জাহিদুর রহমান
‘তখন আমরা একেবারেই তরুণ। মাত্র বুয়েট থেকে পাস করে বের হয়েছি। আমাদের ছোট্ট একটা অফিস ছিল। পাশে কিছু বাড়ি। সেখানকার ছোট ছেলেমেয়েরা রোজ আমাদের অফিসে আসত। আমাদের বিভিন্ন স্থাপনা ও বাড়ির নকশা দেখত। মডেলগুলো দেখে খুশি হতো। কিন্তু এক দিন মডেল দেখে তারা খুব মন খারাপ করল। বলল, ‘এটা কী মডেল বানিয়েছেন? ভালো হয়নি। এটা দেখে কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায়!’
বলছিলেন জামী-আল-সাফী। যেদিনটির কথা বলছিলেন, সেদিনই রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের নকশার কাজ শেষ হয়েছিল। একটা মডেল তৈরি করেছিলেন তিনি ও তার বন্ধু ফরিদ উদ্দিন আহমেদ।
জামী বলে চলেন, ‘বাচ্চাদের এ কথা শুনে আমি ফরিদের দিকে তাকাচ্ছি, ফরিদ আমার দিকে। আমরা তো এটাই করতে চেয়েছি। আমরা যেটা করতে চেয়েছি, তার প্রথম অনুভূতির প্রকাশ পেয়েছিলাম ওই শিশুদের কাছ থেকে। তখন আমরা অনুভব করেছি- আমরা সফল হয়েছি।’
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধের অবস্থান। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী দেশের প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, সাংবাদিক, লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালকসহ অনেক বুদ্ধিজীবীকে এখানে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের মৃতদেহ ফেলে রাখা হয় পরিত্যক্ত ইটখোলার জলাশয়ে। এ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডকে স্মরণীয় করতেই সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ। দুই বন্ধু স্থপতি জামী ও ফরিদ স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করেন পরিত্যক্ত সেই ইটভাটার আদলেই। এতে লাল ইটের গাঁথুনির প্রাধান্য। দূর থেকে দেখলে মনে হয়, খোলা আকাশের নিচে সৌধের একমাত্র দেয়ালটি নির্ভীক প্রহরীর মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। দেয়ালটির দু’দিক ভাঙা। এ ভগ্ন দেয়াল ঘটনার দুঃখ ও শোকের গভীরতা নির্দেশ করছে। স্মৃতিসৌধের বাঁকা দেয়ালের সম্মুখভাগে একটি স্থির জলাধার। জলাধারের ভেতর থেকে উঠে আসা কালো গ্র্যানাইট পাথরের স্তম্ভটি শোকের প্রতীক।
১৯৯৩ সালে সরকার স্মৃতিসৌধটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেকটস্ যৌথভাবে নকশা প্রণয়নের জন্য জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতা আহ্বান করে। ২২টি নকশার মধ্যে ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ও জামী-আল-সাফীর নকশাটি নির্বাচিত হয়। ১৯৯৬ থেকে ৯৯ পর্যন্ত তিন বছরে সময়ে স্মৃতিসৌধের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়।
স্থপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, প্রকল্পটি হাতে আসার পর আমরা ঘটনাটির গভীরতা অনুভব করার চেষ্টা করলাম। প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বললাম। বইপত্র সংগ্রহ করলাম। এসব করে যে অনুভূতি আমরা ভেতরে ধারণ করেছি, সে অনুভূতি পুরোপুরি নকশায় ফুটিয়ে তোলাই ছিল আমাদের প্রথম দায়িত্ব। এখন যারা স্মৃতিসৌধে যাচ্ছেন, তারা সেখানে মনের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারছেন।
জামী-আল-সাফী বলেন, ‘আমরা প্রথম ঠিক করি এমনভাবে নকশা করতে হবে, যাতে সেখানে কেউ গেলেই তার ভীষণ মন খারাপ হয়। সবাই যেন অনুভব করে- এখানে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটেছে।’
তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের সময় আমরা খুব ছোট ছিলাম। তখন আমাদের অভিভাবকদের সঙ্গে পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া তেমন কিছু করতে পারিনি। পরে এ রকম একটি কাজে সম্পৃক্ত হতে পেরে নিজেদের গর্বিত মনে করছি।’
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সৌধটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে দাঁড়ালেই একাত্তরের সেই করুণ চিত্রটি স্মরণ করিয়ে দেয়। দূর থেকে সৌধের চন্দ্রাকৃতির দেয়ালটির যত কাছে যাওয়া যাবে, মনে হবে দু’দিক থেকেই যেন দেয়ালটি আপনাকে ঘিরে ধরছে। সেখানে দাঁড়ালে হৃদয়বান মানুষকে নিয়ে যাবে সেই ১৪ ডিসেম্বরে।
‘দূর থেকে সৌধটিকে একটি স্মার্ট কংক্রিটের স্থাপনা মনে হবে। কিন্তু যত কাছে আসা হবে, এর ভাঙা দেয়ালগুলো দেখে সেদিনের করুণ চিত্রগুলো সবার সামনে ফুটে উঠবে। এই দেয়াল যত পুরোনো হবে তখন আরও বেশি শোক ও বেদনার বার্তা দেবে। এ জন্যই একে প্রতীকী রূপ দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে’- বলেন ফরিদ।
এ স্থপতি বলে চলেন, ‘সৌধের দেয়ালে একটি বর্গাকার জানালা রয়েছে। জানালাটি দিয়ে পেছনের খোলা আকাশ দেখা যায়। এটি বার্তা দেয়- একখণ্ড মুক্ত আকাশের জন্যই আমরা যুদ্ধ করেছি; আমাদের বুদ্ধিজীবীরা শহীদ হয়েছেন। এটি দেয়ালের বিশালতাকে কমিয়ে আনে। জানালার ফ্রেমে ভেসে ওঠা আকাশ ও রক্তিম সূর্য নতুন দিনের বার্তা শোনায়।’
সৌধের দেয়াল ভাঙা করে নির্মাণের যৌক্তিকতা কী? ফরিদ বলেন, রায়েরবাজারে যখন বাবার হাত ধরে তার ছোট সন্তানটি আসবে, তখন স্মৃতিসৌধের ভাঙা দেয়ালগুলো দেখে সে তার বাবাকে প্রশ্ন করবে- বাবা, এটা ভাঙা কেন? তখন বাবা এর ইতিহাস তার সন্তানকে বলতে বাধ্য হবেন। এই দেয়াল তরুণ প্রজন্মকে বলছে, দেখো, আমার মতো ভাঙা দেয়ালও পাকিস্তানিদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি।
শুধু বছরের নির্দিষ্ট একটি সময় স্মৃতিসৌধের গুরুত্ব বেশি দেওয়া হচ্ছে বলে কষ্টের কথা জানালেন ফরিদ। তিনি পুরো বছরই সমানভাবে এর রক্ষণাবেক্ষণের অনুরোধ জানান।
ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, সবাই বলেন- এই স্মৃতিসৌধ বানিয়ে আমরা ইতিহাস হয়ে আছি। আসলেই এভাবে যেন আর কেউ ইতিহাস না হন। এ রকম স্মৃতিসৌধ যেন আর কাউকে বানাতে না হয়। পৃথিবীর কোথাও যেন এ রকম নৃশংস ঘটনা আর না ঘটে। আমাদের এ রকম নকশা যেন আর করতে না হয়।
Discussion about this post