গোলাম কিবরিয়া
সময়ের আবর্তনে ২০২১-কে পেছনে ফেলে ২০২২ সালের আগমন। ২০২১ সালে করোনাভাইরাস ও মহামারির কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন প্রভাব ফেলেছে আমাদের ওপর। বছরের বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ ছিল ক্যাম্পাস। অনলাইনে পড়াশোনা-ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল বছরজুড়েই। এরই মাঝে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় বেশকিছু সাফল্য পেয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ।
আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরই পুরোনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাবে বিশ্ববাসী। তবে ২০২১ সালে করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিভিন্ন প্রভাব ফেলেছে আমাদের ওপর। বছরের অর্ধেক সময় বন্ধ ছিল ক্যাম্পাস। অনলাইনে পড়াশোনা-ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা ছিল বছরজুড়েই। তবে ক্যাম্পাস ও হল আবার খুলে শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের মনে ফিরে আসে স্বস্তি। সে রকমই কিছু ঘটনার কথা বছর শেষে ফিরে দেখা যাক। বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষা শুরু হওয়ার মধ্য দিয়ে শিক্ষাঙ্গনে ফিরে আসে প্রাণচাঞ্চল্য। বছরজুড়ে অনেক সফলতা ও অর্জন এসেছে শিক্ষার্থীদের হাত ধরে। এবারের লেখায় থাকছে এমনই কিছু উল্লেখযোগ্য অর্জনের তথ্য।
চ্যাম্পিয়ন ফারহানা, রামিসা, নোশিন
জাতীয় পর্যায়ে আয়োজিত ‘অ্যাডা লাভলেস ন্যাশনাল গার্লস প্রোগ্রামিং কনটেস্ট’-এর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বীকৃতিও পেয়েছেন ফারহানা খান, রামিসা আলম ও নোশিন নাওয়াল। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্কের (বিডিওএসএন) উদ্যোগে আয়োজিত এবারের কনটেস্টের প্রিলিমিনারি পর্বে সারাদেশ থেকে মেয়েদের মোট ১৮৭টি দল অংশ নেয়। চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়া ৭২টি দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ফারহানা খান, রামিসা আলম, নোশিন নাওয়ালের ‘বুয়েট-আ টিম হ্যাজ নো নেম’।
ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে সৌরদীপ
ভিনদেশে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করতে যান যে তরুণরা, বিদেশ যাত্রায় তাদের অনেকেরই সঙ্গে সব সময় থাকে লাল-সবুজ পতাকা। সেই লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে আবারও গর্বিত করলেন তরুণরা। বিতর্কের বিশ্বকাপখ্যাত ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটিজ ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপে সৌরদীপরাই প্রথম বাংলাদেশি দল, যারা কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছাতে পেরেছিল। কিছুদিন আগেই ক্যামব্রিজ আয়োজিত বিতর্ক চ্যাম্পিয়নশিপে অর্জন করে নিয়েছে প্রথম স্থান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে স্নাতক শেষ করা সৌরদীপ পাল তার প্রথম স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন দ্য অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে। এখন স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়ছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে।
নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে গ্লোবাল চ্যাম্পিয়নের স্বীকৃতি
নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জে ‘বেস্ট মিশন কনসেপ্ট’ ক্যাটাগরিতে গ্লোবাল চ্যাম্পিয়নের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশের দল ‘মহাকাশ’। ১০ বছর ধরে ‘স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জ’ আয়োজন করছে যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা। প্রতিযোগিতার ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, প্রোগ্রামার, বিজ্ঞানী, ডিজাইনার, উদ্ভাবক, গল্পকথক, প্রযুক্তিবিদদের জন্য এটি একটি আন্তর্জাতিক হ্যাকাথন। ৪৮ ঘণ্টার এই হ্যাকাথনে নাসার দেওয়া উপাত্ত (ডাটা) ব্যবহার করে বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেন প্রতিযোগীরা।
১৬২টি দেশ থেকে ৪ হাজার ৫৩৪টি দলের প্রায় ২৮ হাজার প্রতিযোগী এবারের আসরে অংশ নিয়েছিলেন। জয়ী ১০ দলের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশের ‘মহাকাশ’। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) সুমিত চন্দ, আলভি রওনক, সামির ইমতিয়াজ, শিশির কাইরি এবং বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির তৃষা বসাক ও মমিনুল হক এ দলের সদস্য।
‘আরটিএক্স ৪০৯০’
আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিয়মিতই সুখবর আসছে বাংলাদেশি প্রোগ্রামারদের হাত ধরে। এই অর্জনের ডানায় এবার নতুন পালক যোগ করল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রোগ্রামারদের একটি দল। দলের নাম ‘আরটিএক্স ৪০৯০’। গত ১৮ নভেম্বর আয়োজিত ক্যাগল ডে চ্যাম্পিয়নশিপে যৌথভাবে প্রথম হয়েছে এই দল। দলের সদস্যরা হলেন- তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স প্রকৌশলের (ইইই) ছাত্র মো. আওসাফুর রহমান ও বিস্ময় পাল এবং কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের (সিএসই) নাজিবুল হক সরকার ও জাবের ইবন আব্দুল হাকিম। সবাই বুয়েটের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
বুয়েটের অক্সিজেট
সংকটময় পরিস্থিতিতে একটা কিছু করার উদ্যম নিয়ে এগিয়ে এসেছে বুয়েটের অক্সিজেট। বর্তমানে প্রেরণা ফাউন্ডেশন বুয়েটে একটি অত্যাধুনিক ল্যাব তৈরি এবং অক্সিজেট যন্ত্রের উন্নয়নে আর্থিক সহায়তা করছে। সম্প্রতি অক্সিজেট আরও কিছু সাফল্য পেয়েছে। বঙ্গবন্ধু ইনোভেশন গ্রান্টে ফাইনালিস্ট ছিল তাদের এ প্রকল্প। এদিকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা ইনোভেশন ফোরামের সেরা স্টার্টআপ প্রতিযোগিতার আন্তর্জাতিক পর্বের সেরা ১৫-এর আছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বায়োমেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং সোসাইটির প্রতিযোগিতায়ও বিশ্বে সেরা তিনের মধ্যে স্থান পেয়েছে।
বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নেতৃত্বকে খুঁজে বের করার লক্ষ্যেই সূচনা হয় ওয়ার্ল্ড ইকোনমিকস কাপের। ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয় বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের এই আসর। গত বছরের মতো এবারও করোনা মহামারির কারণে পুরো প্রতিযোগিতাটি অনুষ্ঠিত হয় অনলাইনে। বৈশ্বিক পর্যায়ের এই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশসহ এ বছর অংশ নেয় ৩৮টি দেশের ৫২টি দলের ২৬৫ জন প্রতিযোগী। এবার বাংলাদেশ দলে ছিল সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের আবরার জামিল, মাস্টারমাইন্ডের জারিফ শাফাকাত ও মো. তানজিম হোসাইন, স্কলাসটিকার সৈয়দ মুনতাসির তাসদিদ, সানিডেইলের রাফায়েল জীবরান ও সানবিমসের আরমিন আহমেদ। ছয় প্রতিযোগীর কোচ হিসেবে ছিলেন আখতার আহমেদ। প্রতিযোগীদের মধ্যে আবরার স্বর্ণ, জারিফ রৌপ্য ও বাকি সবাই ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছেন। পদক জয়ের পাশাপাশি আবরার ও তাসদিদ স্থান পেয়েছেন ‘ডিপ ফান্ডামেন্টাল’ রাউন্ডের সেরা দশে।
কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আয়োজন এসিএম আন্তর্জাতিক কলেজিয়েট প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার (আইসিপিসি) চূড়ান্ত পর্বে এবার পশ্চিম এশিয়ায় সেরা হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ‘বুয়েট হেলবেন্ট’ দল। ১ অক্টোবর রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় অনুষ্ঠিত এই আয়োজনে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ১১৫টি দল অংশগ্রহণ করে। বুয়েটের বিজয়ী দলের সদস্যরা হলেন- কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের অর্ঘ্য পাল ও প্রীতম কুণ্ডু এবং তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক্স কৌশল বিভাগের আশিকুল ইসলাম। তাদের কোচ ছিলেন বুয়েটের সিএসই বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সোহেল রহমান।
ফেরি দুর্ঘটনা রোধে শিক্ষার্থীদের উদ্ভাবন
কীভাবে ফেরি চলাচলকে নিরাপদ করা যায়, তা নিয়ে প্রতিবছর একটি প্রতিযোগিতা আয়োজন করে আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা ওয়ার্ল্ডওয়াইড ফেরি সেফটি অ্যাসোসিয়েশন। ‘ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ডিজাইন কমপিটিশন ফর আ সেফ অ্যান্ড অ্যাফোর্ডেবল ফেরি’ শিরোনামের এই প্রতিযোগিতায় এ বছর তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের একটি দল। দলে ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) রৌনক সাহা, পরমা রায় চৌধুরী, মোহাম্মদ আবরার উদ্দিন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. শরিফুল ইসলাম। প্রায় সাত মাসের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই ফেরির নকশা তৈরি করেন শিক্ষার্থীরা। এ জন্য শুরুতেই বাংলাদেশের ফেরি ব্যবস্থার দুর্বলতা ও সংকট অনুসন্ধান করতে হয়েছে। ফেরিতে চড়ার ক্ষেত্রে নিজেদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নকশা প্রণয়ন করেন শিক্ষার্থীরা। এ রকম শত শত সাফল্যের সংবাদ অনেক হতাশার মাঝেও চলতি শিক্ষাবর্ষে আশার আলো হয়ে এসেছিল; যা আগামী বছরে নতুন করে পথচলার অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাবে।
Discussion about this post