আবদুল্লাহ আল মামুন
নিশুতি রাত। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন চট্টগ্রাম। দামপাড়ার জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠে আসছেন মুক্তিকামী একদল বিপ্লবী। কেননা সেই পাহাড়শ্রেণির ওপরেই রয়েছে ব্রিটিশ পুলিশের রিজার্ভ ব্যারাক ও অস্ত্রাগার। সেখানেই আক্রমণ চালালেন তারা। কারণ, তারা যে অগ্নিশপথ নিয়েছেন দেশকে স্বাধীন করার। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল তাদের আকাশকাঁপানো স্লোগান, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’।
আকস্মিক এ আক্রমণে কেবল গার্ড রুম থেকে নয়-ব্যারাক থেকেও পালিয়ে যায় ইংরেজ বাহিনী। চট্টগ্রামে পতন ঘটে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজের। ইংরেজদের দর্প চূর্ণ করে ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল সেখানে প্রতিষ্ঠা হয় স্বাধীন প্রজাতান্ত্রিক চট্টগ্রামের সদর দপ্তর। পত পত করে উড়তে থাকে বিপ্লবী পতাকা। সামরিক কায়দায় অভিবাদন গ্রহণ করেন বিদ্রোহের সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন।
মাত্র চার দিন স্থায়ী ছিল সেই স্বাধীনতা। কিন্তু ওই চার দিনেই মুক্তির উদ্দীপনা ছড়িয়ে দিয়েছিল এ ঘটনা সারা ভারতে।
আজ থেকে ৯১ বছর আগে মাস্টারদা সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘোষ, লোকনাথ বল প্রমুখ বিপ্লবী যেখানে ইতিহাস রচনা করেছিলেন, সেই ‘অস্ত্রাগারটি’ নগরের দামপাড়া পুলিশ লাইনে এখনও দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও ফের গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এই এলাকা। কারণ অস্ত্রাগারের পাশে ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতিতে তৈরি একতলার ছোট পুলিশ লাইন থেকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালানো হয় তখন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সংঘটিত নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এ স্থানেই জাদুঘর গড়ে তোলার কাজ করছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে বীর চট্টলার ভূমিকা ইতিহাসে সুপ্রতিষ্ঠিত। পূর্ণেন্দু দস্তিদারের লেখা ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রাম’, অনন্ত সিংহের ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ কিংবা লোকনাথ বলের লেখা ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’সহ নানা বইয়ে বর্ণনা রয়েছে এসব ঘটনার। অস্ত্রাগারের পাশেই ব্রিটিশরা তাদের স্থাপত্যরীতিতে তৈরি করেছিল একতলার ছোট পুরোনো পুলিশ লাইন। এখানে একাত্তরের ২৮ মার্চ ভোরে আক্রমণ করে পাকিস্তান বাহিনী। প্রতিরোধ গড়ে তোলেন পুলিশের সদস্যরা। শহীদ হন তৎকালীন চট্টগ্রামের এসপি শামসুল হক, ওসি আবদুল খালেকসহ ৫১ জন পুলিশ সদস্য। এছাড়াও বিভিন্ন যুদ্ধে শহীদ হন ৮২ জন পুলিশ সদস্য। তাদের আত্মদানের ইতিহাসও স্থায়ীভাবে রেখে দেওয়া হবে এ জাদুঘরে।
চট্টগ্রাম মহানগরের ওয়াসা থেকে জিইসি যাওয়ার পথে ডান পাশে উঁচু টিলায় দেখা মেলে এ দালানের। এর সামনে একপাশে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ মিনার।
অন্যপাশে স্থাপন করা হয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্মারক কামান। অস্ত্রাগার আর পুলিশ ব্যারাক অক্ষত রেখে সংস্কারের মাধ্যমে নবরূপ দেওয়া হচ্ছে এটিকে। দালানের দেয়ালে রয়েছে পোড়ামাটির টেরাকোটা। এখানে রয়েছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা মাস্টারদা সূর্য সেন ও প্রথম নারী শহীদ বিপল্গবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের ম্যুরাল। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণের ম্যুরাল ও রেডিওতে পুলিশ সদস্যদের স্বাধীনতা ঘোষণা শোনার দৃশ্যও তুলে ধরা হয়েছে টেরাকোটা মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে। দুই ভবন ঘিরে ১৬ হাজার বর্গফুট এলাকায় জাদুঘর নির্মাণের কাজ চলছে এখন।
জাদুঘর নির্মাণের কাজ তত্ত্বাবধানের শুরু সিএমপির সাবেক অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (সদর) মইনুল ইসলামের মাধ্যমে। তিনি বর্তমানে চাঁদপুর জেলা পুলিশের অতিরিক্ত সুপার। মইনুল ইসলাম বলেন, ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের বীজ বপন করে। তাই অস্ত্রাগারটির অবস্থানে জাদুঘর গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন সিএমপি কমিশনার।’
সিএমপি কমিশনার সালেহ্ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, ‘এটা অনেক বড় গৌরবের ইতিহাস। দেরিতে হলেও আমরা এই ইতিহাস-ঐতিহ্য পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করছি।’
Discussion about this post