ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন
১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাস। মুক্তিবাহিনীর নানামুখী আক্রমণে পর্যুদস্ত পাকিস্তান সেনারা। অবধারিত পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে তারা। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের সূচনা হতে যাচ্ছে ততক্ষণে সকলেই তা উপলব্ধি করতে পেরেছে। এমন সময়ে আসন্ন রাষ্ট্রকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা প্রস্তুত করেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তাদের এই ঘৃণ্য অপচেষ্টার সঙ্গী হয়েছিল পাকিস্তানের এদেশীয় দোসররা। শেষমেশ ১৪ ডিসেম্বর দেশের বুদ্ধিজীবীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। তালিকা করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেদিন দেশের শিক্ষিত সমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়ের সূচনা করে ঘাতকেরা।
আজ ১৪ ডিসেম্বর। বাঙালি জাতি বাংলাদেশে রাষ্ট্রের অভ্যূদয়ের ৫০তম বার্ষিকীতে শ্রদ্ধাভরে পালন করছে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। মূলত ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হলেও দেশকে বুদ্ধিজীবী কিংবা মেধা ও মননে শূন্য করার অপচেষ্টা শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে। ওইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও হামলা চালানো হয়। একটি দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি তৈরি করেন বুদ্ধিজীবীরা। তাদের হত্যা করার ফলে দেশের সৃষ্টিশীল অঙ্গনে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল তা প্রতিনিয়ত উপলব্ধি করেছি আমরা। স্বাধীনতার পর পদে পদে আমাদের সেই বুদ্ধিজীবীদের শূন্যতা বুঝতে হয়েছে।
‘৪৭-এর দেশভাগ ও তার পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামে পূর্ব বাংলায় নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষিত সমাজ। তাদের সাথে দেশের সর্বস্তরের জনগণ অংশ নিয়েছে। পরে দীর্ঘমেয়াদে যা মুক্তি সংগ্রামে রূপ নিয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর যেকোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদটা পূর্ব বাংলার শিক্ষিত সমাজ তথা বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকেই এসেছিল। ফলে শাসকগোষ্ঠী এই বুদ্ধিজীবী সমাজের তাৎপর্য হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল।
একাত্তরের ২৫ মার্চের গণহত্যার মাধ্যমে শুরু হয়ে দীর্ঘ নয় মাসই দেশের বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা করা হয়েছে। কারণ ইতিপূর্বে অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরে, সৃষ্টিশীল কর্মের পাশাপাশি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়ে শাসকদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন বুদ্ধিজীবীরা। ফলে মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড চলেছে। এতে পাকিস্তানিদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা করেছে স্বাধীনতাবিরোধী এদেশীয় দোসররা। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে এসে পাকিস্তানিরা নিজেদের নিশ্চিত পরাজয় দেখতে পায়। তাদের শেষ রক্ষা যখন আর হলো না তখন বাংলাদেশ নামক নতুন একটি দেশের মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে তারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নকশা প্রস্তুত করে। তারা তালিকা করে হত্যার ছক তৈরি করেছিল। এসব ঘৃণ্য কাজে নেতৃত্ব দেয় জামায়াত, আল বদর, আল শামস ও কথিত শান্তি কমিটি। এমনকি কিছু পদলেহী শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরাও এতে সহায়তা করেছিল। এই তালিকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, সাহিত্যিক, আইনজীবী, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী কেউই বাদ যাননি। আর ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে ঘাতকের বুলেট এই বুদ্ধিজীবীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিন ঘর থেকে ডেকে এনে হত্যা করা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের।
বাঙালির আত্মপরিচয় ও প্রকৃত আদর্শ ধারণের কারণেই এই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়। বুদ্ধিজীবীদের একটি রাষ্ট্রের বিবেক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বিশেষ করে একটি নবগঠিত রাষ্ট্রের জন্য বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা অপরিসীম। কারণ রাষ্ট্র মানে শুধু একটি ভূখণ্ড নয়। দেশের চিরায়ত সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য, অর্থনীতি, সমাজের মেলবন্ধনে একটি রাষ্ট্র রূপ পায়। কিন্তু ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাকাণ্ড দেশে এক শূন্যতা তৈরি হয়। যা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে তথা জাতিগঠনে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে।
মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহ দেখলেই স্পষ্ট হয় যে, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড কোনও সাময়িক ফলাফলের জন্য সংঘটিত হয়নি। পরাজয় এড়ানোর কোনও পথই যখন অবশিষ্ট ছিল না, তখন এই হত্যাকাণ্ডের ছক কষে পাকিস্তানিরা। পূর্ব পাকিস্তান নামক ভূখণ্ড হাতছাড়া হওয়ার পর এই রাষ্ট্র যেন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সে পরিকল্পনার বহিঃপ্রকাশ ছিল ১৪ ডিসেম্বরের এই হত্যাকাণ্ড। এদিন সহস্রাধিক বুদ্ধিজীবীর জীবন কেড়ে নেওয়া হয়। এটি ছিল আসন্ন বাংলাদেশকে মেধাশূন্য ও দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করার চূড়ান্ত ষড়যন্ত্র।
এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যদিয়ে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হলো। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের বিষয়টি সামনে এলো। তখনই বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবীদের অভাব অনুভূত হয়। স্বাধীনতার সুফল ঘরে তুলতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র। ফলশ্রুতিতে মাত্র চার বছরের মাথায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হারাতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের এত এত শহীদ, বুদ্ধিজীবীদের হারানো এরপর আবার জাতির পিতাকে হারানোর ফলে জাতি অনেকটা দিগভ্রান্ত হয়ে পড়ে। বুদ্ধিজীবী হত্যা ও স্বাধীনতা পরবর্তী মেধাশূন্যতা দেশের দৃশ্যপটকে বদলে দেয়। বঙ্গবন্ধুর প্রস্থানের মধ্যদিয়ে দেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে পাকিস্তানি প্রেতাত্মারা আবারও ফিরে আসে। থমকে যায় সৃষ্টিশীল ও প্রগতিশীলতার চর্চা। সকল ক্ষেত্রে শুরু হয় ধর্মান্ধতা আর অসহিষ্ণুতা। অস্থিতিশীলতা ও হত্যার মধ্য দিয়ে বারবার ক্ষমতার পালাবদল হয়। একে একে সংস্কৃতি ও সংস্কৃতিবান মানুষের ওপর আঘাত নেমে আসে। দেশে যুক্তির চর্চায় ভাটা পড়ে। প্রগতি আর মুক্তবুদ্ধির চর্চার আকাল শুরু হয়। সংস্কৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে দেশ পশ্চাতপদ হতে থাকে। যা পরবর্তীতে আরো দীর্ঘায়িত হয়েছে। এ কথা বলা যায় যে, স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত দেশে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় এক শূন্যতা রয়ে গেছে।
যে কারণে বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানিদের দোসরদের রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ আসনে বসানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবার ও মুক্তিযোদ্ধাদের নিষ্পেষিত হতে হয়েছে। যুদ্ধাপরাধী ও বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচার দেখতে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে।
স্বাধীনতার আগের তিন দশকে দেশের বুদ্ধিজীবীরা যেভাবে সচেষ্ট ছিল, পরবর্তীকালে তার শূন্যতা দেখা দেয়। যে কারণে ৫০ বছরের নানা সময়কালে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা করা হয়েছে। শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে নিজেদের অধিকার আদায়ে লড়তে হয়েছে। আর এসব যৌক্তিক সংগ্রামে আমরা বুদ্ধিজীবীদের উপস্থিতির অনাগ্রহও দেখেছি। দেশে এখনও জাতির জনকের ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা আমাদের সেই ১৪ ডিসেম্বরের ঘটনাকেই মনে করিয়ে দেয়। তবে কি সেই ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারিনি আমরা!
বিলম্বে হলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এসেছে। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ও কৌশলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সম্মিলন ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগ আমাদের প্রেরণার উৎস। এই অনুপ্রেরণা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনার উদ্রেগ করুক। যাতে অবারিত হয়ে উঠুক মুক্তবুদ্ধির চর্চা।
লেখক: অধ্যাপক; বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)। সহ-সভাপতি, আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন।
Discussion about this post