মো. আনোয়ারুল ইসলাম ভূঁঞা
আজ ১১ নভেম্বর স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রসৈনিক, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা এবং ভাষা আন্দোলনের সূচনা সৈনিক সাবেক প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য জাতীয় বীর মেজর এম এ গণির ৬৫তম মৃত্যুদিবস। বাঙালি জাতির অস্তিত্ব নির্মাণে, বাঙালির আত্মজাগরণ ও জাতির সমর-সত্তার বিকাশে মেজর আবদুল গণির কীর্তি ও অবদান অবিস্মরণীয়। ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে তিনি জাতির অন্যতম ত্রাতা হিসাবে আবির্ভূত হয়েছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বাঙালি সৈন্যদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে মেজর গণি তৎকালীন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল স্যার মেসারভিকে এক আবেদনপত্রে বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে একটি আলাদা রেজিমেন্ট গঠনের দাবি উপস্থাপন করেন।
তার এই যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়ে সে সময় স্যার মেসারভি মেজর গণির এ দাবি বাস্তবায়নে সহায়তা করেছিলেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাঁজা নাজিমউদ্দিনের কাছেও মেজর গণি বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। অক্লান্ত পরিশ্রম শেষে মেজর গণি ১৯৪৮ সালের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অগ্রযাত্রা শুরু করেন।
মেজর আবদুর গণির জন্ম ১৯১৫ সালের ১ ডিসেম্বর কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নাগাইশ গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। ১৯৪১ সালে মেজর গণি যোগ দেন ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর পাইনিয়র কোরে কমিশন্ড অফিসার হিসাবে। মেজর গণি একজন সাহসী অফিসার ছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তিনি অসম সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করেন। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠার দিন কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে এক চা চক্রে তদানীন্তর জিওসি ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের উর্দু ভাষায় কথা বলার নির্দেশ দিলে মেজর গণি তীব্র প্রতিবাদ করে বলেন, পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলতে পারলে বাঙালি সেন্যরা বাংলা ভাষাতেই কথা বলবে।
তিনি সেদিন যে দৃঢ়তা ও সাহসিকতার স্বাক্ষর রেখেছিলেন তা ইতিহাসে বিরল। ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বেঙ্গল রেজিমেন্টের মাধ্যমেই মেজর গণি মূলত ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন। সুতরাং তিনি শুধু একজন সেনা অফিসার ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন বায়ান্নর মহান ভাষা আন্দোলনের একজন অগ্রনায়ক।
সারা দেশ থেকে তরুণদের নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি এই রেজিমেন্ট গঠন করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়ে এবং রেডিওতে কথিকার মাধ্যমে তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেওয়ার জন্য তরুণদের উদ্বুদ্ধ করতেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও জওয়ানরা ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে এবং একাত্তরে স্বাধীনতার সংগ্রামে অবিস্মরণীয় বীরত্বের পরিচয় দেন।
মেজর এম এ গণি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ কুর্মিটোলায় পাকিস্তানের বড়লাট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সম্মানে এমন এক ও সুশৃঙ্খল কুচকাওয়াজের আয়োজন করে, যা দেখে তিনি মুগ্ধ ও অভিভূত হন। আবেগাপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, ‘এত অল্প সময়ের মধ্যে তোমরা যে উন্নতি করেছ, তা দেখে আমি অভিভূত হয়েছি। এই উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে তোমরা যদি কাজ করে চলো, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সৈনিক হিসাবে তোমরা অদ্বিতীয় হবে।’
জিন্নাহর সেই বিশ্বাসের প্রমাণ রেখেছিল সেদিনের জন্ম নেওয়া প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে। ওই যুদ্ধে একটিমাত্র ব্যাটালিয়ান ভারতের একটি ডিভিশন আক্রমণ প্রতিহত করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সব ইউনিটের চেয়ে সর্বাধিক শৌর্য, বীর্য, সাহসিকতা, বীরত্ব ও আত্মত্যাগের ইতিহাস ও উদাহরণ সৃষ্টি করে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
‘সিনিয়র টাইগার্স’ সে যুদ্ধে সর্বোচ্চ বারোটি জাতীয় বীরত্ব খেতাব অর্জন করে, যার মধ্যে ছিল তিনটি ‘সিতারা-ই-জুরাত, সাতটি ‘তঘমা-ই-জুরাত’, একটি ‘ইমতিয়াজ সনদ’ ও একটি ‘তঘমা-ই-বাসালাত’। এতগুলো জাতীয় খেতাব পাকিস্তানের অন্য কোনো পাল্টুনের ভাগ্যে জোটেনি। এ যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি মুসলমানরা বিশ্বের বুকে নিজেদের ‘মার্শাল রেস’ হিসাবে পরিচিত করে।
মাত্র ৪২ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে এবং ১০ বছরের অতি সংক্ষিপ্ত সামরিক চাকরিতে এবং ৪ বছরের রাজনৈতিক পরিসরে তিনি দেশ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করে ইতিহাসের পাতাকে রাঙিয়েছেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠার পর তিনি যে স্বস্তি পেয়েছিলেন তা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ পাকিস্তানি শাসকরা তার পদোন্নতি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে বঞ্চিত করে রাখে।
তার প্রতিভা, সামরিক সংগঠকের দক্ষতা পাকিস্তানিদের এমনই ভীত-সন্ত্রস্ত করে যে তারা তাকে পদে পদে বাধা দেয়। এতে তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে ১৯৫৩ সালে সামরিক চাকরি থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর মেজর গণি যোগ দেন রাজনীতিতে। জনসেবায় নিজেকে নিয়োগ করেন। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নিজ জেলা কুমিল্লার বুড়িচং নির্বাচনি এলাকা থেকে বিপুল ভোটে আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
স্বতন্ত্র সদস্য হয়েও মেজর গণি ব্যতিক্রর্মী মেধা-মননের জন্য আইন পরিষদে সবার নজর কাড়েন। সংসদে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। তিনি জাতির সমরসত্তার উন্নয়নে প্রতিটি উচ্চবিদ্যালয়ে ছেলেদের সামরিক শিক্ষা প্রবর্তনের প্রস্তাব করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে জার্মানি সফরকালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর একপর্যায়ে মাত্র ৪২ বছর বয়সে ইহকাল ছেড়ে যান এই সাহসী ও সংগ্রামী সৈনিক।
এই বীর সৈনিকের ৬৫তম মৃত্যুদিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া), মেজর গণি পরিষদ ও তার পরিবারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কুমিল্লা সেনানিবাসে তার সমাধিসৌধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানানোর অনুষ্ঠান প্রতিবছর পালিত হয়।
মো. আনোয়ারুল ইসলাম ভূঁঞা : মহাসচিব, মেজর গণি পরিষদ
Discussion about this post