সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, শিক্ষাবিদ
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। চিন্তক-শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক, শিল্পসমালোচক। স্বাধীনতা-বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীতে সমকালের সঙ্গে কথোপকথনে তিনি জানিয়েছেন, এখনও এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উদ্দেশ্য নতুন প্রজন্মকে চাকরির বাজারে ঢোকার একটা উপায় করে দেওয়া। ফলে প্রকৃত বিজ্ঞানী ও সমাজচিন্তক অথবা উদ্যোক্তা দেখা দিচ্ছে না। কিন্তু এখন প্রয়োজন শিক্ষার্থীদের মননশীলতা ও সৃজনশীলতা এবং আত্মশক্তি জাগিয়ে তোলা।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি আমরা। বিগত ৫০ বছরে শিক্ষা খাতে আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ফারাক কতটুকু ও কী কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :নতুন স্বাধীনতা পাওয়া একটা দেশের প্রত্যাশা, জীবনের সকল ক্ষেত্রেই থাকে আকাশচুম্বী। সেই দেশের স্বপ্ন যদি হয় সোনার বাংলায় রূপান্তরিত হওয়ার, তাহলে যে নতুন ঔপনিবেশিক শক্তি দেশটিকে শাসন ও শোষণ করেছে ২৪টি বছর, তার তুলনায় অনেক এগিয়ে যাওয়া হয়ে দাঁড়ায় একটা প্রতিজ্ঞা। পাকিস্তান আমলে ষাটের দশকের শুরু থেকেই সেই রাষ্ট্রের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে আমরা সংগ্রাম করেছি। আশা করেছি আমাদের শিক্ষানীতি হবে সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমরা আশা করেছি সবাই শিক্ষিত হবে। শিক্ষায় থাকবে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির প্রতিফলন। ভবিষ্যতের জন্য সব করণীয় থাকবে সেই শিক্ষায়।
প্রাপ্তিটা সেই তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে, তবে সকল ক্ষেত্রে নয়। শুরুটা ছিল খুবই আশাব্যঞ্জক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব জানতেন, শিক্ষা আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল। তিনি সে অনুযায়ী কাজ করেছেন। একজন সংস্কৃতিমনা শিক্ষাবিদকে দিয়ে একটি কমিশন করে দিয়েছেন। কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন ছিল একটা চমৎকার দলিল, এগিয়ে যাওয়ার ভিত্তি। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিমনস্ক শিক্ষার স্বপ্ন বিদায় নিল।
এখন আমাদের শিক্ষার বিস্তার বেড়েছে. প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি, মেয়েদের শিক্ষায় অংশগ্রহণ বিস্ময়কর। তিনটি ক্ষেত্রে অগ্রগতি দৃশ্যমান-শিক্ষায় অংশগ্রহণের সর্বজনীন সুযোগ, সীমিত সাধ্যে সেই সুযোগ উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত টেনে নেওয়া এবং সমাজে শিক্ষা নিয়ে ব্যাপক আগ্রহ। বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা নিয়ে।
কিন্তু মানের ঘরে রয়ে গেছে প্রচুর ঘাটতি। মেয়েরা বিজ্ঞান শিক্ষায় আরও পিছিয়ে। শিক্ষার মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তবে যে গতিশীলতা মানুষ শিক্ষা থেকে আশা করে, তার বিচারে শিক্ষাকে একদিন এগোতেই হবে। সেই যাত্রা মোটামুটি শুরু হয়ে গেছে।
দক্ষ মানবসম্পদ ও বিশ্বমানের সুনাগরিক গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী শিক্ষা। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তা পারছে কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :না, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও সেই লক্ষ্যের দিকে এগোতে পারেনি। গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমরা যে শিক্ষা দিচ্ছি, তা একান্তভাবেই মুখস্থনির্ভর, পরীক্ষাপ্রধান ও সনদমুখী শিক্ষা। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে চাকরির বাজারে ঢোকার একটা উপায় করে দেওয়া। মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়ে প্রকৃত বিজ্ঞানী বা সমাজচিন্তক অথবা উদ্যোক্তা হওয়া যায় না। সৃজনশীল শিক্ষা, সংস্কৃতিঋদ্ধ শিক্ষা আমরা দিতে পারিনি। কিছু কাজ সম্প্রতি শুরু হয়েছে। কিন্তু পাঠ্যক্রম, শিক্ষাদান ও মূল্যায়ন পদ্ধতির আমূল সংস্কার ছাড়া ওই শিক্ষা দিতে পারব না।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় পরীক্ষাই মূল্যায়নের একমাত্র ব্যবস্থা। পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার বাণিজ্যায়ন বাড়িয়ে তোলে। আপনি কী মনে করেন?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :অবশ্যই। এই প্রসঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কোনো অবকাশ নেই। পৃথিবীর অনেক দেশেই পরীক্ষাভিত্তিক মূল্যায়ন কমিয়ে জ্ঞান, সৃজনশীলতা এবং দক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়ন হচ্ছে। মুখস্থ করার পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের তাদের নিজেদের দক্ষতা, সৃজনশীলতার ওপর নির্ভর করাকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। মুখস্থ করে পরীক্ষা দেওয়ার পদ্ধতিটি সর্বেসর্বা হওয়ার জন্য কোচিং এবং নোট-গাইড বইবাণিজ্য এখন হাজার হাজার কোটি টাকার। তাদের চাপে পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণি সমাপনী পরীক্ষা দুটি চালু হলো এবং গ্রাম পর্যন্ত এই ব্যবসা সম্প্রসারিত হলো। এই ফাঁদ থেকে আমাদের বের হতে হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে অনেক কথা চলছে। শিশুদের এ পরীক্ষা থাকা নিয়ে আপনার অভিমত কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :এটি অত্যন্ত অপ্রয়োজনীয় একটি পরীক্ষা। এতে শিক্ষার্থীদের শেখার আনন্দ নষ্ট হয়, সৃজনশীল ভাবনা ও সক্ষমতার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং পরীক্ষা নিয়ে ভীতি বাড়ে। মুখস্থ করে জিপিএ ৫ ইত্যাদি পেয়ে বরং মেধা নিয়ে একটা অপ্রকৃত ধারণা তৈরি হয়, যা পরে ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
না চাইলেও মুখস্থনির্ভর শিক্ষা, নোট-গাইড এবং কোচিং সেন্টার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তব চিত্র। এ থেকে পরিত্রাণের পথ কী হতে পারে বলে মনে করেন?
পরিত্রাণের পথ তিনটি- এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা (যার জন্য শুরুতেই প্রয়োজন কুদরাত-এ-খোদা শিক্ষা কমিশন প্রতিবেদনকে এই সময়ের আলোকে নবায়ন করে তা সক্রিয় করা), যাতে মুখস্থ করা, নোট বই, গাইড বইনির্ভর শিক্ষাকে বাদ দিয়ে প্রকৃত সৃজনশীল এবং জ্ঞান ও দক্ষতানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা যায়। শিক্ষায় বাজেট বরাদ্দ বাড়িয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতায় যোগ দিতে উৎসাহিত করে প্রচুর উদ্ভাবনশীল এবং অনুপ্রেরণাদানকারী শিক্ষক তৈরি করা এবং পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি অন্য অনেক বই ও ইন্টারনেটের জ্ঞান রাজ্যে শিক্ষার্থীদের বিচরণ নিশ্চিত করা।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে নতুন কারিকুলাম তৈরি হচ্ছে। এ কারিকুলাম সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :আমাদের শিক্ষামন্ত্রীর উদ্যোগে একটা চমৎকার কারিকুলাম তৈরি হয়েছিল, যা প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ধারাবাহিক ও সমন্বিতভাবে শিক্ষাপ্রবাহ নিশ্চিত করবে। শুনেছি প্রাথমিকের আলাদা পাঠ্যক্রম তৈরি হচ্ছে। এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আরও ভয়ের কথা, প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে প্রাথমিক শিক্ষাবোর্ড করা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপ ক্ষতিকর। তাছাড়া ২০১০ সালের শিক্ষানীতিতে বলা হচ্ছে, প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। আমি মনে করি, প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা ধারাবাহিক শিক্ষার কারিকুলামই বরং চালু করা উচিত।
কভিডকালে আমাদের শিক্ষা খাতের প্রভূত ক্ষতি করেছে যেমন, তেমনি বাড়িয়ে তুলেছে বৈষম্য। এ থেকে উত্তরণের পথ কী?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :বস্তুগত ক্ষতি, এমনকি সময়ানুক্রমে এক বছর, দেড় বছর পিছিয়ে পড়ার ক্ষতি পুষিয়ে ওঠাটা পরিশ্রমসাধ্য, কিন্তু অসম্ভব নয়। শিক্ষাঘণ্টা বাড়িয়ে, পরীক্ষা কমিয়ে, ইন্টারনেট ও দূরশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে, পাঠ্যক্রমে কিছুটা পরিবর্তন এনে পিছিয়ে পড়ার ক্ষতি কাটানো যায়। শিক্ষকদের প্রণোদনা দিয়ে তাদেরও অতিরিক্ত সময় দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু বৈষম্য কাটিয়ে ওঠা প্রায় অসম্ভব। সে জন্য দরিদ্র পরিবারগুলোতে সহায়তা দিতে হবে। বৃত্তির সংখ্যা ও টাকার পরিমাণ বাড়াতে হবে। পাশাপাশি ডিজিটাল বৈষম্য নিরসনের জন্য সারাদেশে সমীক্ষা করে অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের তালিকা করে সবাইকে বিনামূল্যে ইন্টারনেট সংযুক্তিসহ একটা ল্যাপটপ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পৌঁছে দিতে হবে। এর জন্য পর্যাপ্ত অর্থের জোগান রাষ্ট্রকেই দিতে হবে।
শিক্ষা খাতে শিক্ষক নিয়োগ থেকে নানা ক্ষেত্রে দুর্নীতি এক কঠিন বাস্তবতা। শিক্ষা খাতে দুর্নীতি প্রতিরোধের পথ কী হতে পারে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :দুর্নীতি প্রতিরোধের উপায় হচ্ছে আইনের শাসন নিশ্চিত করা, দুর্নীতিবাজদের শাস্তি নিশ্চিত করা। নজরদারি বাড়ানো, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প ও কর্মকর্তানির্ভর ব্যয়বহুল প্রকল্প বন্ধ করে সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে সেই অর্থ প্রকৃত কাজে লাগানো। শিক্ষকদের বেতনভাতা পর্যাপ্ত করলে তাদের ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমিয়ে আনা সম্ভব।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ‘শিক্ষক, শিক্ষাক্রম, পাঠ্যপুস্তক এবং অবকাঠামো’ এই চারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব প্রায়ই পরিলক্ষিত হয়। আপনার মূল্যায়ন কি?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :সমন্বয়ের অভাব আসে সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব থেকে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আলাদা (এবং অনেক সময় বিপরীতমুখী) চিন্তাভাবনা থেকে এবং উদ্যোগের অভাব থেকে। শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক থেকে তৈরিতে শিক্ষকদের মতামত নেওয়া হয় না। শিক্ষা ব্যবস্থাপনাতেই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। অবকাঠামোর পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোনো অংশগ্রহণ নেই। যদি তাই হয়, তাহলে সমন্বয় হবে কীভাবে?
আগামী ৫০ বছরে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে আমরা কোথায় নিয়ে যেতে চাই? এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশা কী হতে পারে?
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :প্রথম প্রশ্নের উত্তরে ফিরে যাই। সোনার বাংলা গড়ার জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা আমরা চেয়েছিলাম, যার প্রতিফলন কুদরাত-এ-খোদা শিক্ষা কমিশনে দেখেছি, তার থেকেও উন্নত ও যুগোপযোগী শিক্ষা কার্যক্রম আমাদের চালু করতে হবে। এতে অনেক কিছুর সঙ্গে তিনটি ক্ষেত্রে মনোনিবেশ একান্ত জরুরি।
প্রথমত. শিক্ষার্থীদের মননশীলতা, সৃজনশীল ভাবনা, বিজ্ঞান, ভাষা ও গণিতে দক্ষতা অনেকগুণ বাড়ানো ও তাদের নিজের ক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল করে তাদের আত্মশক্তি জাগানো। দ্বিতীয়ত. চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দাবিগুলো মনে রেখে শিক্ষা কার্যক্রমকে ভবিষ্যৎমুখী করা। তৃতীয়ত. একমুখী শিক্ষার প্রচলন করা, যাতে ধর্মীয় শিক্ষার মান বাড়ানো হবে, সেই শিক্ষায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সমাবেশ ঘটানো হবে, মাতৃভাষায় দক্ষতা বাড়ানো হবে, অন্য একটি ভাষাও (ইংরেজি) এমনভাবে শেখানো হবে যাতে এতেও শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়।
সমকাল :আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম :সমকালকেও ধন্যবাদ।
Discussion about this post