ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন
একাত্তরের ৭ই মার্চ। রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’। সেই ৭ কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে বাঙালি অস্ত্র ধরেছিল। নয়মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে পর্যদস্তু পাকিস্তানী বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করলো। সেদিন বাংলাদেশ নামক নতুন এবং স্বাধীন এক ভখন্ড পেয়েছে বিশ্ব। বাংলাদেশের যখন জন্ম তখন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। এরপর ১৯৭১-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশে ফিরলেন। তিনি আবারও বললেন, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না’। এদিন থেকেই বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ায় মনোনিবেশ করেন।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে পরাজিত শক্তিদের আকাশ সমান ষড়যন্ত্র ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছিল। সবদিকে থেকে বাঙালি জাতিকে পিছিয়ে রাখার এই অপচেষ্টাকে চপেটাঘাত করে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র গঠনের কাজ এগিয়ে নিচ্ছিলেন। তবে ঘাতকের বুলেট আঘাত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে নস্যাৎ করতে চাইলো। পচাত্তরের ১৫ আগস্ট প্রায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। রচিত হলো বিশ্বাসঘাতকতা ও অকৃতজ্ঞতার করুণ ইতিহাস। এরপর দীর্ঘ সময় দেশকে পিছিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রকারীদের কব্জায় ছিল বাংলাদেশ।
দীর্ঘবছর পরে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতার পালাবদলে ২০০৯ সালে ফের আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সরকার গঠন করে। এই সরকারের নেতৃত্বে রয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। এরপর থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ নানা দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, কৃষি এবং অবকাঠামোসহ সকল ক্ষেত্রে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ। তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নয়নে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তরিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
মার্কিন মুলুকে একসময় তলাবিহীন ঝুঁড়ি হিসেবে আখ্যা পাওয়া বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। দেশের সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। প্রত্যন্ত গ্রামে শহরের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। শহরের জীবনযাত্রার মান আরো আধুনিক হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে মার্কিন মুলুকে যে কটাক্ষ হয়েছিল তার সমুচিত জবাব দিয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশ সমালোচকদেও সমুচিত জবাব দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ ও বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যায়নি।বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন সূত্রের তথ্যমতে, ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ছিল মাত্র ২৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। জিডিপির আকার ছিল ৭ হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। প্রায় ৭০ শতাংশ দরিদ্রের দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ১২৯ ডলার। তবে মাঝখানের পঞ্চাশ বছরে সবকিছুর আমূল পরিবর্তন হয়েছে। যার সিংহভাগই বিগত ১২ বছরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের অর্জন। এখন বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২২৭ মার্কিন ডলারে। বিশ্ব ব্যাংক বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ১৯৮৯ মার্কিন ডলার। যা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের থেকেও বেশি। এই বছরে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ১ হাজার ১৯৪ মার্কিন ডলার।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২১ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ২ হাজার ১৩৮ দশমিক ৭৯৪ ডলার। তাদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মোট জিডিপির পরিমাণ ছিল ৩৫২.৯০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের তুলনায় বহুগুণে বাংলাদেশের জিডিপি, রপ্তানি আয়, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। পাশাপাশি কমেছে দারিদ্রের হার। একসময় তলাবিহীন ঝুঁড়ি হিসেবে আখ্যা পাওয়া দেশটি ২০৩৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে। এই পূর্বাভাস দিয়েছে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক্স এন্ড বিজনেস রিসার্চ। এই সংস্থার ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক লিগ টেবল ২০২১’ নামের টেবিল রিপোর্টে এই আভাস দেওয়া হয়েছে। তাদের ওই রিপোর্টে ২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ বলেও জানানো হয়েছে।
শুধু অর্থনীতি নয়, দেশের সামগ্রিক চিত্রই পাল্টেছে। বিশ্বকে তাক লাগিয়ে নিজস্ব প্রচেষ্টায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ। দেশে নির্মিত হচ্ছে মেট্রোরেল। শীঘ্রই সকল কাজ শেষে পদ্মাসেতু এবং মেট্রোরেল দেশের মানুষকে সেবার আওতায় আনবে। ২০২২ সালের জুন-জুলাই নাগাদ পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে। আর ২০২২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত বাণিজ্যিক চলাচল শুরু করবে মেট্রোরেল। ইতোমধ্যে মেট্রোরেলের পরীক্ষামূলক চলাচল শুরু হয়েছে। গ্রাম মানেই সেই কাঁচা রাস্তা এখন শুধু গল্প মাত্র। গ্রামেও এখন আর কাঁচা রাস্তা দেখা যায় না। সেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়েছে। পৌঁছেছে উচ্চগতির ইন্টারনেট। খড়-বাশ কিংবা মাটিতে তৈরি ঘরের বদলে গ্রামের রাস্তার দুধারে তাকালেই দেখা যাবে পাকা ঘরবাড়ি।
দেশের মানুষের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগও বেড়েছে। শিক্ষার্থীদের ঝড়ে পড়া রোধে স্কুলগুলোতে উপবৃত্তি চালু করা হয়েছে। আবার মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে বই বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছিল এই সরকার। এরপর থেকে সবার মধ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বদলে গিয়েছে। কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ হয়েছে। দেশে সরকারি-বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাও বেড়েছে। এর প্রভাব ইতিবাচকভাবে সমাজে লক্ষ্যণীয়। এখন আর কম বয়সে ছেলে-মেয়েদের বিয়ে না দিয়ে বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন অভিভাবকরা।
দেশের সব পর্যায়ের মানুষকে চিকিৎসা সেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে গ্রাম পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা চালু করার উদ্যোগ নেয় প্রধানমন্ত্রী। এই কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে গ্রামের মানুষেরা বিনামূল্যে ঔষধসহ ডাক্তারি সেবা পাচ্ছে। একটু অসুস্থ হলেই দেশের মানুষকে এখন আর শহরে ছুটতে হয় না। কিংবা বিনাচিকিৎসায় কাউকে মৃত্যুবরণ করতে হয় না। সব এলাকাতেই চিকিৎসা সেবার সম্প্রসারণ হয়েছে। জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।
দেশের কৃষকদের একসময় সারের জন্য হাহাকার করতে হতো। কিন্তু এখন কম মূল্যে হাতের নাগালেই সার পান কৃষকরা। তাদের উৎপাদিত ফসল বাজারে নায্য মূল্যে বিক্রিরও সুবিধা রয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রান্তিক কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কেনা হয়। কৃষকদের মধ্যে প্রণোদনার ব্যবস্থা করার পাশাপাশি তাদেরকে নানা ধরণের প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করে সরকার। কৃষকদের বিনাসুদে ঋণ প্রদানের জন্য রয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক। এসব কারণে দেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের তুলনায় চারগুণ বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদিত হচ্ছে। যার ফলে কৃষকদের ভাগ্য বদলেছে। যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভ‚মিকা রাখছে।
দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভ‚মিকা রাখছে তৈরি পোশাক খাত। একসময় পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতো বাংলাদেশ। কিন্তু পাটের চাহিদা কমার সাথে তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে তৈরি পোশাক খাতে উন্নতির সাথে সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতি বদলে যায়। এখন বিশ্বের মধ্যে তৈরি পোশাক খাতে অগ্রগণ্য বাংলাদেশ। এ খাতে প্রতি বছরই অসংখ্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে বাংলাদেশ। এসবের পাশাপাশি বেড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। দেশের সকল ক্ষেত্রে এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া। যা দেশের জীবনমান উন্নয়নে প্রধান নিয়ামকের ভ‚মিকায় রয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে যে দেশ বৈদেশিক সাহায্যের উপরেই অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল, সেই বাংলাদেশ এখন স্বাবলম্বি। তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে অপবাদ পাওয়া বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অন্য অনেক দেশের তুলনায় সমৃদ্ধ। মূলত বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সুদক্ষ নেতৃত্ব ও সরকারের সঠিক পরিচালনায় দেশ এতোটা এগিয়েছে। পিতার যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিকে পথ দেখিয়েছেন। কোন ক্ষেত্রেই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখা যায়নি।
লেখক: অধ্যাপক; বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এবং পরিচালক, বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল)। এবং
সহ-সভাপতি, আমরাই ডিজিটাল বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন।
Discussion about this post