আশিক মুস্তাফা
বছরটা কেমন গেল- আমাদের এই উন্মাদ দুনিয়ায় যারা নতুন অতিথি, যারা তালগাছের মতো মাথা তুলে দাঁড়াতে শুরু করেছেন নিজেদের কাজ দিয়ে, প্রতিনিধিত্বশীল এই স্বপ্নবাজদের কাজ আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য ও স্বপ্ন-সম্ভাবনাকে উস্কে দেন প্রতিনিয়ত।
মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাত
গত ১৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট জর্জে অনুষ্ঠিত আয়রনম্যান ৭০.৩ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাত। প্রতিযোগিতার নির্দিষ্ট সময়ের কম সময়, পাঁচ ঘণ্টা ১৫ মিনিট ৪৩ সেকেন্ড সময় নিয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন করেন। এই সময়ে আরাফাত ১.৯৩ কিলোমিটার সাঁতার, ৯০ কিলোমিটার সাইক্লিং ও ২১.১ কিলোমিটার দৌড়ান। এ ছাড়া তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সল্ট লেক সিটিতে ব্রাইনম্যান ট্রায়াথলনের অলিম্পিক ডিসট্যান্স ট্রায়াথলনে বিজয়ী হিসেবে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। তিনি প্রথম আয়রনম্যান আয়োজনে অংশ নেন ২০১৭ সালে মালয়েশিয়াতে। এরপর ২০১৯ সালে আয়রনম্যান ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে এবং একই বছর আয়রনম্যান মালয়েশিয়া ও ২০২০ সালে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আয়রনম্যান ৭০.৩-এ অংশ নেন। ১৯৯০ সালের ১০ জানুয়ারি নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার মুছাপুর গ্রামে আরাফাতের জন্ম। গ্রামেই তার বেড়ে ওঠা। পরপর সাত বছরে সাতবার বাংলা চ্যানেল সাঁতরে পাড়ি দেওয়া আরাফাত সামনের দিনে পাড়ি দিতে চান ইংলিশ চ্যানেল। এ ছাড়া খেলাধুলার বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের ভিত আরও মজবুত করতে চান। সেই লক্ষ্যে কাজও করে যাচ্ছেন।
মুনজেরিন শহীদ
২০২০ সালের মতো ২০২১ সালেও আলোচনায় ছিলেন মুনজেরিন শহীদ। মুনজেরিনের অনলাইনযাত্রা ২০২০ সালের এপ্রিলে। তিনি এপ্রিলের ১৭ তারিখ প্রথম ভিডিও আপলোড করেন নিজের ইউটিউব চ্যানেলে। সে ভিডিও দেওয়ার পর বুক ঢিপঢিপ করে। ভেবেছিলেন, হয়তো কেউ দেখবেনই না তার ভিডিও। আর দু-একজন দেখলেও করবেন হাসাহাসি। কিন্তু না। পেতে থাকেন প্রশংসা। দু’দিনের মধ্যে এক মিলিয়ন ভিউ হয়ে যায়। ইউটিউব চ্যানেলের পাশাপাশি নিজের ফেসবুক পেজও খুলেছিলেন মুনজেরিন। মুনজেরিনের ভিডিও লেসন আলোচনায় আসতেই ২০২০ সালের জুলাই মাসে অনলাইনে ‘ঘরে বসে স্পোকেন ইংলিশ’ বইটি প্রকাশ করেন। প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই সর্বোচ্চ বিক্রির রেকর্ড গড়ে বইটি। প্রায় ৪০ হাজার কপি বিক্রি হয়। চলতি বছরের শুরুর দিকে ‘সবার জন্য ভোকাবুলারি’ শিরোনামে দ্বিতীয় বই প্রকাশ করেন। তাও গড়ে বিক্রির রেকর্ড। পাঠকপ্রিয়তা দেখে দুটি বই অমর একুশে বইমেলায়ও প্রকাশ করা হয়। মুনজেরিনের এত পাঠক বা শিক্ষার্থীর মূল রহস্য নিজস্বতা। সেইসঙ্গে আছে সহজ উদাহরণের মাধ্যমে বোঝানোর যোগ্যতা। তিনি রাজ্যের নিয়মকানুন থেকে মুখ ফিরিয়ে নিজের মতো সহজ একটা কৌশল তৈরি করতে পেরেছেন।
সাবিনা খাতুন
দেশের নারী ফুটবলের আলোচিত নাম সাবিনা। নারী ফুটবল দলের বর্তমান অধিনায়ক সাবিনা খাতুন। তার হাত ধরে গত ১০ বছরে দেশের নারী ফুটবল এগিয়েছে অনেকদূর। নারী ফুটবলের অনেক রেকর্ডও তার গড়া। পেয়েছেন গোলমেশিন উপাধিও। সব ধরনের ফুটবলে ৩৭১ গোল করেন সাবিনা। তবে মেয়েদের ফুটবল লিগে শততম গোলের মাইলফলক ছুঁয়েছেন গত ২০ জুন সদ্য পুস্করিণী যুব স্পোর্টিং ক্লাবের বিপক্ষে। সাবিনা খাতুনের জন্ম সাতক্ষীরায়। বাবা মো. সৈয়দ গাজী ও মা মমতাজ বেগম। পরিবারের চতুর্থ সন্তান সাবিনা। ২০০৭ সাল থেকে খেলছেন ফুটবল। তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় সাতক্ষীরা জেলা ফুটবল কোচ আকবরের মাধ্যমেই ফুটবলে হাতেখড়ি তার। এরপর স্কুল পর্যায়ে আন্তঃস্কুল ও আন্তঃজেলা পর্যায়ে ভালো খেলে ডাক পান জাতীয় দলে। ২০০৯ সালে অভিষেক হয় জাতীয় নারী ফুটবল দলে। ভারত ও মালদ্বীপের ঘরোয়া লিগে খেলে এখন স্বপ্ন দেখছেন ইউরোপের লিগে খেলার। সাবিনার স্বপ্নজুড়েই ফুটবল। দেশের নারী ফুটবলকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান স্বপ্নবাজ সাবিনা। দেশকে সাফ চ্যাম্পিয়ন করাটাই এখন তার প্রথম স্বপ্ন। হয়তো অচিরেই তার সেই স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখবেন দেশের ফুটবলপ্রেমীরা!
শারমিন আক্তার সুপ্তা
২৩ নভেম্বর ওয়ানডে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের ম্যাচে যুক্তরাষ্ট্রের বিপক্ষে ১৩০ রানের অনবদ্য এক ইনিংস খেলেন। বাংলাদেশের মেয়েদের ওয়ানডে ইতিহাসে এটিই প্রথম সেঞ্চুরি। তবে যুক্তরাষ্ট্র নারী ক্রিকেট দলের ওয়ানডে স্বীকৃতি না থাকায় ম্যাচটিকে লিস্ট ‘এ’ ক্যাটাগরিতে বিবেচনা করছে আইসিসি। শারমিনের সেঞ্চুরির দিনে ৩২২ রানের পাহাড় গড়ে বাংলাদেশ। জবাবে ৫৩ রানে গুটিয়ে যায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ পায় ২৬৯ রানের বিশাল ব্যবধানে জয়। ইনিংসের শুরুতে নেমে শারমিন ব্যাটিং করেছেন ৫০ ওভার। ১৪১ বলের ইনিংসে বাউন্ডারি মেরেছেন ১১টি। শারমিনের জন্ম গাইবান্ধার বালুয়াবাজার এলাকায়। বাবা মৃত আবদুস সালামের বাড়ি গাইবান্ধা সদরের রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নে। ২০১১ সালের বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে অভিষেক হয় শারমিনের। সেই ম্যাচে বাংলাদেশের প্রথম নারী ক্রিকেটার হিসেবে অর্ধশত রান করেন শারমিন। ম্যাচটি ছিল বাংলাদেশের মেয়েদের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ। খেলার পাশাপাশি শারমিন স্নাতকোত্তর করছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তার পড়ার বিষয় সরকার ও রাজনীতি। শারমিনদের হাত ধরে অচিরেই আসবে নারী বিশ্বকাপের ট্রফি; এমন স্বপ্ন দেখতেই পারি।
ফয়সাল ইসলাম
সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে জীবনের সঙ্গে লড়ে শেষ পর্যন্ত মারা যান ফয়সালের একান্ত প্রিয় বন্ধু। দিতে পারেননি চিকিৎসাসেবা। আর এই দুর্ঘটনা থেকেই তার মাথায় আসে নতুন আইডিয়া। গড়ে তোলেন ‘সেইফহুইল’ নামে প্রতিষ্ঠান। নামমাত্র খরচে বর্তমানে সাধারণ মানুষের চিকিৎসায় অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি মেডিকেল সেবাও দিচ্ছে সেইফহুইল। মূলত প্রান্তিক মানুষের সেবার জন্য শুরু করেন তিন চাকার এই অ্যাম্বুলেন্স সেবা। তিন চাকার এই অ্যাম্বুলেন্সে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আলোচনায় আসেন ফয়সাল ইসলাম। ৫৪ দেশের আন্তর্জাতিক জোট কমনওয়েলথ। চলতি বছর কমনওয়েলথভুক্ত ৫৪টির মধ্যে ৪৩ দেশ থেকে এক হাজার আবেদন জমা পড়ে কমনওয়েলথ ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ডের জন্য। যাচাই-বাছাই শেষে পাঁচ অঞ্চল থেকে ২০ জনকে চূড়ান্ত করে কর্তৃপক্ষ। ২০ জনের মধ্যে আবার আফ্রিকা, ক্যারিবীয়, ইউরোপ, কানাডা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় পাঁচ ক্যাটাগরিতে পাঁচজনকে আঞ্চলিক বিজয়ী ঘোষণা করে কমনওয়েলথ। নির্বাচিত পাঁচজনের মধ্যে একজনকে এ বছরের সেরা সম্মাননা ‘কমনওয়েলথ ইয়ং পারসন অব দ্য ইয়ার’ প্রদান করা হয়। এশিয়া অঞ্চল থেকে আঞ্চলিক বিজয়ী হয়েছেন ফয়সাল ইসলাম।
মাহমুদা সুলতানা
আকাশ জয়ের অগ্রযাত্রায় আমেরিকার হিউস্টনের নাসাকে টেক্কা দেওয়ার সক্ষমতা কিংবা প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ আর কোনো প্রতিষ্ঠান এখনও অর্জন করতে পারেনি। কারণ, নাসা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে বের করেছে গণিত, পদার্থবিদ্যা আর রসায়নসহ বিজ্ঞানের নানা শাখার সেরা প্রতিভাবানদের। এই সেরা প্রতিভাবানদেরই অন্যতম একজন আমাদের মাহমুদা সুলতানা। বাংলাদেশি এই তরুণ বিজ্ঞানী পেশায় মূলত একজন অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ার। যিনি সম্প্রতি নাসায় ইনস্ট্রুমেন্ট ও পে-লোড সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ারিং ব্রাঞ্চের অ্যাসোসিয়েট ব্রাঞ্চ হেডের দায়িত্ব পালন করছেন নাসার গোডার্ড সেন্টারে।
২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর প্রথম বাংলাদেশি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে নাসায় যোগ দিয়েছিলেন সিলেটের মেয়ে মাহজাবীন হক। ২০২১ সালের ২ মার্চ নাসার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বিশেষ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয় মাহমুদা সুলতানার। নতুন প্রজন্মের এই বিজ্ঞানীর নতুন বৈজ্ঞানিক অগ্রযাত্রার কথা উঠে আসে এই সাক্ষাৎকারে। বাংলাদেশি এই তরুণ বিজ্ঞানী ২০১৭ সালে নাসার ‘গডার্ডস এফওয়াই সেভেন্টিন আইআরএডি ইনোভেটর অব দ্য ইয়ার’ হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন।সৌজন্যে-সমকাল
Discussion about this post