ী শিক্ষার্থীকে বিভাগ পছন্দ করতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। বাধাগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনের উদ্ভাবনী চিন্তার পথ। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর হলে এই সমস্যার একটি টেকসই সমাধান আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। একীভূত শিক্ষাক্রমে নবম-দশম শ্রেণীতে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক সিলেবাস, যে কৌশলে পড়ানো হবে, আমাদের প্রত্যাশা- তা আমাদের জাতির প্রগতির ও উন্নয়নের গতিধারায় বৈপ্লবিক ভূমিকা রাখবে।
শিক্ষা একমুখীকরণ
নতুন এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়িত হলে সব শিক্ষার্থীকেই দশটি বিষয় পড়তে হবে। সবার জন্য বরাদ্দকৃত বিষয়গুলোর মধ্যে থাকবে বিজ্ঞান, মানবিক ও তথ্য-প্রযুক্তিসহ প্রয়োজনীয় পাঠ্যসূচীর কাঠামোগত সমন্বয়। শিক্ষা ব্যবস্থায় এই পরিবর্তনের ফলে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের বইয়ের বোঝা কমবে, অতিরিক্ত সিলেবাসের চাপ থাকবে না, বাড়বে স্বাধীনভাবে চিন্তা-ভাবনা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার সুযোগ। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান, মানবিক তথ্য-প্রযুক্তিসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ের ধারণা পাবে। উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে তারা নির্দিষ্ট একটি বিভাগ পছন্দ করতে পারবে। ফলে শিক্ষার্থীরা সামগ্রিক বিষয়ে দক্ষ হয়ে উঠবে। মানসম্মত শিক্ষার পথে এই একীভূতকরণ হবে যুগান্তকারী। শিক্ষার এই একমুখীকরণ উদ্যোগ বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আরও সংহত ও সুগঠিত করবে। আমাদের দেশে স্কুল, ইংরেজী মিডিয়াম ও মাদ্রাসাসহ নানা ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে- এগুলো এক সময় একমুখী হবে। শিক্ষামন্ত্রীর কথায় সে আভাস পাওয়া যায়। ‘আমাদের এত ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যদিও আমরা চেষ্টা করছি সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যদি মৌলিক বিষয়গুলো রাখতে পারি, সেটি এক ধরনের একমুখী শিক্ষার দিকে যাওয়ার একটি পথ তৈরি হবে।’ শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একবারে মৌলিক বিষয় ভাষা, বিজ্ঞান, গণিত, ইতিহাস ও তথ্য-প্রযুক্তি ধরনের বিষয়গুলোকে যদি আমরা পড়াতে পারি, তা হলে এক ধরনের একমুখী শিক্ষার দিকে যাওয়ার একটি পথ তৈরি হলো। আমরা বলতে পারব, মৌলিক বিষয়গুলো শিখছে শিক্ষার্থীরা।’ [সূত্র : বাংলা ট্রিবিউন]
মানসম্মত শিক্ষার সহায়ক
শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড- বহুল প্রচলিত প্রবাদ। ব্যক্তি পর্যায় থেকে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে শিক্ষা। একটি জাতির জন্য মানসম্মত ও যুগোপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা খুব জরুরী। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের নবম-দশম শ্রেণীতে একই বিষয়ে পড়ানো হবে। এখানে সব বিষয়ের গুরুত্ব সমানভাবে প্রাধান্য পাবে। যাতে শিক্ষার্থীরা সকল বিষয়ের মৌলিক ও প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন করতে পারে এবং দক্ষতা অর্জনের পথে পরবর্তী জীবনে অগ্রসর হতে পারে। চলমান শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাজন হওয়ায় শিক্ষার্থীরা অন্য বিষয়গুলো সম্পর্কে ভাল ধারণা না পেয়েই উচ্চ মাধ্যমিক ও পরবর্তীতে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করছে। ফলে তাদের মধ্যে সামগ্রিক বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞান ও দক্ষতার ঘাটতি থাকছে। বর্তমান পদ্ধতিতে নবম-দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞান বিভাগের পড়ুয়ারা সমাজবিজ্ঞান এবং মানবিকের ছাত্ররা সাধারণ বিজ্ঞান পড়লেও তা ন্যূনতম জ্ঞান ও দক্ষতা তৈরিতে যথেষ্ট নয় বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি নির্দিষ্ট বিভাগের শিক্ষার্থীরা অন্য বিভাগ সংশ্লিষ্ট বিষয়টি দায়সারাভাবে সম্পন্ন করছে পরীক্ষার বৈতরণী পার হওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মাঝে হয়ত এই ভাবনা কাজ করে যে, ভবিষ্যতে আমার শিক্ষা জীবনে এই বিষয়টি তেমন কাজে আসবে না। যার ফলে সামগ্রবাদী দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন (Holistic Approach) হয় বাধাগ্রস্ত ।
একমুখী শিক্ষা যুগোপযোগী
বর্তমান বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে শিক্ষার যুগোপযোগীকরণ ও হালনাগাদ করার বিকল্প নেই। উন্নত দেশগুলোতে নিয়মিতভাবে শিক্ষার সংস্কার চলে। এখন ঘরের ভেতরে ও বাইরে প্রায় সব ক্ষেত্রেই প্রযুক্তির সহায়তা নেয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এমন একটি প্রেক্ষাপটে শুধু বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা তথ্য-প্রযুক্তি পড়বে, এমনটি হওয়া কাম্য নয়। আবার বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা ভূগোল, ইতিহাস, মানবিক মূল্যবোধ, সুশাসনের ধারণা পাবে না, এটিও সমীচীন নয়। নতুন প্রজন্মকে জ্ঞান, বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তির পাশাপাশি মানবিক গুণাবলীতেও পরিপূর্ণ করতে হবে। যা নতুন শিক্ষাক্রমের বিশেষত্ব। চলমান এই সংস্কার যুগোপযোগী শিক্ষার পথ উন্নত, মসৃণ ও সময়োপযোগী করতে ভূমিকা রাখবে। আমাদের নতুন প্রজন্মকে গুণগত ও মানসম্পন্ন শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে। যাতে করে তারা দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত হয়ে প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে পারে।
শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক
শিক্ষানীতি-২০১০ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি শিক্ষানীতি। এই শিক্ষানীতিতে শিক্ষায় বৈষম্য কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। অথচ এতদিন ধরে আমরা দেখেছি, ১৪ বছর বয়সের একজন শিক্ষার্থী নবম-দশম শ্রেণীতে বিজ্ঞান, মানবিক বা বাণিজ্য নিয়ে পড়ার কারণে অন্য বিভাগের বিষয়গুলোর নির্যাস থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে বৈচিত্র্যময় ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ তাদের আর থাকছে না। বিজ্ঞান বিভাগের প্রতি শিক্ষক ও অভিভাবকদের পক্ষপাত থাকায় শ্রেণীকক্ষের প্রথম দিকের শিক্ষার্থীদের সে বিষয়ে পড়ার জন্য চাপ থাকে। অন্যদিকে অনেক বিদ্যালয়ে দেখা যায়, মানবিক ও বাণিজ্যে যারা পড়াশোনা করে, তাদের প্রতি যত্নের মাত্রা কিছুটা কম থাকে। অর্থাৎ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও অভিভাবক যদি পূর্ব অনুমেয় চিন্তা-ভাবনা দ্বারা বন্দী হয়ে থাকেন, তবে তা শিক্ষার্থীদের জন্য ক্ষতিকর হতে বাধ্য। নতুন শিক্ষাক্রমে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে কথিত বৈষম্যের সম্ভাবনা থাকছে না। যা শিক্ষার্থীদের জন্য মানসিক স্বস্তি ও আস্থা নিশ্চিত করবে। এই শিক্ষাক্রমের ফলে শিক্ষনীতি-২০১০ একটি বাস্তবিক ও পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করবে।
শিখনভিত্তিক শিক্ষা
বিগত দিনগুলোতে আমরা দেখেছি, বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জটিল সব সমীকরণ ও সূত্র মুখস্থ করতে হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে হাতে-কলমে শিক্ষা ও শেখার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ বিভাজন তুলে দিয়ে অভিন্ন কারিকুলামে পড়ানোর কথা বলা হয়েছে। যেখানে সব শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞানের একটি বিষয় পড়ানো হবে। বর্তমানে যেখানে বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক তিনটি বিষয় পড়ানো হয়। বর্তমান শিক্ষাক্রমে যেখানে মুখস্থ করার প্রবণতা রয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীরা একটি বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ ধারণা লাভ করবে। ফলে মুখস্থ করার প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে। সনদসর্বস্ব শিক্ষা থেকে বেরিয়ে আসার একটি কার্যকর উপায় হতে পারে এই নতুন পদ্ধতি। তবে নতুন শিক্ষাক্রমে বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর গুরুত্ব অক্ষুণ্ণ রেখেই তা কার্যকর করা হবে।
বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভাগ বিভাজন হওয়ায় একজন শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিকে অন্য বিভাগের বিষয়গুলো আর পড়তে পারে না। নতুন এই পাঠ্যক্রমে এখন শিক্ষার্থীরা উচ্চ মাধ্যমিকে গিয়ে বিজ্ঞান বিভাগ বেছে নিলেও সঙ্গে অর্থনীতিসহ অন্যান্য বিভাগসংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ও পড়তে পারবে। একীভূত শিক্ষাক্রমের বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এর ছোট ইতিবাচক বিষয়গুলো একসঙ্গে বড় সুফল বয়ে আনবে; যা পুরো শিক্ষা ব্যবস্থায় কাক্সিক্ষত পরিবর্তন সাধনে ভূমিকা রাখবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার আমাদের যে সম্মিলিত প্রয়াস, তার গতি এই শিক্ষাক্রমের দ্বারা বাস্তবায়িত হবে।
লেখক : অধ্যাপক, বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তিবিদ; সদস্য বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), পরিচালক বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন
Discussion about this post