ড. নিয়াজ আহম্মেদ
দেশের নবীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটু একটু করে এগোচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকের বয়স এক দশকেরও বেশি। কিন্তু বয়সের তুলনায় শিক্ষার মানের অনেক তফাত। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মানের সঙ্গে তার ভৌত অবকাঠামো, শিক্ষণ যন্ত্রপাতি, দক্ষ নেতৃত্ব এবং সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞ ও সিনিয়র শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখন সরকারের বরাদ্দও অনেক বেড়েছে; কিন্তু বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করার মতো সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। রাতারাতি একটি ভবন নির্মাণ করা সম্ভব নয়; কিন্তু দক্ষতা ও ভালো পরিকল্পনা থাকলে অবশ্যই নির্দিষ্ট সময়ে ভবন নির্মাণ করা যায়।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে শিক্ষক নিয়োগপ্রক্রিয়া ভিন্ন। ভালো শিক্ষক ও গবেষককে তারা অধিক বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে নিয়ে আসে। এতে লাভবান হয় শিক্ষার্থী এবং নবীন শিক্ষকরাও। আমাদের বাস্তবতা হলো, এখন ভালো ছেলেমেয়েরা এমনিতেই শিক্ষক হতে চান না। কেননা শিক্ষকদের বেতন ছাড়া অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে। একটি সুবিধা এখন পর্যন্ত রয়েছে, তা হলো দ্রুত উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করলে কম সময়ে অধ্যাপক হওয়া যায়। বেতন বাড়ে এই যা। ভালো গবেষকদের গবেষণা করে আয় করার একটি সুযোগ থাকে; কিন্তু তা-ও পর্যাপ্ত নয়। সুযোগ-সুবিধা যা-ই থাকুক না কেন, এখনো কিছু মানুষের ইচ্ছা থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার; কিন্তু তাঁদের সেই সুযোগ তৈরি করে দেওয়ার কাজ বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে খুঁজে সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে আসতে পারে কিন্তু কর্তৃপক্ষ যদি কাউকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে, তাহলে হওয়ার নয়।
বাংলাদেশের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কৃষি, জাহাঙ্গীনগর, বুয়েট, ইসলামী এবং নব্বইয়ে শাবিপ্রবি এবং খুলনা। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি প্রায় শুরু থেকে কাজ করে আসছি এবং আমি দেখেছি প্রতিটি বিভাগে একজন সিনিয়র অধ্যাপক নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের বড় বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা গবেষণাপ্রতিষ্ঠান থেকে আনা হয়। আজকে শাবিপ্রবি এই জায়গায় আসার পেছনের কারিগর ছিলেন তাঁরাই। তেমনি আমার জানামতে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় নবীন হলেও ঠিক একই কাজ তাঁরা করেছেন। আমার বিশ্বাস, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অনেক এগিয়ে গেছে। কিন্তু তাদের সমসাময়িক অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, তারা এখনো অনেক পিছিয়ে। ভাবা যায় এক দশক অতিক্রম করার পরও একটি বিশ্ববিদ্যালয় চলছে একজন অধ্যাপক দিয়ে। এমনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পাবেন, যেখানে কোনো অধ্যাপক নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান করানোর জন্য বিভিন্ন নীতিমালা প্রণয়ন করতে হয়। আনুষঙ্গিক অনেক কাজ রয়েছে, যা সব সময় নবীন শিক্ষকদের দিয়ে করা সম্ভব হয় না। কাজেই অধ্যাপক পদে সিনিয়রদের আকৃষ্ট করতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সামনে হয়তো এগোতে পারবে কিন্তু অনেক সময় লাগবে। নবীন সহকর্মীদের ভাবতে হবে তাঁরাই শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ নন। তাঁদের মাথার ওপর ছায়া হিসেবে এক বা একাধিক প্রবীণ শিক্ষক দরকার। তাঁদের কাছে অনেক কিছু শেখার আছে। এমন নয় যে আমার পদোন্নতি সিনিয়র শিক্ষকদের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কিভাবে সিনিয়র শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতে পারি। ইউজিসি কর্তৃক প্রস্তাবিত সমন্বিত নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালা নিঃসন্দেহে মানসম্মত; কিন্তু কার্যকর করতে হলে শিক্ষকদের পৃথক বেতন স্কেল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো দরকার। তা না হলে আমার বিশ্বাস, সিনিয়র কেন নবীনদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আকৃষ্ট করা দুরূহ হয়ে দেখা দেবে। বিদ্যমান নীতিমালা পৃথক পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন, যেখানে সিনিয়র শিক্ষকদের আকৃষ্ট করার সুযোগ নেই, বরং তাঁদের নিরুৎসাহ করা হয়। ফলে কারো ইচ্ছা থাকলেও উচ্চপদে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করতে পারেন না। এখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং নবীনদের মধ্যে ভিন্ন মনোভাব হয়তো কাজ করে। বিশ্ববিদ্যালয় একটি উদার জায়গা। এখানে প্রত্যেকে প্রত্যেকের কাছ থেকে শেখেন। কাজেই ভিন্ন মনোভাবের কোনো সুযোগ নেই; বরং পুরনোদের অভিজ্ঞতায় নবীনদের শাণিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণের কোনো সুযোগ নেই। সবে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আইকিউএসির মাধ্যমে নবীন শিক্ষকদের কিছু কিছু প্রশিক্ষণ দিচ্ছে; কিন্তু নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে তা-ও সম্ভব হয়ে উঠছে না।
আমাদের সরকারও চাচ্ছে পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন নতুন করে আর বিভাগ না খুলুক। নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্রুত সামনে এগিয়ে যাক। নতুন নতুন বিভাগ খুলে বেশি শিক্ষার্থী নিয়ে মুখরিত হোক ক্যাম্পাস। কিন্তু তার জন্য সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনেক করণীয় রয়েছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের বয়স ৩০ বছরের বেশি। এখানে দুই শর অধিক অধ্যাপক রয়েছেন। আজকে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স ১০ বছর, আগামী ৩০ বছরে আমরা সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঁচ শর অধিক অধ্যাপক দেখতে চাই। এর জন্য দক্ষ নেতৃত্ব যেমন দরকার, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি প্রত্যেকের মমতাও থাকা দরকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের কিসে ভালো হবে তার জন্য নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা চিন্তা না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থ ও এর গুণগত মানের প্রতি নজর দিতে হবে। একজন ভালো অধ্যাপক পাওয়া গেলে তাঁকে বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আকৃষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে ডেপুটেশন কিংবা লিয়েনের মতো বিষয় প্রবর্তন ও সহজ করা দরকার। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারের উদার মনোভাব প্রদর্শন করতে হবে। অন্যদিকেও বেশি মনোযোগ দিতে হবে। নবীন শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে উৎসাহিত করা। নতুনদের যত দ্রুত সম্ভব উচ্চশিক্ষায় গমন করা উচিত। কেননা তাঁদের মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতে হবে উচ্চশিক্ষার বিকল্প নেই। যত দ্রুত তাঁরা এ কাজটি করবেন তত দ্রুত নিজেদের পেশাগত উন্নয়ন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন হবে। যার প্রভাব পড়বে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগত মানের ওপর। আমাদের জোর দাবি, নবীন শিক্ষকদের উচ্চশিক্ষার জন্য সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বৃত্তির ব্যবস্থা করা, যাতে তাঁদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণ সহজ হয়। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন অর্ধশত। এদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ বয়সে নবীন। আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ নতুনগুলোর গুণগত মান উন্নত করা। কেননা কিছু কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে তাদের সঙ্গে টিকে থাকতে হলে আমাদের অনেক কিছু করতে হবে। ভাবতে হবে কিভাবে আমরা একেকটি বিশ্ববিদ্যালয়কে গুণগত শিক্ষার দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি। আমরা মনে-প্রাণে গুণগত মানের উন্নতি চাই।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post