ফয়জুল লতিফ চৌধুরী
পুরো এক দিন এক রাত গরুর গাড়িতে চেপে জব্বার আলী মিয়া যখন বাড়িতে পৌঁছলেন তখন চাঁদ আকাশের মাঝামাঝি এসে গেছে। গ্রাম নিঝুম, ঝিঁঝি পোকার ডাক আসছে আমবাগানের দিক থেকে। গাড়োয়ানকে ভাড়া চুকিয়ে মালপত্র নামাতে নামাতে ছোট ভাইয়ের ছেলে লিয়াকাত আলী অন্ধকারের মধ্যে উদয় হয়ে দ্রুত মুখের বিড়ি নামিয়ে পাঁচ হাত দূরে ছুড়ে দিয়ে জ্যাঠার পায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে যুগপৎ বিস্মিত ও আনন্দিত। ভিতর বাড়ির দিকে দৌড়ে ছুটে গিয়ে সে মাকে পাঠাল রান্নাঘরে, বোনকে পাঠাল জ্যাঠার জন্য ঘর ঠিক করতে আর কামলাদের উঠিয়ে দিয়ে কা’কে কী করতে হবে বলে একজনকে সাথে নিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ফিরে এলো গরুর গাড়ির কাছে। গাড়োয়ানকে সে চলে যেতে দিল না। বলল, এত রাতে কোথায় যাবেন চাচা মিয়া? থাকেন। কাল সকালে যাবেন।
লিয়াকত আলীর ক্ষিপ্রতায় মুগ্ধ হলেন জব্বার আলী মিয়া। তিনি সৈনিক ছিলেন, যা করতে হবে তা দ্রুত গতিতে সেরে ফেলাই তার পছন্দ। গত যুদ্ধের পর অবসর নিয়ে খুলনা শহরে রিকশার গ্যারেজ করেছেন। দুটি আধাপাকা বাড়ি করে ভাড়া দিয়েছেন। আয়পত্র যথেষ্ট। এসব সামলাতে ব্যস্ত থাকতে হয়। গ্রামের দিকে তেমন আসা হয় না। কিছু জমিজমা আছে। ছোট ভাই শরাফত আলী সব সামলায়।
খাবার পালা চুকে যাবার পর উঠানের মধ্যখানে চেয়ার পেতে দিয়ে কিছুক্ষণ গল্পগুজব চলল। এ বাড়ি-ও বাড়ির প্রায় সবাই ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। উঠানে বড় আসর বসে গেছে। লিয়াকত আলীর বড় ভাই হাসমত আলী যুদ্ধে গেছে শোনার পর তার কপাল কিছুক্ষণ কুঁচকে থাকল। তিনি নিঃসন্তান মানুষ, স্ত্রীবিয়োগ হয়েছে দু’বছর হয়। জীবনের প্রতি কোনো মায়া অবশিষ্ট নেই। তবু ভাতিজার যুদ্ধে যাওয়ার খবরে কিছুটা বিচলিত বোধ করলেন। দীর্ঘকাল তিনি সৈনিক ছিলেন। দুইবার পদোন্নতি পেয়ে হাবিলদার হয়েছিলেন। কিন্তু এবারের যুদ্ধটা কেমন সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই, এ রকম যুদ্ধের কথা তার জানা নেই।
বড় ছেলের কথা ওঠায় লিয়াকত আলীর মা ফোঁপাতে শুরু করল। কেউ তাকে সান্ত্বনা দিল না। কিছুক্ষণের জন্য সবার কথা থেমে গিয়ে আবার শুরু হলো। লিয়াকত আলীর মা মুখে আঁচল চেপে উঠে গেল। তিনি উঠে যাবার পর আসর ভাঙতে শুরু করল। জব্বার আলী মিয়া আর ছোট ভাই আব্দুল আলীর কাছে আরও কিছুক্ষণ বসে থাকলেন। তার চায়ের চেষ্টা পেয়েছে কিন্তু পাড়াগাঁয়ে চা খাওয়ার চল নেই। চা আছে কিনা জিজ্ঞেস করে বিব্রত করার মানে হয় না। কাঁসার গ্লাসে ঠান্ডা পানি খেয়ে তিনি উঠে পড়লেন।
বড় ভাইকে ঘরের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে আবদুল আলী জিজ্ঞেস করলেন, শহরে গণ্ডগোল কীরকম? অবস্থা খারাপ?
ঘাড় নাড়লেন জব্বার আলী।
গোলাগুলি হয়?
হয়। তবে বড় কিছু না।
তাহলে হঠাৎ চলে এলেন যে?
সেনাবাহিনীতে ছিল এ রকম লোকদের ডাকাডাকি করছে আর্মি। কোন ঝামেলায় পড়ি তাই চলে এলাম। এখানকার অবস্থা কী?
আশাশুনিতে বড় আর্মি ক্যাম্প। এদিকে এখনও আসে নাই।
ভালো। বাবার ডাবল ব্যারেলটা আছে তো?
আছে।
কাল দিস। পরিস্কার করে রাখব। গুলি আছে?
আছে তিন ডজন। গত বছর শিকারের জন্য কিনেছিলাম। পাখি পড়ে নাই।
বাড়িতে অস্ত্রপাতি আছে কারও জানা না থাকলে ভালো।
ঘুমাতে যাওয়ার আগে ট্রাঙ্ক খুলে পিস্তল আর গুলির বাক্সগুলি এক নজর দেখলেন জব্বার আলী মিয়া। যত্ন করে রাখতে হবে। কখন প্রয়োজন হয় কে জানে?
২.
হাসমত আলী কমান্ডারের মন খারাপ। সকালে ঝাউডাঙ্গা ব্রিজ দিয়ে শত্রুর সাঁজোয়া বাহিনী চলে গেল। তিনি কিছুই করতে পারলেন না।
তিনি যখন খবর পেয়েছিলেন তখন প্রায় মধ্যরাত। সবুজ মিয়া তাকে ঘুম থেকে তুলে বলল-
কেশবপুরের একজন লোক এসেছে খবর নিয়ে।
এই লোক হাসমত কমান্ডারের পরিচিত। সন্ধ্যাবেলায় খবর পেয়ে আট মাইল সাইকেল চালিয়ে সে খবর দিতে এসেছে। পাকা খবর।
ক্যাম্পের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুম থেকে উঠিয়ে তৈরি হয় ছয় মাইল হেঁটে গিয়ে সকালে আক্রমণের জন্য পজিশন নেওয়া-দেওয়া অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সবার ওপর দিয়ে প্রচণ্ড ধকল যেত। তবে ভোরে উঠেই তিনি তাড়াহুড়া করেছেন। নয়টার মধ্যে ঝাউডাঙ্গা বাজারের কাছে পৌঁছে গেছেন। ক্যাম্পে গোলাবারুদ যৎসামান্য। ১১টি মাত্র গ্রেনেড। তার থেকে ছয়টি সাথে নিয়েছিলেন। দুই দিক থেকে আক্রমণ চালাতে চারটা গ্রেনেড যথেষ্ট কিন্তু এগুলির অবস্থা কী রকম কে জানে!
ডেপুটি কমান্ডার রশিদ উদ্দিন মিয়াকে ক্যাম্পের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে যখন ঝাউডাঙ্গা বাজারের কাছে পৌঁছলেন তখন সকাল এগারোটা। বাজার ফাঁকা, সব দোকানের ঝাঁপ ফেলা। ভরদুপুরে জনমানবশূন্য অবস্থা দেখে একটু অবাক হলেন হাসমত আলী। বাজারে ভিতর দিকে কয়েক ঘর হিজড়া থাকে। দেখেশুনে ঐখানে অবস্থান নিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর তিনি সবুজ মিয়াকে পাঠালেন খোঁজখবর নিতে।
সবুজ মিয়া কমান্ডার সাহেবের খাস লোক। তার বয়স কম। এ বছর মেট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। গণ্ডগোল শুরু হওয়ায় পরীক্ষা হয় নাই। সে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। একে তো বয়স কম, তার ওপর চেহারা কোমল। তাকে দেখে সেভেন-এইটের ছাত্র মনে হয়। চেহারায় হাসি হাসি নিরীহ একটা ভাব। কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। মিনিট দশেক পরে ফিরে এলো সবুজ মিয়া। একগাল হেসে বলল, ওস্তাদ মিলিটারিরা আসতেছে এই দিকে। খবর পেয়ে সবাই পালিয়েছে। দোকানপাট বন্ধ। কেউ নাই।
দাঁতে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করল হাসমত আলীর। ঝাউডাঙ্গা ব্রিজ এখান থেকে দেড় মাইল দূরে। এখন সেখানে গিয়ে শত্রু আসার আগেই ভালো পজিশন নেওয়া কঠিন বিষয়। বাজারে অপেক্ষা করাও বিপজ্জনক। আশেপাশে শত্রুদের চর থাকতে পারে। তিনি সাথিদের নিয়ে ফিরতি পথ ধরলেন। মুখটা তেতো হয়ে গেছে।
সবুজ মিয়াকে বললেন, তুই সাবধানে লুকিয়ে থাক। মিলিটারিদের চলে যাওয়ার খাঁটি খবর নিয়ে ফিরবি।
আধা ঘণ্টা পরে সবুজ মিয়া ফিরে এসেছে। সে নিজের চোখে মিলিটারিদের যেতে দেখেছে। চারটি জিপ, চারটি হাফ ট্রাক আর দুটি ট্রাকের বড় কনভয়।
হাসমত আলী কমান্ডার অসহায় বোধ করলেন। এ রকম সুযোগ সহসা পাওয়া যায় না। এদের আক্রমণ করতে পারলে অনেক রসদ জোগাড় হয়ে যেত। তার ১১০ জনের বাহিনী। অর্ধেকের কোনো অস্ত্র নাই। আত্মরক্ষার জন্য লাঠি আর কামারের বানানো চাকু দেওয়া হয়েছে তাদের। গত মাসে এ রকম একটা মিলিটারি কনভয় আক্রমণ করে দুইটা লাইট মেশিনগান আর ৭.৬২ বোরের দশটা ব্রিটিশ রাইফেল সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। আজকের অভিযান সফল হলে অস্ত্র আর গোলাবারুদের চিন্তা থাকত না।
কিন্তু এত বড় কনভয় গেল কোথায়?
ডেপুটি কমান্ডার রশিদুদ্দিন চিন্তিত মুখে বললেন, মনে হয় সীমান্তের কাছাকাছি কোথাও ঘাঁটি গাড়তে যাচ্ছে।
কোন দিকে? বনগাঁ না বসিরহাটের দিকে?
রশিদুদ্দিন মিয়া বললেন-
চিন্তার বিষয়। খোঁজ নিতে হবে।
এই বিরাট বাহিনীর জন্য দিনে প্রায় দুই মণ চাল দরকার, কম করে হলেও ১০ সের ডাল দরকার। প্রতিদিন এ সবের ব্যবস্থা করা কঠিন। আশেপাশে ২০ গ্রামের লোকজন আর কত খাওয়াবে। তিনি ভাবলেন, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে গেলে কেমন হয়। ওপারে থাকা-খাওয়ার সমস্যা নেই। হাতখরচের টাকা পর্যন্ত পাওয়া যায়। ওপারে যাদের ঘাঁটি তারা মাঝে মাঝে সীমান্ত পার হয়ে দেশে ঢুকে আক্রমণ চালায়।
সবুজ মিয়া ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল :
ওস্তাদ, দুপুরে খানার আয়োজন হবে কিনা ক্যাম্প কোম্পানি কমান্ডার আপনাকে জিজ্ঞেস করতে বলেছে।
চাল কতটুক আছে?
সবুজ মিয়া বলল-
ওস্তাদ অবস্থা টাইট। দুই বেলা হিসেবে সাত দিন চলবে এক বেলা হিসেবে দিন দশেক।
ডাল?
ডাল আছে।
হাসমত কমান্ডার বললেন-
যা আছে আপাতত চলুক। আজকে দুপুরের পর রান্না বসাবে। চারটা বাজে খেতে দিবে। রাতে রান্না হবে না। গুড়-মুড়ি তো আছে। না?
ঘাড় নাড়ল সবুজ মিয়া। গুড়-মুড়ি-চিড়ার স্টক পর্যাপ্ত।
৩.
কমান্ডার হাসমত আলী নিজের চালা ঘরে ক্লান্ত দেহে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। সীমান্ত পার হয়ে সেক্টর হেডকোয়ার্টারে গিয়েছিলেন। যেতে আসতে চার দিন। কোনো অস্ত্র সাথে নেন নাই। গত চার মাস অস্ত্র সাথে রেখে অভ্যাস হয়ে গেছে। চার দিন যাতায়াতের কষ্টের সঙ্গে মিশে ছিল অজানা আশঙ্কা। অস্ত্র সাথে থাকলে এ রকম আশঙ্কা থাকে না। তখন মনে হয় তার একটা ক্ষমতা আছে, আক্রমণ হলেও পাল্টা আক্রমণ করতে পারবেন। আজ ক্যাম্পে ফিরেই ট্রাঙ্ক খুলে ছোট পিস্তল হাতে নিয়ে দেখেছেন। হাতে বড় অস্ত্র নিলেও পিস্তলটা সাথে রাখেন। মনে একটা ভরসা জাগে।
চার দিনের কষ্ট পুরো বৃথা। মিত্রবাহিনী বলেছে :
এখন না; অগাস্টের শেষ দিকে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ প্রয়োজনমতো পাওয়া যাবে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর দুই মাসের মধ্যে সীমান্ত পর্যন্ত পুরো রাস্তা দখল নিয়ে রাখতে হবে। সীমান্তের ওই পারে মিত্রবাহিনী নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে ট্যাঙ্ক মোতায়েন করবে।
ভালো কথা। কিন্তু তাদের প্ল্যানটা কী?
সেক্টর কমান্ডার সাহেব এর বেশি কিছু বললেন না।
আসার সময় সেক্টর কমান্ডার সাহেব এক মাস চলার মতো খরচাপাতি দিয়েছেন। বলেছেন-
আগামী মাসের খরচাপাতির টাকাও সময়মতো পৌঁছে যাবে। মনে স্বস্তি পেয়েছেন হাসমত কমান্ডার।
এক কাপ চা হাতে নিয়ে সবুজ মিয়া এসে জানাল, বিকালে বিচার আছে।
কীসের বিচার?
তিন নম্বর কোম্পানিতে সুন্দর মতো একটা ছেলে আছে না, নাম আশরাফ, তার বিচার।
ঘটনা কি সবুজ মিয়া? ওই ছেলের অপরাধ কী?
অভিযানে গিয়ে সে কোম্পানি কমান্ডারের অর্ডার শুনে নাই।
হাসমত কমান্ডার অবাক হলেন। এই ছেলেকে তিনি চেনেন। বিয়ে পাস ছেলে। সাতে-পাঁচে নেই। অবসর সময় ওকে বই পড়তে দেখা যায়। এই ছেলে কথা না-শোনার মতো বা অবাধ্যতা করার মতো ছেলে নয়।
বিচার কখন?
আসরের পরে।
গোসল করব। চার দিন গোসল করি নাই। গোসল করে পরিস্কার কাপড় পরব। আছে কিছু?
সবুজ মিয়া একগাল হেসে বলল-
আমি গরম পানি করে দিতেছি, আপনি আরামসে গোসল করেন। লুঙ্গি গেঞ্জি শার্ট সব কেচে রেখেছি। সাবান শেষ। দাঁতের মাজন শেষ। আজকে টাকা দিবেন। বিচারের পরে হাটে যাব।
হাসমত কমান্ডারের মন শান্ত হলো। একটু আগেও মনে হচ্ছিল তিনি বিরাট ঝামেলার মধ্যে সিঁধিয়ে গেছেন। গভীর অন্ধকার গর্তের মধ্যে পড়ে গেছেন। উদ্ধার নেই। দুনিয়ায় সবাই তার বিপক্ষে। তার কথা শোনার কেউ নেই। এখন অতটা খারাপ লাগছে না।
আজ খানা হবে? খানা কী?
একগাল হাসি মুখে নিয়ে সবুজ মিয়া বলল-
হাঁসের মাংসের ঝাল ভুনা আর মাষকলাইয়ের ডাল।
বলিস কী? তোরা আলাউদ্দিনের চেরাগ পেয়ে গেলি নাকি?
ডেপুটি সাব পরশুদিন রহমতগঞ্জ গিয়েছিলেন। আসার সময় এক বাড়ি থেকে দশটা হাঁস দিয়েছে। আপনি আসলে রান্না করার কথা। সকালে আপনি আসার খবরে হাঁস চড়ানো হয়েছে।
মাষকলাইয়ের ডালে কদু দিলে ভালো হয়। বহুদিন পেট ভরে খাই নাই।
সবুজ মিয়ার সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে গেল।
সে বলল-
কদুর ব্যবস্থা হয়েছে।
আল্লাহু আকবার। আল্লাহপাকের খাস রহমত ছাড়া এই ঘটনা সম্ভব না। বুঝলি সবুজ মিয়া, আল্লাহপাকের রিজিকের কোনো শেষ নাই। কখন কোন্ দিক থেকে রিজিক আসবে তারও ঠিক ঠিকানা নাই। হতাশ হওয়া ঠিক না।
সবুজ মিয়া, আজ বাজারে যাওয়ার আগে আমার থেকে বেশি করে টাকা নিবে। আধা মণ দুধ আর পাঁচ সের চিনি নিয়ে আসবে। মনিরউদ্দিনকে বলবে রাত্রে পায়েস হবে। পায়েস আর মুড়ি।
৪.
বিচার বসেছে বটতলায়। দুটো চেয়ারের একটাতে হাসমত কমান্ডার আর আরেকটিতে ডেপুটি রশিদুদ্দিন। সামনে মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আসামি ও অন্যরা।
হাঁসের মাংস আর মাষকলাইয়ের ডাল দিয়ে তিন থাল ভাত মেরে দেওয়ার পর ঘুম আটকানো অসম্ভব। দেড় ঘণ্টা কড়া ঘুম দিয়ে হাসমত কমান্ডারের মন এখন পুরোপুরি ভালো। তিনি হালকা গলায় বললেন- রশিদুদ্দিন মিয়া, ঘটনা কী বলেন।
রশিদুদ্দিনের ইঙ্গিতে কোম্পানি কমান্ডার কদম আলী উঠে দাঁড়িয়ে ঘটনা বলতে শুরু করল। বৃহস্পতিবার পুরা কোম্পানি রহমতগঞ্জ দিকে গিয়েছিল। এই রাস্তায় শত্রুর গাড়ি নিয়মিত আনাগোনা করে। দয়াপুর কালভার্টের কাছে মাঝে মাঝে জিপ থেকে নেমে শত্রুরা রেকি করে। ড্রাইভার ছাড়া থাকে পাঁচজন। চারজনের কাছে মেশিনগান থাকে। গুলি থাকে।
অ্যাম্বুশ করা হয়েছিল প্ল্যান করে। গুলির দায়িত্ব ছয়জনের। কামালের দায়িত্ব ছিল জিপের ড্রাইভারকে গুলি করা। তারপর আমরা অন্যদের টার্গেট করব। কামাল গুলি করে নাই। কোম্পানি কমান্ডার দূর থেকে শিস দিছে তিনবার, তবু সে গুলি করে নাই। আমরা সমস্যা মনে করে গুলি করি নাই। শত্রুরা কিছুক্ষণ পর গাড়িতে উঠে চলে গেছে। আমরা খালি হাতে ফিরে আসছি।
ঘটনা শুনে হাসমত কমান্ডার অবাক হলেন।
জিজ্ঞেস করলেন-
কামাইল্যা, এটা কেমন কথা? ঘটনা যা শুনলাম তা কি সত্য?
কামাল মাথা নিচু করে বসে ছিল। ঘাড় তুলে সে মাথা নাড়ল। ঘটনা সত্য। কোম্পানি কমান্ডার যা বলেছে তার মধ্যে অসত্য কিছু নাই। সে গুলি করতে পারে নাই।
এই কাজ তুমি কেন করলে? শত্রুকে হাতের মুঠোয় পেয়ে ছেড়ে দিলে?
কামাল ডানপাশে বামপাশে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করল। সে কী বলবে? তার বলার কিছু নাই।
হাসমত কমান্ডার বলল-
কামাল ঠিক করে বলত আসল ঘটনা কী? তোমার রাইফেল ঠিক ছিল?
কামাল আবার মাথা নাড়ল। তার রাইফেল ঠিক ছিল। আগের দিন সকালে সে আর সঙ্গীরা সবাই মিলে রাইফেল পরিস্কার করেছে। এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুড়েছে। অভিযানে যাওয়ার আগে সে রাইফেল ভালোভাবে চেক করে নিয়েছে।
গুলি লোড করা ছিল? নাকি ফেলে গিয়েছিলে?
হাসমত কমান্ডারের কথায় হাসির রোল উঠল। গত মাসে এ রকম একটি ঘটনা ঘটেছিল সাদুল্লাপুর বাজারের কাছে।
আবার মাথা নাড়ল কামাল। ম্যাগাজিনে ছয়টি ৭.৬ গুলি লোড করা ছিল। পকেটে কাপড়ের ব্যাগে আরও ছয়টি গুলি ছিল।
ঠিকমতো পজিশন নিতে পেরেছিলে?
মৃদু কণ্ঠে কামাল বলল-
জি ওস্তাদ, কোনো সমস্যা ছিল না।
তবে গুলি ছুড়লে না কেন? যা শুনলাম তুমি গাড়ি থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে ঝোঁপের মধ্যে পজিশন নিয়েছিলে। তুমি কি ভয় পেয়েছিলে?
মাথা নাড়ল কামাল। সে ভয় পায় নাই। এ রকম ছোট ছোট অভিযানে তো প্রতি সপ্তাহেই যাওয়া পড়ে।
তোমার রাইফেল ঠিক ছিল, গুলি ভরা ছিল, তুমি ভয় পাওনি, পজিশন ঠিক ছিল। তবু গুলি ছুড়লে না?
হাসমত কমান্ডারের গলায় নিখাদ বিস্ময়।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আকাশের পাখিরা ঝাঁক বেঁধে ঘরে ফিরে আসছে। হাসমত কমান্ডার ডেপুটির দিকে তাকালেন। রশিদুদ্দিন মিয়া ঘাড় নাচিয়ে ‘কী জানি কী’ জাতীয় ভঙ্গি করল। ব্যাপারটা তার কাছেও রহস্যজনক।
একটু কেশে নিয়ে মুখ খুলল কামাল। বললো-
ওস্তাদ আমাকে মাফ করে দেন।
হাসমত কমান্ডার বলল-
তোমাকে কোনো শাস্তি দেওয়া হয় নাই। মাপ করার প্রশ্ন আসে না। বিষয়টা কি আমরা কেউ তো বুঝে উঠতে পারছি না।
গলায় জোর টেনে কামাল বলল-
ওস্তাদ আমি যেখানে ছিলাম শত্রুর গাড়িটা সেখান থেকে খুব কাছেই থামানো হয়েছিল। গাড়ি থামিয়ে অনেকক্ষণ ওরা গাড়িতে বসেই কথাবার্তা বলছিল। তারপর গাড়ি থেকে নামল। এর মধ্যেই আমি নিশানা ঠিক করে নিয়েছিলাম। আপনি শিখিয়েছিলেন এ রকম কাছ থেকে গুলি করলে যেন মাথায় নিশানা করি। তাহলে এক গুলিতেই কাজ হয়ে যাবে। আমি ড্রাইভার ব্যাটার মাথার মাঝখানটায় নিশানা করেছিলাম। সহজ টার্গেট। একটা গুলি যথেষ্ট।
সৈনিকরা গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পর ড্রাইভার একটা সিগারেট ধরায়। আমার পজিশন এত কাছে ছিল যে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম ওটা ক্যাপস্টান সিগারেট। সাদা প্যাকেট। সে দূরে তাকিয়ে একমনে সিগারেট টানছিল আর ধোঁয়া ছাড়ছিল। সে কী ভাবতে ছিল কে জানে? গভীরভাবে ভাবতে ছিল। ভাবতে ভাবতে সে একেবারে স্থির হয়ে গিয়েছিল। মোক্ষম সুযোগ। গুলি ছোড়ার মোক্ষম সময়। আমি সেফটি ক্যাচ অফ করে ট্রিগার টিপতে যাব- এমন সময় মনে হল আমি কি ঠিক কাজ করছি?
হাসমত কমান্ডার বললেন-
ঠিক কাজ মানে?
এই ড্রাইভার কে আমি চিনি না। আমার পরিচিত কেউ না। তার সঙ্গে আমার কোনো লাগালাগি নাই। আমার কোনো ক্ষতি করে নাই। তার মাথায় আমি গুলি করব?
সে তোমার শত্রু, এটা নিয়ে সন্দেহ হলো তোমার?
না ওস্তাদ। সে আমাদের শত্রুপক্ষের একজন এতে সন্দেহ নাই। কিন্তু আমার সাথে তার কোনো শত্রুতা নাই, সে আমার পরিবারের কারও কোনো ক্ষতি করে নাই। মনে হলো চাকরি করতে এসে এ দেশে এসেছে। সে শত্রুদের গাড়ি চালায় এই কথা ঠিক কিন্তু সে নিজে কাউকে হত্যা করেছে বা কোথাও আগুন দিয়েছে বা কাউকে ধর্ষণ করেছে- এ রকম কিছু তো আমার জানা নাই। আমি কোন অপরাধে তার ওপর গুলি চালাব?
অপারেশনে গিয়ে ফাইট না করে তুমি এসব ভাবতে শুরু করলে? এটা শেকসপিয়ারের নাটক?
ওস্তাদ, আমি কোনো কিছু ভাবি নাই- কামাল বলল। হঠাৎ মাথার মধ্যে এই কথাগুলি কিলবিল করে উঠল। মাথার ওপর কারও কন্ট্রোল নাই। ড্রাইভার ব্যাটার ওপর রাগ হচ্ছিল না। আমি কী করব বুঝতে না পেরে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। সময় চলে যাচ্ছিল। যে কোনো সময় অন্য সৈন্যরা ফিরে আসবে। ওরা চলে যাবে। দেরি না করে আমার গুলি করা উচিত ছিল। সহজ টার্গেট। ৭.৬২ বোরের ব্রিটিশ রাইফেল। এক গুলিতে কাজ খতম হয়ে যেত। গুলিটা মাথায় লাগত। খুলি ফেটে মগজ বেরিয়ে পড়ত, এক মিনিটে দফারফা।
আমি পরিস্কার ঠাওর করতে পারছিলাম সুযোগটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আবার নিশানা ঠিক করেছিলাম। কিন্তু ট্রিগার টানতে পারছিলাম না। কোনো যুক্তিই আমার মাথায় এলো না যাতে আমি গুলি ছুড়ে লোকটাকে মেরে ফেলতে পারি। আমার মনে হলো আমি সম্ভবত একজন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করতে যাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত গুলি ছোড়া হলো না। চিন্তার ওপর মানুষের কন্ট্রোল নাই। এই চিন্তা মাথায় কেমনে ঢুকল বলতে পারব না।
ডেপুটি কমান্ডার রশিদ মিয়া ভগ্ন গলায় বললেন-
এ রকম লোক নিয়ে যুদ্ধ করা যায়? যুদ্ধ কী জিনিস, এই ছেলে বোঝে না। আমাদের ব্যাটালিয়ানে এ রকম আর কয়জন আছে কে জানে!
হাসমত কমান্ডার রশিদুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই ছেলের বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযোগ আছে? তাকে আমাদের দলে কে এনেছে?
কামরুজ্জামান দাঁড়িয়ে বলল-
ওস্তাদ, আমরা একসঙ্গে খুলনার বিএল কলেজে পড়েছি। আমি তাকে দলে নিয়ে এসেছি। সে ভালো ছেলে। তার ছোট ভাই কুষ্টিয়া সেক্টরে আছে।
ডেপুটি কমান্ডার রশিদ মিয়া বলল-
না, এই ছেলের বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযোগ নাই। কদম আলী তোমার আর কোনো অভিযোগ আছে?
কদম আলী মাথা নাড়ল। তার আর কোনো অভিযোগ নাই।
হাসমত কমান্ডার মাথা ঝুঁকিয়ে রশিদ মিয়ার কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল-
কোনো শাস্তির কথা ভেবেছেন রশিদ মিয়া?
হতাশ গলায় রশিদ মিয়া বললেন-
কী ভাবব ওস্তাদ! এ রকম আচানক কথা জীবনে শুনি নাই।
৫.
জব্বার আলী মিয়া যখন ঝাউডাঙ্গা বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছালেন তখন সূর্য মাথার ওপরে চলে এসেছে। জ্যাঠা বাড়িতে এসেছেন জেনে হাসমত আলী একটি চিঠি লিখে অনুরোধ জানিয়ে বলেছিল সুযোগ ও সময় পেলে তিনি যেন ক্যাম্পে এসে দু-একদিন কাটিয়ে যান। কাজটি ঝুঁকিপূর্ণ কিন্তু জব্বার আলী মিয়ার সৈনিক সত্তা তাকে স্থির থাকতে দিল না। পথঘাটের খোঁজখবর নিয়ে মনে মনে প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে এক শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে তিনি আল্লাহ আল্লাহ বলে রওনা দিলেন। সবাইকে বললেন সাতক্ষীরা যাচ্ছেন। ক্যাম্পে পৌঁছে ভাতিজা হাসমত আলী নিজেই কমান্ডার শুনে দেখে বিশেষ প্রীত হলেন জব্বার আলী। ভাতিজার হাতে দুই হাজার টাকা তুলে দিলেন। বিকাল বেলা বটতলায় সমাবেশের আয়োজন করা হলো।
কমান্ডার হাসমত আলী সবার কাছে জ্যাঠাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর সবাই গান ধরল-
‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা।’
এই গান জব্বার মিয়া কখনও শোনেন নাই। গানের সুর তার মন স্পর্শ করল। তিনি কান উঁচিয়ে গানের কথাগুলো বোঝার চেষ্টা করলেন।
জব্বার আলী মিয়াকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য দাঁড়াতে হলো। তিনি বললেন-
বাবারা এ রকম যুদ্ধ আমি জীবনে দেখি নাই। এ রকম যুদ্ধের কথা কোনো দিন শুনি নাই। এ রকম যুদ্ধকে কী বলে তা-ও আমি জানি না। যে দেশের সেনাবাহিনী নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে পারে, সেটা কী রকম সেনাবাহিনী তা আমার বুঝে আসে না। যা-ই হোক, আমি তোমাদের দোয়া করতে এসেছি।
তোমরা যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নেমেছে তারা একটি নিয়মিত সেনাবাহিনী। তাদের অনেক ট্রেনিং হয়, নানা কিছু শিখতে হয়। শত্রুকে পরাভূত করার জন্য অনেক কৌশল তারা জানে। তাদের আছে নানা রকমের অস্ত্রপাতি আর গোলাবারুদ। তোমাদের অস্ত্র নাই; রাইফেল আছে তো গুলি নাই। প্রতিবেশী দেশ সাহায্য করবে শুনলাম। এই সাহায্যের অস্ত্র তোমাদের হাতে পৌঁছাতে আরও এক মাস বেশি দেরি আছে। তোমাদের ধৈর্য ধরে টিকে থাকতে হবে। তাদের মেশিনগান আছে, কামান আছে, মর্টার আছে। এ রকম শক্তিশালী একটি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তোমরা কীভাবে যুদ্ধ করবে তা আমার মাথায় আসছে না। তাদের ভালো ভালো গাড়ি আছে, যোগাযোগের জন্য ওয়্যারলেস আছে। আটকা পড়লে উদ্ধারের জন্য প্যারাট্রুপার পাঠানো হবে। সেই তুলনায় তোমাদের কিছুই নাই। কিন্তু বাবারা তোমাদের যা আছে তাদের সেটা নাই। তোমাদের আছে সাহস। তারা নিয়মিত সৈনিক হলেও এত সাহস তাদের নাই। যুদ্ধে ভয় থাকলে চলে না। তাদের ভয় আছে, তোমাদের মনে ভয় নাই। তোমরা আসছ দেশকে বাঁচানোর জন্য। তোমরা দেশকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ করছ। তোমাদের দেশপ্রেমের তুলনা হয় না। দেশপ্রেম একজন যোদ্ধার বড় সম্পদ, বড় শক্তি।
বাবারা, তোমাদের জন্য আমি মন থেকে দোয়া করতে থাকব। আল্লাহপাক তোমাদের সহায় হবেন। কিন্তু আমি সৈনিক ছিলাম। যুদ্ধ ব্যাপারটা কী, আমি ভালোই বুঝি। সেনাবাহিনীর সৈনিক হলেই যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে যুদ্ধ করার সৌভাগ্য সব সৈনিকের হয় না। আমার হয়েছে। আমি বাষট্টি সালে আর পঁয়ষট্টি সালে দুই-দুইবার সম্মুখ যুদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছি। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে দু-একটা কথা বলি।
এক নম্বর কথা : প্রস্তুতি ছাড়া যুদ্ধ করা বোকামি। বোকামি করা আর যুদ্ধ করা এক কথা না। তাই তাড়াহুড়া করে কোনো কাজ করবে না। যতক্ষণ প্রস্তুতি গ্রহণ শেষ না হবে ততক্ষণ শত্রুর সামনে পড়বে না। অপ্রস্তুত অবস্থায় শত্রু থেকে দূরে থাকবে।
দুই নম্বর কথা হলো প্ল্যান ছাড়া শত্রুর মোকাবিলায় যাবে না। প্ল্যান দুইটা লাগে। একটার কথা সবাই জানে। সেটা হলো শত্রুকে আক্রমণ করে পরাজিত করার প্ল্যান। কিন্তু প্ল্যানের দ্বিতীয় অংশটা আরও গুরুত্বপূর্ণ আর তা হলো প্রয়োজন হলে লড়াই থেকে ফিরে এসে প্রাণ বাঁচানোর প্ল্যান। ভালো সৈনিক যখন সামনে যায় তখন পিছন দিকে তাকিয়ে দেখে ফিরে যাওয়ার পথ খোলা আছে কিনা। তুমি যদি বেঁচে থাকো অনেকদিন যুদ্ধ করতে পারবে। অকালে জান দেওয়ার কোনো মানে হয় না। যেভাবে যুদ্ধ চলছে এই যুদ্ধ কবে শেষ হবে তা অনুমান করা অত্যন্ত কঠিন। তাই তোমাকে টিকে থাকতে হবে। মনে রাখবে, তোমার জন্য জানে বেঁচে থাকাটা জরুরি। জান বাঁচানোর স্বার্থে পশ্চাদপসরণ করা যুদ্ধের স্বাভাবিক কৌশল। এতে লজ্জার কিছু নেই।
একটু থামলেন জব্বার আলী মিয়া। গলা শুকিয়ে এসেছিল। চেয়ারে বসে পানি খেলেন এক গ্লাস। ছাই দিয়ে ভালোভাবে মাজা কাঁসার গ্লাসটা ঝকঝক করছে। বক্তৃতা করার কোনো অভিজ্ঞতা তার নেই। তিনি আর কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। যুদ্ধ কোনো খেলা নয়। এদেরকে সত্য কথাগুলি বলা দরকার।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন জব্বার আলী মিয়া।
বাবারা, তোমরা যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে যাচ্ছ তারা তোমাদের সরাসরি শত্রু না। তারা এই মাটির শত্রু। এই এলাকায় তারা এখনও আসে নাই। আসবে। তখন টের পাওয়া যাবে তাদের নৃশংসতা কেমন। একটা সেনাবাহিনী যখন যুদ্ধ করে তখন শুধু শত্রু নিধন করে না, অনেক অপকর্মও করে। প্রয়োজন না থাকলেও হত্যা করে, লুট করে, ধর্ষণ করে। তোমরা জেনেছ, এই কাজ তারা করেছে। মানুষের বাড়িতে আগুন দিয়েছে।
যুদ্ধের অন্যতম কৌশল হলো প্রতিপক্ষের সৈনিককে হত্যা করা। এই কাজটা সহজ না। কিন্তু যুদ্ধে এই কাজের বিকল্প নাই। শত্রুবাহিনীর প্রত্যেককেই শত্রু গণ্য করতে হবে। তোমরা যুদ্ধ করতে এসেছ। যুদ্ধক্ষেত্রে দয়ামায়া দেখানোর সুযোগ নেই। তুমি যদি আজ শত্রুকে ক্ষমা কর, ভালো কথা, কিন্তু মনে রাখতে হবে : সুযোগ পাওয়ামাত্র যাকে তুমি ক্ষমা করেছ সে ঘুরে দাঁড়িয়ে অস্ত্র হাতে নিয়ে তোমাকে শেষ করে ফেলতে একমুহূর্ত দ্বিধা করবে না। তোমাদের বেশিরভাগের শত্রুর গায়ে গুলি চালিয়ে শেষ করে দেওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। প্রথম গুলির নিশানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় মানুষের মনে নানা প্রশ্ন জাগে। মানবিক প্রশ্ন। মনুষ্যত্বের প্রশ্ন। এই সব প্রশ্ন বিভ্রান্ত করে দেয়। এই ফাঁকে শত্রু পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়। শত্রুকে পালিয়ে যেতে দেওয়া কোনো কাজের কথা না। মনে রেখো, যুদ্ধের সময় এক দিনে শত্রপক্ষকে হারিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। ধীরে ধীরে নানা ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে শত্রুকে দুর্বল করে ফেলতে হয়। দুর্বল শত্রু হার মানে অথবা পালিয়ে যায়। তাতে বিজয় সহজ হয়।
পৃথিবীতে ‘বাংলাদেশ’ নামে কোনো দেশ নাই। পৃথিবীতে বাঙালিদের জন্য কোনো আলাদা রাষ্ট্র নাই। তোমরা যুদ্ধ করতে আসছ পৃথিবীতে বাঙালিদের জন্য স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবে এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে। আমরা যখন সেনাবাহিনীতে ছিলাম, তখন সীমান্ত রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছি। আজকের যুদ্ধ নতুন সীমান্ত তৈরি করার জন্য যুদ্ধ।
বাবারা, অনেক কথা বলে ফেললাম। ঠিক বলেছি না বেঠিক বলেছি তা জানি না। কিন্তু একজন সৈনিক কী মনোবৃত্তি নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং শত্রুকে পরাভূত করার জন্য চেষ্টা করে সেই কথাগুলি তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমরা পাঞ্জাবি না মারাঠি না আমরা বাঙালি। আমরা যুদ্ধবাজ জাতি না। আমরা ঝগড়া-বিবাদ করি কিন্তু যুদ্ধ করার ইতিহাস আমাদের নাই। ব্রিটিশরা আর্মিতে আমাদের নেয় নাই। আমরা নরম মাটির নরম মানুষ। যুদ্ধ আমাদের নেশা না, পেশা না। আজ আমাদের ঘাড়ে যুদ্ধ এসে পড়েছে। এই যুদ্ধে আমাদের জিততে হবে। তাই হুঁশিয়ার থাকবে। প্রথম গুলির নিশানা যেন ঠিক থাকে। প্রথম গুলির নিশানা ঠিক থাকলে পরের গুলিগুলো ঠিকভাবে করতে পারবে। আল্লাহ তোমাদের হেফাজত করুন। জয় বাংলা।
Discussion about this post