আহমাদ ইশতিয়াক
ভারতবর্ষের আধুনিক চিত্রশিল্পের জনক বলা হয় তাকে। শিশু সাহিত্যেও যার তুলনা পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ প্রয়াণের এক মাস আগে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের প্রান্তভাগে যখন মনে করি সমস্ত দেশের হয়ে কাকে বিশেষ সম্মান দেওয়া যেতে পারে, তখন সর্বাগ্রে মনে পড়ে অবনীন্দ্রনাথের নাম। তিনি দেশকে উদ্ধার করেছেন আত্মনিন্দা থেকে, আত্মগ্লানি থেকে তাকে নিষ্কৃতি দান করে তার সম্মানের পদবি উদ্ধার করেছেন। তাকে বিশ্বজনের আত্ম-উপলব্ধিতে সমান অধিকার দিয়েছেন। আজ সমস্ত ভারতে যুগান্তরের অবতারণা হয়েছে চিত্রকলায় আত্ম-উপলব্ধিতে। সমস্ত ভারতবর্ষ আজ তার কাছ থেকে শিক্ষাদান গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের এই অহংকারের পদ তারই কল্যাণে দেশে সর্বোচ্চ স্থান গ্রহণ করেছে। একে যদি আজ দেশলক্ষ্মী বরণ করে না নেয়, আজও যদি সে উদাসীন থাকে, বিদেশি খ্যাতিমানদের জয় ঘোষণায় আত্মাবমান স্বীকার করে নেয়, তবে এই যুগের চরম কর্তব্য থেকে বাঙালি ভ্রষ্ট হবে। তাই আজ আমি তাকে বাংলাদেশে সরস্বতীর বরপুত্রের আসনে সর্বাগ্রে আহ্বান করি।’
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর তার প্রিয় রবি কাকা যেন এক সমার্থক। অবনীন্দ্রনাথ কাউকে ভয় না পেলেও পেতেন তার রবি কাকাকে। সেই ঠাকুর বাড়ির বিখ্যাত খামখেয়ালি সভা থেকে সভ্য হয়ে কবিতা আর নাটকের মধ্য দিয়ে যার সূচনা। ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড দুষ্টু। কখনোই প্রশ্রয় দিতে পারতেন না ভুলকে। শুদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত যে তার রেহাই নেই। তার দুষ্টুমির খ্যাতি ছড়িয়েছিল স্কুলেও। সেই নরমাল স্কুলে লক্ষ্মীনাথ পণ্ডিত নামে ছিল এক প্রচণ্ড রাগী ইংরেজির মাস্টার। তিনি ক্লাসে ভুল উচ্চারণ করতেন। একবার পড়াতে গিয়ে এক খাবারের নাম বললেন ‘পাডিং’। অবনীন্দ্রনাথ বললেন, ‘না ওটা পুডিং হবে।’
লক্ষ্মীনাথ পণ্ডিত বললেন, ‘পুডিং নয়, পাডিং বল’। এবার অবনীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ওটা পুডিং, আমি রোজ বাড়িতে খাই, আমি জানি না!’ এবার যেন আঁতে ঘা লাগলো লক্ষ্মীনাথ পণ্ডিতের। তিনি বললেন, ‘বল পাডিং!’ কিন্তু, ফের অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘ওটা পাডিং না তো, ওটা পুডিং!’ এবার জেদ ধরার শাস্তি হিসেবে টানাপাখার দড়িতে হাত বেঁধে পিঠে বেত মারলেন লক্ষ্মীনাথ পণ্ডিত। কিন্তু, তাতেও পুডিং আর পাডিং হলো না। শেষমেশ নরমাল স্কুল ছেড়ে তার জন্য বাড়িতেই মাস্টার রাখা হলো। ছোটবেলা থেকেই এমন ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
রবীন্দ্রনাথের কাকাত ভাই গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র অবনীন্দ্রনাথ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন আরেক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী। রবীন্দ্রনাথের জন্মের ১০ বছর পরে জন্ম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। কে জানত, তার জন্মের দিনটিতেই একসময় হবে রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণ।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ১৮৭১ সালের ৭ আগস্ট। তার বাবা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাকাত ভাই।
অবনীন্দ্রনাথের জন্মের পর ঠাকুরবাড়ির রীতি অনুসারে তার সঙ্গে রাখা হয়েছিলো পদ্মদাসী নামের এক দাসীকে। বেশ ঠান্ডার ধাত ছিল অবন ঠাকুরের। ঠান্ডায় ভীষণ কাবু হয়ে পড়তেন। একবার এক শীতের দিনে জানালার শার্সি বন্ধ করার পরেও ঠান্ডা কমছে না দেখে তুলোর পর্দা ঝোলানোর বন্দোবস্ত হয়েছিলো তাদের বাড়িতে। পাতলা ওয়াড়ে মোড়া শালুর লেপের ভেতর বাড়ির ছোটরা সকলে একসঙ্গে গুটিসুটি মেরে ঘুমোতেন। যদি একটু শীত কমে! সকালে সবাই লেপ ছেড়ে বের হলো। কিন্তু, অবনীন্দ্রনাথকে আর পাওয়া গেল না। ‘ছেলে কোথা গো’ বলে কান্না জুড়ে দিয়েছিল পদ্মদাসী। শোরগোলের মধ্যে অবশেষে আবিষ্কৃত হলো, ওয়াড়ের ভেতর ঢুকে ঘুমোচ্ছেন তিনি। সারা গা তুলোয় মাখামাখি! এমনই দুষ্টু ছিলেন তিনি।
অবনীন্দ্রনাথের ছবি আঁকা শুরু হয়েছিল ঠাকুর বাড়িতেই। বাড়ির দেয়ালে দেখতেন তেল রঙয়ে আঁকা ‘মদন-ভস্ম’, ‘কাদম্বরী’ কিংবা দেবদেবীর পটচিত্র ‘শ্রীকৃষ্ণের পায়েস ভক্ষণ’, ‘শকুন্তলা’র মতো চিত্রকর্ম ঝুলছে। এমন দেখতে দেখতেই ছবি আঁকা শুরু হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের। একবার তার ছোট পিসে দিয়েছিল তাকে একটি হাঁসের ছবি। তা দেখেই প্রথম এঁকেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। আর তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের টেবিলে সর্বদাই পড়ে থাকত ছবি আঁকার কাগজ, বিভিন্ন রঙের পেন্সিল। সেই রঙ বেরঙয়ের পেন্সিল দিয়ে রঙ করা হলো।
তবে, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকলার পাঠ খানিকটা দেরিতে। ২৫ কিংবা ২৬ বছর বয়সের দিকে আর্ট স্কুলের শিক্ষক ইতালীয় শিল্পী গিলার্ডির কাছে। তার কাছে অবনীন্দ্রনাথ শিখেছিলেন ড্রয়িং, প্যাস্টেল ও জলরং। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন গিলার্ডির কাছে শিখছেন, ঠিক সে সময়ে কলকাতায় এলেন বিখ্যাত ইংরেজ চিত্রশিল্পী সি এল পামার। তার কাছে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর শিখলেন লাইফ স্টাডি, জলরং আর তেলরংয়ের ব্যবহার। ভারতীয় রীতিতে অবনীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম চিত্রাবলি ছিল ‘কৃষ্ণলীলা-সংক্রান্ত’।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন ১৮৯৫ সালের দিকে। ১৮৯৭ সালে আঁকলেন শুক্লাভিসার-রাধার ছবি মাঝে রেখে উৎকীর্ণ কবি গোবিন্দ দাসের পঙক্তিমালা, যা ছিল পাশ্চাত্য নিয়মের সঙ্গে ভারতীয় রীতির নবতর সংশ্লেষণ; যোজন-বিয়োজন। ১৯০০ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলে তার কৃষ্ণলীলা সিরিজ প্রদর্শিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে ই বি হ্যাভেলের উদ্যোগে লর্ড কার্জনের দিল্লি দরবারে আরও দুটি প্রদর্শনী এবং লন্ডনের ‘স্টুডিও’ পত্রিকায় চিত্রালোচনা প্রকাশিত হলে অবনীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি প্রকাশ্যে এলো। তার আঁকা ‘শাজাহানের অন্তিমকাল’ ভীষণ খ্যাতনামা আলোকচিত্র। যেখানে আমরা দেখি মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন সম্রাট শাহজাহান। আর তার পায়ের কাছে বসা তার কন্যা। এই ছবি অবনীন্দ্রনাথ এঁকেছিলেন ১৯০২ সালে। এই ছবির পরে মোঘল সাম্রাজ্য ও অন্দরমহল নিয়ে বহু ছবি এঁকেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য—বুদ্ধ ও সুজাতা, কালীদাসের ঋতুসঙ্ঘার বিষয়ক চিত্রকলা, চতুর্ভুজা ভারতমাতা, কচদেবযানী, শেষযাত্রা।
অবনীন্দ্রনাথের জাপানি রীতিতে আঁকা বিখ্যাত চিত্রকর্ম ওমর খৈয়াম এক অনন্য শিল্পকর্ম। স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিকায় তার আঁকা ‘ভারতমাতা’ চিত্রকর্ম ও কিংবদন্তী পর্যায়ে। স্বদেশি আন্দোলনে নতুন করে এক জাগরণ সৃষ্টি করল এই ছবি। কিংবা ‘বাউল বেশে রবীন্দ্রনাথ’ চিত্রকর্ম ও অনন্য এক ইতিহাস।
কলকাতা আর্ট কলেজের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ এক দশক ধরা হয় বিংশ শতকের প্রথম দশককে। ১৯০৫ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত এই কলেজের কার্যনির্বাহী অধ্যক্ষ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এখানে তিনি ছাত্র হিসেবে পেয়েছিলেন শিল্পগুরু যামিনী রায়, শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু, মুকুল দে, সুরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি, ক্ষিতিন্দ্রনাথ মজুমদারের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের।
অবনীন্দ্রনাথ কাগজ ছাড়াও কাজ করেছেন নানা মিডিয়ামে। যেমন কাপড় ও কাঠ। একইসঙ্গে বানাতেন পুতুল। সেই পুতুল নিজ হাতে কাপড় কেটে তৈরি করতেন। একটা অভ্যাস ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। তা হলো প্রাতঃভ্রমণে গেলে কুড়িয়ে আনতেন সুপারিগাছের খোল, আনতেন নারিকেলের মালা, গাছের শেকড়। আর তা দিয়ে তৈরি হতো নানান ছোট আকৃতির ভাস্কর্যও।
ভারতীয় চিত্র শিল্প ও প্রাচ্য শিল্প যেন গোটা বিশ্বমহলে পৌঁছায়, তার জন্য আজীবন কাজ করেছেন তিনি। সম্পূর্ণ ইউরোপিয়ান ও পাশ্চাত্য শিল্পমাধ্যমের মাঝেও তিনি যেভাবে দেশীয় শিল্পকলা ও মেটাফোর নিয়ে কাজ করেছেন, তা অবর্ণনীয়। ১৯০৭ সালে তিনি ও তার দাদা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব ওরিয়েন্টাল আর্টসের জন্মই বিস্তৃত এক দৃষ্টান্ত। এ ছাড়া, লিখেছেন শিল্প বিষয়ক প্রবন্ধ নিবন্ধ, শিল্প আলোচনা, সমালোচনা প্রভৃতি।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে সম্বোধন করা হতো শিল্পগুরু নামে। তিনি অবশ্য সেই নাম বা সে ধরনের খেতাবে বিশ্বাস করতেন না। বলতেন, ‘নামের আগে কতগুলো বিশেষণ জুড়ে দিলেই কি খুব বড় হয়ে যাবো!’
কেবল চিত্রশিল্পেই নয়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প বলার কুশলতা ও গদ্য লেখার হাতও ছিল অসামান্য। তার গল্প ও কাহিনী বর্ণনা করার ধরণ এবং বক্তব্যে মুগ্ধ হয়েই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘অবন, তুমি লেখো না। যেমন করে মুখে মুখে গল্প করে শোনাও, তেমনি করেই লেখো।’ অবনীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘কী লিখব, আর কে পড়তে যাবে!’
জবাবে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘তুমি লিখে যাও, আমি তো আছিই। ভাষার কোনো দোষ হলে তার ভার আমার ওপরেই না-হয় ছেড়ে দিয়ো, শুধরে দেবো।’ রবীন্দ্রনাথের উৎসাহ পেয়ে অবনীন্দ্রনাথ প্রথম লিখেছিলেন শকুন্তলা।
সংস্কৃত সাহিত্য অবলম্বনে অবনীন্দ্রনাথ মোট দুটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। একটি রামায়ণ এবং অপরটি এই শকুন্তলা।
বাংলা ১৩০২ সালের শ্রাবণ মাসে বাল্য গ্রন্থাবলীর প্রথম গ্রন্থরূপে প্রকাশিত হয় শকুন্তলা।
রবীন্দ্রনাথ আগাগোড়া পড়ে লেখার কিছুই কাটলেন না। অবনীন্দ্রনাথ বললেন, ‘আমিও তাহলে গল্প লিখতে পারি।’ এরপর তো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর একে একে লিখলেন, ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘রাজকাহিনী’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘ভূত পত্রীর দেশে’, ‘নালক’, ‘মাসি’সহ দশের অধিক গ্রন্থ। অবনীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সেই অবদান নিয়েও। ‘গল্প লেখা আমার আসতো না। রবিকা-ই আমার গল্প লেখার বাতিকটা ধরিয়েছিলেন।’
অবনীন্দ্রনাথের প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল ‘নবযুগ’পত্রে ১৩১১ শ্রাবণে, ‘নবদুর্ব্বা’ নামে। রানী বাগেশ্বরী অধ্যাপক থাকার সময় ১৯২১-১৯২৯ সালের মধ্যে যে ঊনত্রিশটি বক্তৃতা তিনি দিয়েছিলেন, সেগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪১ সালে ‘বাগেশ্বরীশিল্প প্রবন্ধাবলী’ নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেছিল।
শিশু সাহিত্যেও জুড়ি নেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। রবীন্দ্রনাথ তার ‘বাল্য গ্রন্থাবলী’ লেখার আগে বলেছিলেন কেবল, ‘ছোটদের পড়বার মতো বই বাংলাভাষায় বিশেষ নেই। এ অভাব আমাদের ঘোচাতে হবে। তুমি লেখ।’ গদ্য, শিশু সাহিত্য, প্রবন্ধ, নিবন্ধ সবকিছুতেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃষ্টি করেছিলেন এক অনন্য রীতি ও এক অবিস্মরণীয় কীর্তি।
আজ কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী, নন্দন-তাত্ত্বিক, শিল্প সমালোচক ও শিশু সাহিত্যিক অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫০তম জন্মদিন। সার্ধশতবর্ষে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি শিল্পগুরুকে।
তথ্যসূত্র:
১। স্মৃতিকথা, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২। অবনীন্দ্রনাথ, মনোজিৎ বসু
৩। শিল্প গুরু অবনীন্দ্রনাথ, রানী চন্দ
Discussion about this post