উদিসা ইসলাম
দীর্ঘ ৯ মাস কারাবাসের পর ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয় পাকিস্তান সরকার। পাকিস্তানের ইচ্ছাতেই তাঁকে পাঠানো হয় লন্ডনে। এ খবরে বঙ্গবন্ধুর পরিবার, দেশের আপামর জনসাধারণ ও বিশ্বনেতৃত্বসহ সবাই স্বস্তি পেলেও কখন ফিরবেন নেতা, সেই প্রতীক্ষা বাড়তে থাকে। ৮ জানুয়ারি থেকে ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত এক শ্বাসরুদ্ধকর সময় কাটান সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সদ্য স্বাধীন দেশের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বঙ্গবন্ধু সেদিন হিথ্রো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেও সেখানে কোনও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে চাননি। পরে লন্ডনে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হতে সম্মেলন কক্ষে প্রবেশের সময় বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে সাংবাদিকদের অভিনন্দিত করেন। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্ক রাখবে—তিনি এমন কোনও প্রতিশ্রুতি মি. ভুট্টোকে দেননি বলেও জানিয়ে দেন।
তিনি সেদিন দরাজ কণ্ঠে কথা জানান, দেহে কোনও অসুস্থতার লক্ষণ ছিল না। তখন কেবলই দেশে ফেরার তাগাদা লক্ষ করা যাচ্ছিলো। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘যখন তাঁর জনগণ তাঁকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি রাষ্ট্রদ্রোহের’ দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে কারাগারে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি। এই ট্রাইব্যুনালের বিচারের রায় কখনও প্রকাশ করা হয়নি। একটি খুব খারাপ স্থানে কল্পনাতীত একাকিত্বে বন্দিজীবন কাটাতে হয়েছে। কোনও রেডিও না, চিঠি না, বাইরের জগতের সঙ্গে কোনও যোগাযোগই ছিল না। মরার জন্য মনের দিক থেকে আমি প্রস্তুত ছিলাম। যেদিন জেলে নেওয়া হলো, তখন আমি বাঁচবো কিনা ধারণা ছিল না। তবে এটা জানতাম, বাংলাদেশ মুক্ত হবেই। আমার দেশের লাখ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছে, নিষ্ঠুর অত্যাচার চালিয়েছে। বেঁচে থাকলে হিটলারও লজ্জা পেতো।
তিনি ওইটুকু সময়ের মধ্যে দেশের কথা জানতে চেষ্টা করা, রাজনৈতিক-কূটনৈতিক অবস্থান বুঝে নেওয়া, দেশে ফেরার নিরাপদ ব্যবস্থা করার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছেন বলে সেই সময়ের সহযাত্রীরা উল্লেখ করেন।
এমনকি তিনি মাত্র আধঘণ্টা পরিবারের সঙ্গে কথা বলে কাটান। লন্ডন থেকে টেলিফোনে বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম প্রশ্ন ছিল—‘বেঁচে আছো তো?’ ২৫ মার্চের দুর্বিষহ কালরাতের পর ৮ তারিখ শনিবার (১৯৭২) প্রথমবারের মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্ত্রী ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পান। প্রথমে বড় ছেলে শেখ কামাল, পরে ক্রমান্বয়ে বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও ছোট ছেলের সঙ্গে কথা বলেন। ঘটনাবহুল ও দুর্বিষহ ৯ মাস পর পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের কণ্ঠ শুনতে পেলেন। বেগম মুজিব আবেগঘন কণ্ঠে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এনা পরিবেশিত খবরে বলা হয়—বেগম মুজিব সাংবাদিকদের জানান, তিনি আবেগে এত অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন যে প্রথমবার কথা বলতে পারেননি।
সে সময় লন্ডনে ছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক। লন্ডনের দিনটি বঙ্গবন্ধুর ব্যস্ত কেটেছে জানিয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু যে হোটেলে ছিলেন, আমরা ১৫ থেকে ২০ জন সেই হোটেলে ঢোকার সুযোগ পেয়েছিলাম। তাঁর নিরাপত্তার বিষয়টি তখন সবার থেকে বেশি ভাবা হচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু এসেছেন শুনে সেই হোটেলের বাইরে শত শত মানুষ উপস্থিত হতে শুরু করেন। তিনি সেই সময়টা মনে করার চেষ্টা করে বলেন, ‘প্রথমে অবাক হলাম, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ হোটেলে চলে এলেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় বিশ্বের নেতাকে দেখতে হোটেলে চলে আসবেন, এটা অতীতে ঘটেনি, ভবিষ্যতেও ঘটবে না। আমি বিশ্বাস করি, এটা বঙ্গবন্ধু বলেই সম্ভব হয়েছে।’
কেমন ছিল সেদিনের লন্ডন, প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে এসেছেন জানার পরপরই অন্যান্য শহর থেকে লোকজন এসে জমায়েত হতে থাকলো। এমন পরিস্থিতি যে মানুষ সামলাতে পুলিশও হিমশিম খেয়ে যায়। সবার চোখে আনন্দাশ্রু। বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছেন এই আনন্দে। আর বঙ্গবন্ধু হোটেল কক্ষ থেকে মাঝে মধ্যে জানালার কাছে এসে দেখা দেন।’
এরপর ফেরার পালা। স্বাধীন দেশে, বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সব ব্যবস্থা করে দিয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ জানান নয়াদিল্লিতে। ঢাকায় নামার আগে বঙ্গবন্ধু সেখানে যাবেন। যাত্রাপথে তার সহযাত্রী যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শশাঙ্ক ব্যানার্জি। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে নানা সময়ে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যতবার বঙ্গবন্ধু নিয়ে কথা হয়েছে ততবারই বলেছেন, সেই ফিরে আসার সময়ে তাঁর দেখা— বঙ্গবন্ধুর চোখে স্বাধীনতার আনন্দে ভেসে যাওয়া হাসিকান্নার কথা। তিনি বলেন, ‘এই মানুষ তাঁর দেশ ও দেশের মানুষ ছাড়া কিছু ভাবেননি।’
নয়াদিল্লির আমন্ত্রণে লন্ডন থেকে প্রথমে সেখানে যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে রাষ্ট্রীয় আলাপের পর সংবর্ধনায় বক্তৃতা দেন তিনি। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ-ভারতের ভ্রাতৃত্ব বন্ধন চিরকাল অটুট থাকবে।’ দিল্লি ক্যান্টনমেন্টের প্যারেড গ্রাউন্ডে সংবর্ধনায় তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি ভারতের জনগণ, সরকার ও সেনাবাহিনী যে সহানুভূতি ও সমঝোতার মনোভার প্রদর্শন করেছেন এবং এর জন্য তারা যে আত্মত্যাগ করেছেন, তাতেই দুদেশের সম্পর্ক দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
অনেক প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ১০ জানুয়ারি দেশের মাটিতে পা রাখেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সারাদেশ থেকে মানুষ ঢাকায় আসেন প্রিয় নেতাকে একবার চোখের দেখা দেখতে। আর নেতার চোখে তখন স্বাধীন বাংলায় পা রাখার উত্তেজনা। লন্ডন থেকে ১৩ ঘণ্টার সফরে যে মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করছিলেন তিনি। ঢাকায় নেমে বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দানে যেতে সময় লাগে এক ঘণ্টা ৩০ মিনিট। পথে পথে নেমে আসে পুরো দেশ।
পরের দিন দেশি-বিদেশি সব পত্রিকায় খবরটি ছিল গুরুত্বের সঙ্গে। সেই দিনেরই ওয়াশিংটন পোস্টে বঙ্গবন্ধুর ঢাকায় প্রত্যাবর্তন নিয়ে লেখা হয়েছে, ‘অ্যারাইভড অ্যাট ঢাকা এয়ারপোর্ট অন ১.৪৫ অ্যাবোর্ড আ ব্রিটিশ রয়্যাল এয়ারফোর্স কমেট। হি ফ্লিউ ফ্রম নিউ দিল্লি হোয়ার মেট উইথ প্রাইম মিনিস্টার ইন্দিরা গান্ধী অ্যান্ড প্রেসিডেন্ট ভি.ভি. গিরি অন হিজ ওয়ে হোম ফ্রম লন্ডন।’ আর বাংলায় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এই কবিতাটিতেই সব কথা যেন বলে দেওয়া হয় সেদিনই আরেকবার, অন্নদাশঙ্কর রায়ের লেখা—যতকাল রবে পদ্মা যমুনা গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।
Discussion about this post