অনলাইন ডেস্ক
কোথাও রাস্তার ধারে পড়ে আছে প্লাস্টিকের বোতল, কোথাও নর্দমায় ভাসছে। বাজারও সয়লাব পলিথিনে। আইন থাকলেও প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধে ব্যর্থ হয়েছে কর্তৃপক্ষ। উল্টো দিন দিন বাড়ছে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহার। এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় রয়েছে পরিবেশবান্ধব পদ্ধতির ঘাটতি। ফলে স্থলে পড়ে থাকা প্লাস্টিক বর্জ্য নষ্ট করছে মাটির গঠন; আর খাল-নালা-নদীতে ফেলা প্লাস্টিক যাচ্ছে সাগর পর্যন্ত, যা পানিকে বিষিয়ে তুলছে। মাছের পেটেও যাচ্ছে। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে মানুষ ও প্রকৃতি।
গতকাল সোমবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের ২০২০ সালে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহারের ভয়াবহ চিত্র। রাজধানীর একটি হোটেলে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় আয়োজিত ‘টুওয়ার্ডস এ মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান ফর সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এতে দেখা যায়, গ্রামের চেয়ে শহরে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার বেশি। বাংলাদেশের নগর অঞ্চলগুলোতে বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ২০০৫ সালে ছিল তিন কেজি। ২০২০ সালে তা তিন গুণ বেড়ে হয়েছে ৯ কেজি। ঢাকা শহরে এই পরিমাণ ২৪ কেজি। ২০০৫ সালে ঢাকায় মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ছিল ৯ কেজি ২০০ গ্রাম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা সংকট প্লাস্টিক দূষণকে আরও খারাপ করেছে। মাস্ক, গ্লাভসসহ অন্যান্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীতে প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে। এসব বর্জ্য আলাদা করা হচ্ছে না। ২০২০ সালে কৃষি, ইলেকট্রনিকস, পরিবহন, আসবাব, ভবন নির্মাণ, গৃহস্থালি, চিকিৎসা, টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন খাতে ১৪,০৯,০০০ টন প্লাস্টিকের ব্যবহার হয়েছে। ঢাকায় দৈনিক ৬৪৬ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দৈনিক ৩২৩ টন পলিথিনের বর্জ্য যোগ হয়। ২০২০ সালে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে দৈনিক মাথাপিছু বর্জ্য উৎপাদন ছিল ০.৬১ কিলোগ্রাম। জনসংখ্যা অনুযায়ী ঢাকা মহানগরীতে দৈনিক ছয় হাজার ১৬৮ টন বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে। এর মধ্যে ১০ শতাংশই প্লাস্টিক বর্জ্য।
দেশের পৌরসভাগুলোতে দৈনিক ৬৪৬ টন বর্জ্য উৎপাদন হয়, এর মধ্যে ১০ শতাংশ প্লাস্টিক। সংগৃহীত ৪৮ শতাংশ ল্যান্ডফিল, ৩৭ শতাংশ পুনর্ব্যবহূত হয়, ১২ শতাংশ খাল ও নদীতে শেষ হয় এবং ৩ শতাংশ সিটি করপোরেশনের ড্রেনে চলে চয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ড্যান ড্যান চেন বলেন, নগরায়ণের ফলে বাংলাদেশে প্লাস্টিক ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে। ফলে দূষণও তীব্র হচ্ছে। করোনা সংকট প্লাস্টিক বর্জ্যের সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। এ জন্য টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা জরুরি। একটি পণ্য ডিজাইন করা থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানো, পুনর্ব্যবহার করা, দেশের সবুজ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হবে।
তিনি বলেন, প্লাস্টিক দূষণ রোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহার করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন ৩০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সঠিক সময়ে কর্মপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি অর্জন বাধাগ্রস্ত হবে।
বিশ্বব্যাংকের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ বুশরা নিশাত বলেন, ইউরোপের দেশগুলোতে গড় মাথাপিছু প্লাস্টিকের ব্যবহার ১০০ কেজিরও বেশি, যেটি বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। তবে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দূষণের শিকার হওয়া দেশগুলোর তালিকার সবচেয়ে ওপরে থাকা দেশগুলোর অন্যতম এবং প্লাস্টিক বর্জ্যের অব্যবস্থাপনাই এর জন্য দায়ী। বাংলাদেশে কার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। ফলে প্লাস্টিক বর্জ্য ড্রেন থেকে খালে, খাল থেকে নদীতে এবং নদী থেকে সাগরে যাচ্ছে। এসব বর্জ্য মাছের পেটে প্রবেশ করছে, সেই মাছ খাওয়ার কারণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।
প্লাস্টিকের ব্যবহার দেশের সবুজ টেকসই ব্যবস্থাপনা অর্জনে বড় বাধা উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক বলছে, ক্রমে বাড়তে থাকা দূষণের হার কমিয়ে সবুজ প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতের জন্য প্লাস্টিকের টেকসই ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ধুঁকছে নদী :শিল্পকারখানা আর শহরের পয়ঃনিস্কাশনের সব বর্জ্য নিয়ে ফেলা হচ্ছে নদীতে। বুড়িগঙ্গা ও কর্ণফুলীর মতো একসময়ের টলটলে পানির নদীগুলো এ কারণে এখন ভয়াবহ দূষণের শিকার। বিশ্বব্যাংকের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু রাজধানীর চারপাশের চারটি নদীতে ৭২ হাজার ৫৩১ টন বর্জ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একসময়ের ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গার ৪৩টি স্থানে পাওয়া গেছে ১১ হাজার ৫৬৪ টন বর্জ্য। এ ছাড়া শীতলক্ষ্যায় ৪৩ স্পটে ৪৩ হাজার ১৮৩ টন, বালু নদীর সাত স্থানে দুই হাজার ১২ টন এবং তুরাগের ৩৬ স্পটে ১৫ হাজার ৭৭১ টন বর্জ্য পাওয়া গেছে। এসব নদীতে দৈনিক ১১২ টন বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী ও চাক্তাই খালের ৯৭টি স্পটে মোট বর্জ্যের পরিমাণ এক হাজার ১২৮ টন। এর মধ্যে কর্ণফুলীতে ১২ শতাংশ প্লাস্টিক এবং চাক্তাই খালে ২১ শতাংশ প্লাস্টিকের অস্তিত্ব মিলেছে।
এ ব্যাপারে ওয়েস্ট কনসার্নের নির্বাহী পরিচালক মাকসুদ সিনহা বলেন, ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর মতো দেশের অন্য বড় শহরের নদীগুলোতেও প্লাস্টিকের দূষণ তীব্র হয়েছে। সেখানে প্লাস্টিকসহ অন্য ময়লা ফেলার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, প্লাস্টিক কণা যে কোনো প্রাণীর জন্যই ক্ষতিকারক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক গাউসিয়া চৌধুরী বলেন, ব্যবহূত প্লাস্টিকগুলো খাল ও নালা হয়ে নদীর মধ্য দিয়ে সাগরে গিয়ে মিশছে। এটি সামগ্রিকভাবে ওই পুরো অঞ্চলের প্রতিবেশ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলছে।
ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (এসডিও) মহাসচিব শাহরিয়ার আলম বলেন, বিশ্বজুড়ে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আমাদের দেশে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হলেও ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। ২০১০ সালে পণ্যের মোড়ক হিসেবে পাটের ব্যাগ ব্যবহারে আইন হলেও পাটের ব্যাগের উৎপাদন বাজারে নেই। দেশের হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্টে ওয়ান টাইম প্লাস্টিক সামগ্রী ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান চালু :গতকাল বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন উপস্থাপন শেষে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বাংলাদেশে মাল্টিসেক্টরাল সাসটেইনেবল প্লাস্টিক ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান উদ্বোধন করেছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আশরাফ উদ্দিন। বিশেষ অতিথি ছিলেন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোস্তফা কামাল, বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এসপেন রিকটার ভেন্ডসেন, এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন এবং বিশ্বব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর ডান্ডান চেন।সৌজন্যে-সমকাল
Discussion about this post