পিয়াস সরকার
প্রভিডেন্ট ফান্ডে ১ লাখ টাকা জমেছিলো মেহরাব আলীর। করোনাকালে সেই টাকাটা ভাঙতে হয়েছে। মেহরাব দিনাজপুর আদর্শ কলেজের শিক্ষক। যোগদান করেন ২০০৮ সালে। করোনার সময় দুর্বিষহ সময় কাটিয়েছেন তিনি। বলেন, কলেজের বেতন, টিউশনি ও কৃষিকাজ করে চলে সংসার।
করোনার সময় প্রথমে কয়েক মাস অর্ধেক বেতন দেয়া হয়। এরপর আর মেলেনি বেতন।
খুবই আর্থিক অনটনের মধ্যে গেছে সময়। প্রভিডেন্ট ফান্ডের লাখখানেক টাকা ছিল। তা বাধ্য হয়ে ভাঙতে হয়েছে। ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তায় আছি। কষ্টের জমানো টাকাটা ভাঙতে হলো। চাকরি শেষে কি করবো?
মেহরাব আলীর মতো ৫৫০০ শিক্ষক পরিবারের জীবন কাটছে নিতান্ত দুর্দশায়। এমপিওভুক্তির আশায় তারা পার করছেন বছরের পর বছর। কারও কারও চাকরির জীবন প্রায় শেষ হওয়ার পথে। কিন্তু পাননি এমপিওভুক্তির সুখবর।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজে বিধি মোতাবেক নিয়োগ পেয়েছিলেন তারা। গোসাইবাড়ি কলেজ, বগুড়া কলেজের শিক্ষক রকিবুল ইসলাম। ২০১৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে যোগদান করা এই শিক্ষক বলেন, অন্যকোনো পেশায় আমরা যেতে পারি না। করোনাকালে জীবন চালাতে খুবই নিম্নমানের কাজ করেছি, যা বলতেও লজ্জা করছে। এই সময়ে আমার এক থেকে দেড় লাখ টাকা ঋণ হয়েছে। আমরা আমাদের দাবির প্রেক্ষিতে আদালতেও গিয়েছিলাম। ২০১৭ সালে আমাদের পক্ষে রায় এসেছে তবুও আমাদের এমপিওবঞ্চিত করা হয়েছে। শর্ট কোর্সের বিষয়ে তিনি বলেন, শর্ট কোর্সের বিষয়টা ভালো। কিন্তু আমাদের তো ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের যেভাবে কাজে লাগানো হবে আমরা সেভাবেই কাজ করবো।
এমপিওপ্রত্যাশী শিক্ষকরা বলছেন, একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়ে সদ্য জাতীয়করণকৃত কলেজের অনার্স-মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষকরা ক্যাডার/নন-ক্যাডারভুক্ত হয়েছেন। অন্যদিকে মাদ্রাসার কামিল (মাস্টার্স) শ্রেণির শিক্ষকরাও এমপিওভুক্ত হয়েছেন। অথচ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকরা এনটিআরসিএ সনদধারী এবং সরকারি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েও জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত না থাকায় এমপিওভুক্ত হতে পারছেন না। সারা দেশের অধিকাংশ কলেজে শিক্ষকরা নামমাত্র বা বেতনহীনভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
তারা বলেন, দীর্ঘ ২১ বছর থেকে আমরা এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন নিবেদন ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসছি। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও জনবলের অজুহাতে অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের যৌক্তিক দাবিটি আলোর মুখ দেখেনি। অথচ বছরে ১৪৪ কোটি টাকা বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ রাখলে ৫৫০০ জন অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করা সম্ভব।
এমপিওভুক্তির দাবিতে মাসব্যাপী আন্দোলনের রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন বঞ্চিত শিক্ষকরা। আজ ও আগামীকাল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আঞ্চলিক কেন্দ্রসমূহের সামনে মানববন্ধন করবেন শিক্ষকরা। এতে পরিচালকের মাধ্যমে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও ইউজিসির চেয়ারম্যানের নিকট স্মারকলিপি প্রেরণ করবেন। নভেম্বর ১৪ থেকে ২৩ তারিখ পর্যন্ত সারা দেশের কলেজ কমিটির পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রীকে দাবি সংবলিত স্মারকলিপি প্রেরণ করা হবে। নভেম্বর ২৪ ও ২৫ তারিখ দেশের সব বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স কলেজে ক্লাস বর্জন করবেন তারা। এ ছাড়াও এমপিওভুক্তির আওতায় না আসা পর্যন্ত কলেজ থেকে শতভাগ বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে অধ্যক্ষদেরকে অনুরোধপত্র প্রদান করবেন। আর ৩০শে নভেম্বর সকাল থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন তারা। যা সুস্পষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত অব্যাহত রাখার কথা জানান তারা।
বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশনের সভাপতি হারুন-অর-রশিদ বলেন, ২৯ বছর ধরে কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনো বেতন-ভাতা দেয়নি, নামমাত্র কিছু সম্মানী দিয়েছে শিক্ষকদের। করোনার শুরু থেকে সেটাও বন্ধ রয়েছে। দীর্ঘদিন থেকে আবেদন-নিবেদন ও আন্দোলন করে বেতন (এমপিও) দাবি করলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের সমাধান করতে পারেনি। এমনকি মনিটরিং করে কার্যকর পদক্ষেপও নেয়নি। শিক্ষকরা আন্দোলনে গেলেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কলেজগুলোকে শতভাগ বেতনের নির্দেশনা দিয়ে থাকে। গত ছয় বছরে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনবার বেতন প্রদানের নির্দেশনা দিলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ সেগুলো আমলে নেয়নি। এ অবস্থায় আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। হারুন-অর-রশিদ আরও বলেন, একই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ পেয়ে ডিগ্রি ৩য় শিক্ষকগণ এমপিওভুক্ত হতে পারলে, অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের দোষ কোথায়? একই প্রতিষ্ঠানে দ্বৈত নীতি থাকতে পারে না। সরকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালালে শিক্ষকদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব নিতে হবে। এসডিজি-৪ ও জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ এর উচ্চশিক্ষার কৌশল বাস্তবায়নের জন্য অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষকদের দ্রুত এমপিওভুক্তির আওতায় আনতে হবে।
এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মশিউর রহমান বলেন, তাদের বিষয়ে আমাদের সহানুভূতি আছে। তবে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে তারা যখন অনুমতি নিয়েছেন তারা স্পষ্টত স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে বলেছেন- এসব শিক্ষকদের বেতন-ভাতা কলেজ কর্তৃক প্রদত্ত হবে। এখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো সময়ই দায় নেয়নি। কলেজেরই যে আয় আছে সেখান থেকেই ব্যয়ভার বহন করা হবে- এই মর্মেই তাদের যোগদান করানো হয়েছে। তারা যখন চাকরি পান তারা সেই বাস্তবতা মেনেই চাকরিতে এসেছেন। এমন কোনো কথা কোনোকালেই ছিল না তাদের এমপিওভুক্ত করানো হবে।
Discussion about this post