শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ
বাংলাদেশের ফোকলোরবিদ ড. তপন বাগচী (জন্ম মাদারীপুর, ১৯৬৭) তিন দশকের সাহিত্যচর্চা আর দুই দশকের ফোকলোরচর্চায় এখন বাঙালির কাছে নন্দিত এক নাম। সাহিত্যের প্রায় সব ক্ষেত্রে তাঁর অবাধ বিচরণ। নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে তিনি ৮৩ খানা গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার মধ্যে ২৩ খানাই ফোকলোর সম্পর্কিত। ফোকলোরবিদ্যার ক্ষেত্রসমীক্ষার পাশাপাশি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণেও তিনি প্রভূত পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। ফোকলোরের বড় উপকরণ যাত্রাগান নিয়ে তাঁর বিশাল পরিসরে গবেষণা রয়েছে। বাংলা একাডেমি থেকে ‘বাংলাদেশের যাত্রাগান: জনমাধ্যম ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত’ (২০০৭) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এরপর ফোকলোরের ক্ষেত্রসমীক্ষাভিত্তিক গবেষণা প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশের যাত্রাশিল্পীদের জীবনযাত্রা’ (রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ অব বাংলাদেশ (রিইব), ঢাকা, ২০০৭) নামে। তাঁর যাত্রাগবেষণার আরেকটি গ্রন্থ ‘যাত্রাগানের চালচিত্র’ (শোভা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১১)। কেবল যাত্রাই নয়, ‘লোকসংস্কৃতির সাম্প্রতিক পাঠ’ (গতিধারা, ঢাকা, ২০০৮) গ্রন্থটিও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। তিনি চলচ্চিত্র নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে ফোকলোরের সন্ধান করেছেন। লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে লোকজীবনের উপস্থাপনা’ (বাংলাদেশ ফিল্ম আর্কাইভ, ঢাকা, ২০১১) নামের গ্রন্থ। ‘রবীন্দ্রনাথ ও বৌদ্ধ আখ্যান (মূর্ধন্য প্রকাশন, ঢাকা, ২০১২) গ্রন্থটিও ফোকলোর তাত্ত্বিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত। ‘লোকগানের খোঁজে’ (আলোকায়ন, ঢাকা, ২০১৬) গ্রন্থেও রয়েছে হারিয়ে যাওয়া লোকসংস্কৃতির সন্ধান। একই ধারার আরেকটি গ্রন্থ হচ্ছে ‘লালন মতুয়া ও লোকসংগীত সন্ধান’ (কথামেলা প্রকাশ, ঢাকা, ২০১২)। এছাড়া লোকসংগীতের কিংবদন্তীতুল্য শিল্পী ‘আব্বাসউদ্দীন আহমদ’–এর জীবনীরচনাও (যুক্ত প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৫) তাঁর ফোকলোরচর্চার অংশ। আমাদের গানের বাণীতে, বিশেষত লোকসংগীতের বাণীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কতটা উপস্থিত হয়েছেন, তারও বিশ্লেষণ রয়েছে ‘গানের কবিতায় বঙ্গবন্ধু’ (তাম্রলিপি, ঢাকা, ২০২০) নামের গ্রন্থে। এছাড়া ‘রাধারমণের গান’ (বর্ণায়ন, ঢাকা, ২০১০), ‘সত্যপিরের পুথি’ (সমাচার প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪), ‘প্রসঙ্গ লালন হাসন রাধারমণ: নির্বাচিত গান’ (পলল প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৩) গ্রন্থসমূহ তাঁর ফোকলোরচর্চার প্রত্যক্ষ প্রমাণ।
এছাড়া লোকগল্পের পুনর্কথন করেছেন ড. তপন বাগচী। ‘ফণিদার যত ফন্দিফিকির’ (সাত ভাই চম্পা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৯), ‘মাটির নিচে নদীর ধারা’ (কলি প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৭), ‘পুরাণের তিন নদীর গল্প’ (ক্র্যাফট প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৫), ‘সাতদিনের সাতকাহন’ (বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, ঢাকা, ২০১১) গ্রন্থগুলো ফোকলোরের পুনর্নির্মাণ হিসেবে গুরুত্ব পেতে পারে।
গান রচনায়ও তপন বাগচী সিদ্ধহস্ত। বিশেষত লোকসুরে রচিত তাঁর পল্লিগীতিগুলো গ্রন্থিত হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু থেকে মালালা: মন্দ্রিত সুরধ্বনি’ (আশালতা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৯), ‘কূলের আশায় কুল হারাইছি’ (সব্যসাচী, ঢাকা, ২০১৮), তপন বাগচীর মরমি শতগান, (আলোকায়ন, ঢাকা, ২০১৮), ‘দিয়েছি এই বুকের আসন’ (দোয়েল প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৬), ‘কলঙ্ক অলঙ্কার হইল’ (নন্দিত প্রকাশ, ঢাকা, ২০১৬), ‘বুকের ভেতর বসত করে’ (ইলমা প্রকাশনী, ঢাকা, ২০১৪) প্রভৃতি নামে।
ফোকলোরচর্চা ও তাঁর সামগ্রিক অবদানের জন্য তিনি ইতোমধ্যে যেসব পুরস্কার লাভ করেছেন, তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব পুরস্কার (২০২১), বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার (২০২১), অগ্রণী ব্যাংক বাংলাদেশ শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), মাইকেল মধুসূদন পদক (২০০৮), সুফিসাধক আরকুম শাহ স্মৃতিপদক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড দ্য ডেইলি স্টার সেলিব্রেটিং লাইফ গীতিকাব্য পুরস্কার (৪ বার, লোকসংগীত রচনার জন্য, ২০১৪, ২০১৬, ২০১৭ ও ২০১৯), জেমকন তরুণ কথাসাহিত্য পুরস্কার (যাত্রাগান নিয়ে উপন্যাস রচনার জন্য, ২০০৮), নজরুল পুরস্কার (নজরুল একাডেমি, চুরুলিয়া, আসানসোল, ভারত, ২০১৯), এম নূরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৮), মুনীর চৌধুরী সাহিত্য পুরস্কার (সংস্কৃতি সংসদ, ঢাকা, ১৯৯১), জসীম উদদীন গবেষণা পুরস্কার (ফরিদপুর, ১৯৯৬), নটসম্রাট অমলেন্দু বিশ্বাস স্মৃতি পদক (২০০৮) প্রভৃতি।
বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক ফোকলোরচর্চায় মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন, মযহারুল ইসলাম, আশরাফ সিদ্দিকী, আবদুল হাফিজ প্রমুখ ছিলেন প্রথম প্রজন্মের পথপ্রদর্শক। পরবর্তী প্রজন্মে শামসুজ্জামান খান, মুহম্মদ নূরুল হুদা, আবুল আহসান চৌধুরী ফোকলোরচর্চাকে আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। এঁদের পরবর্তী বর্তমান প্রজন্মে যাঁরা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ফোকলোরচর্চাকে একটি আদর্শ মানদণ্ডে রূপায়িত করেছেন, তাঁদের মধ্যে তপন বাগচীকে আমরা ভিন্নমাত্রায় চিহ্নিত করতে পারি। যাত্রাগান এবং লোকসংগীত নিয়েই তাঁর ফোকলোরচর্চা আবর্তিত হয়েছে। হারিয়ে যেতে-বসা লোকঐতিহ্য যাত্রাগান নিয়ে তাঁর পিএইচডি পর্যায়ের গবেষণা দুই দেশের বাঙালিদের কাছে যথেষ্ট গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে। বাঙালির সংস্কৃতির অন্যতম যোদ্ধা কামাল লোহানী বলেছেন, ‘তপন বাগচী বাংলার চিরায়ত নাট্যঐতিহ্য যাত্রাগান নিয়ে গবেষণা করে পিএইচডি করেছে। …দুহাতে লিখছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখছে, লোকসংস্কৃতির ব্যাখ্যা করছে। নিজের লেখার পাশাপাশি অন্যের লেখার তদারকিও করছে।’ (কামাল লোহানী, তপন আমার পুত্রপ্রতিম, নীলাদ্রিশেখর সম্পাদিত ‘কথাকৃতি’, পৃ-৫৩) যে সব্যসাচী লেখককে নিয়ে কামাল লোহানী উপর্যুক্ত মন্তব্য করেছেন, সেই লেখকের কেবল শিশুসাহিত্যচর্চা নিয়ে আমি দস্তুর মতো পড়াশোনা করে একটি বই লিখেছি। তাই আমার মনে কামাল লোহানীর উক্তিটি নিয়ে একটা অদ্ভুত আনন্দানুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে এমন একজন বিদগ্ধ ব্যক্তিকে, একজন দেশপ্রেমিক লেখককে, একজন ঐতিহাসিককে, একজন লোকগবেষককে আমি চিনি জানি—যিনি নিজের লেখার পাশাপাশি অন্যের লেখারও তদারকি করতে পারেন। এমন বহু ধারার বহু গুণে গুণান্বিত মানুষের সঙ্গে আমার আলাপ ছিল ভেবে উচ্চকিত হচ্ছি।
আমার লেখা সেই বইয়ের (শিশুসাহিত্যের তপন বাগচী: বর্ণময় আলোকদ্যুতি, শোভা প্রকাশ, ঢাকা) সূচনায় আমি লিখেছিলাম—‘‘বাংলাদেশের বন্ধু কবি তপন বাগচীকে নিয়ে লিখতে গিয়ে একটা মুখের কথা মনে পড়ছে—মুখ মানে ছবির মুখ—যে মুখের একটা বিশেষত্ব হলো—সামনে উপস্থিত সকল মানুষ মনে করবে যে, ছবির মুখটি তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। এখন প্রশ্ন কেন এমন বললাম? বললাম এই কারণে যে, আলোচ্য ব্যক্তিটি একজন লেখক—তার পাঠকও আছেন। থাকাটাই স্বাভাবিক। তাতে কোনো বিশেষত্ব নেই, বিশেষত্ব যেটা সেটা হচ্ছে—তাঁর দিকে যে স্তরের পাঠকই তাকাক না কেন, তাঁর মনে হয় তাঁর প্রিয় লেখক তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন। কবিতার পাঠক, গল্পের পাঠক, উপন্যাসের পাঠক, প্রবন্ধের পাঠক, গবেষণার পাঠক, ছড়ার পাঠক, লিরিকের পাঠক—সকলেই মনে করবে যে লেখক তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন। মোদ্দা কথাটি হলো তপন বাবু একজন সব্যসাচী লেখক, শুধু দুই হাত নয়, চার হাতের ছ হাতের লেখক। সব দিকে তির ছুঁড়তে থাকেন। আর সেই তির সকল রকম পাঠকেরই হৃদয় বিদ্ধ করতে পারে। তিনি আমাদের চির বরণীয় চির স্মরণীয় তপনের (রবীন্দ্রের) মতো সাহিত্যের সকল প্রাঙ্গণেই বিচরণ করা একজন পোক্ত কলমচি।’’
এতো গেলো আমার মতো একজন সামান্য মানুষের অবলোকন। এ বাংলার বহু বড় বড় সাহিত্যব্যক্তিত্বও তাঁর উপর মহান আলোক ফেলেছেন। সে আলোর দীপ্তি আমরা পেয়েছি নদিয়া জেলার বেথুয়া ডহরির নীলাদ্রিশেখর সরকারের কথাকৃতি পত্রিকায়। কথাকৃতি পত্রিকা তপন বাগচীকে নিয়ে ৬৩০ পাতার একটি সংখ্যা করেছিল। তাতে দু’বাংলার বহু বিশিষ্ট মানুষ তাঁকে নিয়ে লিখেছিলেন। একজন মানুষকে চেনা জানার সে এক অপার আয়োজন।
সে প্রসঙ্গে অন্যত্র আলোচনা করা যাবে। এখন পশ্চিমবঙ্গে বিবেক বলে মনে করি যাঁকে, সেই প্রখ্যাত পণ্ডিত ভাষাবিদ পবিত্র সরকার তপন বাগচী সম্বন্ধে কী বলছেন সেটাই তুলে ধরা যাক। তিনি বলেছেন, ‘‘তপন বাংলাদেশের লোকসংগীতের একজন প্রথম সারির গবেষক। এইখানে তাঁর চোখ একেবারের জহুরীর মতো এবং কোন গান আক্কাস দেওয়ানের নয়, কফিলউদ্দিন সরকারের; কোন গান লালনের নামে চলে, কিন্তু আসলে রচনা করেছিলেন মনোমোহন দত্ত, তা সে অনায়াসেই বলে দিতে পারে। এরকম তথ্যজ্ঞান খুব কম লেখকেরই থাকে। সিলেটের আরকুম শাহ কিংবা ফরিদপুরের মহিন শাহ কিংবা নড়াইলের বিজয় সরকার—সব পদকর্তাকে নিয়েই তার জানাশোনা আছে। …তপন যাত্রাগান নিয়ে গবেষণা করেছে। এটি তার গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা। এর জন্য সে ডক্টরেট পেয়েছে। এই কাজটি কলকাতাতেও অনেকের কাছে গ্রহণীয় মনে হয়েছে।’’ (পবিত্র সরকার, লোকসংগীতের প্রথম সারির গবেষক, পৃ-৬৯)
বাংলাদেশে ও ভারতের বহু বিদ্বজ্জন তপন বাগচীর কবিতা, শিশুসাহিত্য, প্রবন্ধ ও ফোকলোরচর্চা নিয়ে উচ্চাপ্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশে বিবেকতুল্য সদস্যপ্রয়াত আনিসুজ্জামান বলেন: ‘‘ড. তপন বাগচী একাধারে কবি ও প্রবন্ধকার, গবেষক, শিশুসাহিত্য-রচয়িতা ও গণমাধ্যম-বিশ্লেষক। তিনি বাংলাদেশের যাত্রাগান ও ভাওয়াইয়া গান নিয়ে গবেষণা করেছেন, লিখেছেন বাংলাদেশের কবিতা এবং বিশেষ করে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ সম্পর্কে। তাঁর অনেক বই প্রকাশিত হয়েছে, তিনি লাভ করেছেন বেশ কিছু সম্মাননা। স্বভাবতই তিনি আমাদের প্রীতিভাজন।’’ (আনিসুজ্জামান, তপন আমাদের প্রীতিভাজন’, পৃ-৫১)
বাংলা একাডেমির প্রাক্তন মহাপরিচালক ও পরবর্তীকালের সভাপতি এবং বাংলাদেশের আধুনিক ফোকলোরচর্চার পথিকৃৎ শামসুজ্জামান খান লিখেছেন: ‘‘বাংলাদেশের ফোকলোরচর্চায় তপন বাগচীর অবদান রয়েছে। বিশেষত যাত্রাগান নিয়ে তার গবেষণাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। লোকসংগীত নিয়েও তার কিছু প্রবন্ধ রয়েছে।’’ (শামসুজ্জামান খান, তপনকে শুভেচ্ছা, পৃ-৭৮)
বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক, জাতিসত্তার কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা মনে করেন: ‘‘রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জীবনীগ্রন্থ তপনের একটি বড় কাজ। এ ছাড়া তার যাত্রা সম্পর্কিত গবেষণাগ্রন্থটি একটি তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণাকর্ম। গবেষণায় বিশেষত ফোকলোর আর স্থানীয় ইতিহাস রচনায় তাঁর মেধা ও পরিশ্রমের ছাপ রয়েছে।’’ (মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবিপণ্ডিতের পঞ্চাশ’, পৃ-৭৩)
তপন বাগচীর দক্ষতার আর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এই যে, তিনি দুরন্ত এক বাগ্মী। যে কোনো বিষয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাবলীল বলে যেতে পারেন। কয়েক বছর আগে একটি আলোচনা সভায় যাত্রা বিষয়ে তিনি একটি অসামান্য বক্তৃতা করেছিলেন। সে বিষয়টি উল্লেখ করে কলকাতার খ্যাতিমান যাত্রাগবেষক ড. প্রভাতকুমার দাস লিখেছেন: ‘‘কয়েক বছর আগে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আহ্বানে তিনি যখন একটি আলোচনাসভায় আমার সহবক্তা হিসেবে যাত্রা বিষয়ে তথ্যসমৃদ্ধ ভাষণ দিয়েছিলেন, সেদিন যেমন মুগ্ধ হয়েছিলাম, আজও তা অটুট আছে। যাত্রা-গবেষণায় তাঁর কৃতকর্ম একদিন নিশ্চয় তাকে যথাযোগ্য সম্মানের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা এনে দেবে।’’ (প্রভাতকুমার দাস, যাত্রাপথের বন্ধু তপন, পৃ-১৮১)
আমাদের দেশের বিশেষ করে বাংলা ভাষায় ফোকের প্রভাব অসীম। তার উপর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন লোর যুক্ত হচ্ছে ফোক-ঐতিহ্যের সমুদ্রে। ভাষার ইতিহাস, সংস্কৃতির ইতিহাস, সমাজ-সাহিত্যের ইতিহাস ক্রমশ গবেষণার দিগন্ত প্রশস্ত করছে। তপন বাগচী তাকে চোখের মণি করেছিলেন। যে বিষয়টির দিকে নজর করেছিলেন বিশিষ্ট ফোকলোরবিদ, বিশেষত লালন-গবেষক আবুল আহসান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘তপন বাগচীর সাহিত্য-চর্চার যে দুটি দিক আমাকে আকৃষ্ট ও মুগ্ধ করেছে তা উল্লেখ করা প্রয়োজন। সে হলো ফোকলোর ও ইতিহাস। সৃজনশীল লিখিয়ে হিসেবে সে পরিচিত ও খ্যাতিমান সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার বিবেচনায় তার সিদ্ধি ও স্থায়ী অর্জন মননসাহিত্যেই—বিশেষ করে অনিসন্ধিৎসু তথ্যসংগ্রাহক ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্যবিশ্লেষক হিসেবে—যার দুই প্রান্তে আছে ফোকলোর ও ইতিহাস, যা কখনো কখনো পরস্পরকে কাছে টেনেছে।’’ (আবুল আহসান চৌধুরী, তপননামার খসড়া, পৃ-৪৭)
আমার নিজের লেখার বিষয় ছিল তপন বাগচীর শিশুসাহিত্য। গ্রন্থটির নাম ‘শিশুসাহিত্যে তপন বাগচী: বর্ণময় আলোকদ্যূতি’। সেই গ্রন্থটির ভূমিকায় আমি লিখেছিলাম—‘‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জাভা-যাত্রীর পত্র’ গ্রন্থে লিখেছেন—‘উপনিষদে আছে, স নো বন্ধুর্জনিতা স বিধাতা: তিনি ভালোবাসেন, তিনি সৃষ্টি করেন, আবার তিনি বিধান করেন। সৃষ্টি করাটা সহজ আনন্দের খেয়ালে, বিধান করায় চিন্তা আছে। যাকে খাস সাহিত্য বলে সেটা হল সেই সৃষ্টিকর্তার এলাকায়, সেটা আপন মনে। যদি কোন হিসাবি লোক স্রষ্টাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে ‘‘কেন সৃষ্টি করা হলো?’’ তিনি জবাব দেন, ‘‘আমার খুশি!’’ সেই খুশিটাই নানা রঙে নানা রসে আপনাতেই আপনি পর্যাপ্ত হয়ে ওঠে। পদ্মফুলকে যদি জিজ্ঞাসা করো—‘‘তুমি কেন হলে?’’ সে বলে, ‘‘আমি হবার জন্যই হলুম।’’ খাঁটি সাহিত্যেরও সেই একমাত্র জবাব।
এই উদ্ধৃতি এনেছিলাম এটা বোঝাতে যে, যাঁর (তপন বাগচী) সাহিত্য নিয়ে আমি এই গ্রন্থ রচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি, আমার বিবেচনায় তিনি খাঁটি সাহিত্যিক। সাহিত্যের নানান শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ। আর যা লেখেন, পদ্মফুলের মতো আপনি প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ফোকলোরকে তপন বাগচী গবেষণা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিশ্বদরবারে পৌঁছে দিতে তৎপর। তাঁর অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকলে তিনিই হয়ে উঠবেন তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ ফোকলোরবিদ।
লেখক: সাহিত্যিক ও গবেষক। সম্পাদক, শিশুকিশোর পত্রিকা ‘তিতলি’, নদিয়া।
Discussion about this post