গোলাম কিবরিয়া
দেশে যৌতুকবিরোধী আইন থাকা সত্ত্বেও বন্ধ করা যাচ্ছে না এই ঘৃণ্য প্রথা। যৌতুকের বলি হয়ে দেশে প্রতিবছর অনেক নারী প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ কেউ নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। সামাজিক এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ। গ্রাম থেকে শহরে, উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত- সব জায়গাতেই এই ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে দিন দিন। সমাজের এই মারাত্মক ব্যাধিটি বন্ধে আইনের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও অত্যন্ত জরুরি
যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি, যা নারী নির্যাতনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। ধর্মীয় ও আইনগত দিক থেকে অবৈধ এই কুপ্রথার শিকার হয়ে প্রতিদিনই কোনো না কোনো নারী নিগৃহীত হচ্ছেন। একটা সময়ে প্রচলিত ধারণা ছিল, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বা অশিক্ষিত সমাজেই যৌতুকের প্রথা রয়েছে। কিন্তু আধুনিক শিক্ষিত সমাজেও যৌতুক যে বিদ্যমান, তা বিভিন্ন ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। যৌতুকের কারণে যেসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, তার এক ক্ষুদ্র অংশ আইন-আদালত কিংবা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়। কোনো কোনো পরিবার রয়েছে, যারা যৌতুকের কারণে নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা প্রকাশ করতে চায় না সামাজিক লোকলজ্জার ভয়ে। চলতি বছরের ২৩ মার্চ একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরের তথ্যমতে, জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার আহম্মেদাবাদ বোড়াই গ্রামের জোছনা বেগম স্বামীর মৃত্যুর পর দুই মেয়েকে নিয়ে পড়েন বিপাকে। ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন ওই নারী।
মেয়েরা বড় হয়ে উঠছে, বিয়ে দিতে হবে আর এ জন্য প্রয়োজন অর্থের। চিন্তায় পড়ে যান তিনি। হঠাৎ শুনতে পান, একজনের একটি কিডনি নষ্ট। জোছনা সিদ্ধান্ত নেন, তিনি তাকে একটি কিডনি দেবেন এবং বিনিময়ে অনেক টাকা পাবেন। সেই টাকা দিয়ে মেয়েদের বিয়ে দেবেন। এমন আশায় তিন লাখ টাকায় একটি কিডনি বিক্রি করেন তিনি। মেয়ের বিয়েতে যৌতুকের চাহিদা মেটাতে গিয়ে মায়ের কিডনি বিক্রির ঘটনা সমাজে বিরল। এমন ঘটনা বিবেকবান মানুষকে ব্যথিত করেছে। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাসের পারিবারিক সহিংসতায় নারী নির্যাতনের যে চিত্র প্রকাশ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, তা সত্যিই ভীতি-জাগানিয়া। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর- এই ৯ মাসে পারিবারিক সহিংসতায় নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে মোট ৫২৭টি। এর মধ্যে স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৫৬ নারী, স্বামীর পরিবারের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন ১৮ নারী। স্বামী দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছেন ১৮০ জন। স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে মৃত্যুবরণ করেছেন ৬০ জন। নিজের পরিবারের দ্বারা হত্যার শিকার হয়েছেন ৬৩ নারী, নিজের পরিবারের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩২ নারী।
পারিবারিক সহিংসতার দরুন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন ১১৮ নারী। সর্বমোট ৫২৭টি নির্যাতন ও হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ২২৮টি ঘটনায়, বাকি ২৯৯টি ঘটনায় কোনো মামলাই হয়নি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যানুসারে, ২০২১ সালে ১০ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) পর্যন্ত নারী নির্যাতনের তিন হাজার ১২৮টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ধর্ষণ হয়েছে ৮৯০টি, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৫৯টি, বাল্যবিয়ে ২১০টি এবং যৌতুকের কারণে হত্যা হয়েছে ৪০টি। আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ উপলক্ষে নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনে এ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। মহিলা পরিষদ থেকে বলা হয়েছে, দেশের ১৩টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকা পর্যালোচনা করে নারী নির্যাতনের এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
তবে এগুলো পূর্ণাঙ্গ কোনো তথ্য নয়। বাস্তব অবস্থার সামান্য চিত্র মাত্র। সম্প্রতি কুমিল্লায় যৌতুকের টাকা দিতে দেরি হওয়ায় এক এইচএসসি পরীক্ষার্থীকে বেদম মারধর করে নির্মমভাবে হত্যা করার অভিযোগ উঠেছে স্বামীসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে। নিহত ওই এইচএসসি পরীক্ষার্থীর নাম তামান্না আক্তার কনা (২০)। যৌতুকের এ চিত্র শুধু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। ভয়াবহ এ চিত্র বন্ধ নেই ফ্ল্যাটবাড়িতে থাকা নারীদের জীবনেও। আবহমানকাল ধরেই যৌতুকের দাবিতে বাংলার মেয়েদের নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সামাজিক এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে রল্প্রেব্দ রল্প্রেব্দ। গ্রাম থেকে শহরে, উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত- সব জায়গাতেই এই ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছে দিন দিন। বিয়ের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বরপক্ষ-কনেপক্ষের মধ্যে অর্থসামগ্রী আদান-প্রদানের প্রথাই পণপ্রথা। বরপক্ষ যখন কনেপক্ষকে এই পণ দেয়, তখন সেটাকে বলা হয় কনেপণ।
অন্যদিকে বরপণপ্রথায় কন্যাপক্ষ থেকে সামগ্রী-অর্থ দিতে হয় বরপক্ষকে। সেটাকে বলা হয় যৌতুক। এভাবে স্থাপিত প্রত্যেক বিয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে কনে ও বরের পরিবারের মধ্যে। অতীতে ইউরোপে এ রকম যৌতুক বিবাহ ও কন্যাপণ বিবাহ দুই-ই প্রচলিত ছিল। কালক্রমে তা সমাজ থেকে তিরোহিত হয়েছে। বাঙালি সংস্কৃতি, সমাজ ও পরিবার কাঠামোর বৈশিষ্ট্যের জন্য পাত্র-পাত্রীর বিয়ে হয় দুই পরিবারের মধ্যে। এ রকম বিয়ের ক্ষেত্রে কনেপক্ষের ওপর যৌতুক দেওয়ার চাপ পড়ে। এভাবেই বাঙালি সমাজে বাধ্যতামূলক বরপণপ্রথা প্রচলিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যেও উঠে এসেছে যৌতুক প্রসঙ্গ। যেখান থেকে অনুমান করা যায় এ কুপ্রথা বহু পুরোনো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গ্রন্থভুক্ত গল্পগুলো তার সময়োচিত চিন্তার ফসল। গল্পে উঠে এসেছে বহুবিচিত্র চরিত্র ও আখ্যান, নারী নির্যাতন ও নিষ্পেষণের করুণ কাহিনি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে যৌতুক প্রসঙ্গ বইটি সংকলকের ভূমিকায় ছিলেন মালেকা বেগম। গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘দেনা পাওনা’। সংকলকের ভাষায় বাংলা সাহিত্যে এটিই যৌতুক বা পণপ্রথা নিয়ে প্রথম ছোটগল্প। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতা সামাজিক এ বর্বরোচিত নিয়মের ভেতর হয়ে পড়েছিলেন অন্তরীণ।
গল্পগুলোতে আমরা দেখি, নারী হতাশায় দিন দিন মৃত্যুর পথে ধাবিত হচ্ছে। কেউ নিজের গায়ে আগুন দিয়ে আত্মাহুতি করছে। দেশ থেকে যৌতুকপ্রথা দূর করতে বাংলাদেশের সরকার ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করেছিল। ওই আইনে বলা হয়েছিল, যৌতুক গ্রহণকারী ও যৌতুক প্রদানকারী উভয়েই সমান অপরাধী। তারা উভয়েই সর্বোচ্চ এক বছর মেয়াদের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সরকার সম্প্রতি যৌতুক আদান-প্রদান প্রতিরোধে ১৯৮০ সালের আইনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। ২০১৮ সালের মে মাসে ‘যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। নতুন আইনে শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ দুটিই বাড়ানো হয়েছে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, কেউ যৌতুক দাবি করলে তিনি পাঁচ বছরের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সমাজ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সমাজের এই মারাত্মক ব্যাধিটি বন্ধে সর্বপ্রথম আইনের সংশোধন প্রয়োজন। তবে আইনের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও অত্যন্ত জরুরি।
Discussion about this post