শিক্ষার আলো ডেস্ক
মুক্তবুদ্ধি চর্চা, সৃজনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে বহুমাত্রিক ভূমিকা রাখছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সংগঠনগুলো। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে নানামুখী এসব সংগঠনের উন্মেষ ঘটে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। গত চার দশক পেরিয়ে বর্তমানে বহু সংগঠন গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রসহ (টিএসসি) ক্যাম্পাস জুড়ে।
এসব সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজের অস্তিত্বে থাকা সৃজনশীলতা, দক্ষতা ও প্রতিভার স্ফুরণ ঘটান। যার প্রভাব পড়ে ব্যক্তিগত ও পেশা জীবনেও। অনেকে আবার ক্যারিয়ার গড়েন এসব প্রতিভার আলোকেই।
যেমনটি করেছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, জনপ্রিয় অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর, অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফাসহ দেশ সেরা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তারা প্রতিভার চর্চা করেছেন টিএসসির সন্ধ্যার নিয়ন আলো কিংবা চায়ের আড্ডাতেই।
গ্রামীণ বসতির চিরায়ত উঠান, ঐতিহ্য, আবহাওয়া ও সংস্কৃতির কথা মাথায় রেখেই ১৯৬২ সালে নান্দনিক স্থাপত্যের টিএসসি নির্মাণ করা হয়। মূল ভবনটির নকশায় প্রকাশ পায় গ্রিক স্থপতি কন্সটেন্টিনোস এপোস্তলো ডক্সিয়াডিসের সৃজনশীলতা।
টিএসসি প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাজেট সমীক্ষা থেকে জানা যায়, ২৭টি সংগঠনের নাম রয়েছে এখানে। যার মধ্যে ২০টি টিএসসি কেন্দ্রিক ও বাকি ৭টি বিভিন্ন হল বা অনুষদের। আর টিএসসিতে অফিস রয়েছে এমন সংগঠনের সংখ্যা ২৪টি। যার কয়েকটি জাতীয় পর্যায়ের সংগঠন।
এছাড়া প্রায় ৩০টি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রয়েছে, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী বা বিভিন্ন পেশার মানুষও যুক্ত। বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৬ হাজার শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৬-৭ হাজার শিক্ষার্থী সম্পৃক্ত রয়েছে এসব সংগঠনে। এসব সংগঠন সৃজনশীলতা, সামাজিক দায়বদ্ধতা, ব্যক্তিত্ব বিকাশে ভূমিকা রাখছে। তাইতো বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব সংগঠনকে ঢাবি প্রশাসন প্রতিবছর প্রায় ৫০ লাখ টাকা প্রদান করে থাকে।
ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি (ডিইউডিএস)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে বর্তমানে যে সংগঠনগুলো রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে পুরনো ও বাংলাদেশের বিতর্ক আন্দোলনে সবচেয়ে প্রাচীন সংগঠন ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি (ডিইউডিএস)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিতর্কের কেন্দ্রীয় এই সংগঠনটি ১৯৮২ সালে যাত্রা শুরু করে। চার দশকের সংগঠনটি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মুক্তবুদ্ধি, যুক্তির জাল বুনন ও চর্চার অন্যতম একটি স্থান।
ডিইউডিএস’র বিতর্ক প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান
ডিইউডিএসের সভাপতি শেখ মো. আরমান জাগো নিউজকে বলেন, বিতর্ক একজন শিক্ষার্থীর চিন্তার জগতকে বিকশিত করে। ঘটায় সৃজনশীলতার বিকাশ। বিতর্কের মধ্য দিয়ে মুক্তবুদ্ধির চর্চার ফলে আত্মবিশ্বাসটা বেড়ে যায় একজন শিক্ষার্থীর। নানা কাজের মধ্যে থাকায় একাকীত্ব কখনো একজন সংগঠককে আঁকড়ে ধরতে পারে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ
সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসেবে টিএসসির অন্যতম সংগঠন ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ’। যার যাত্রা শুরু ১৯৯১ সালে। সংগঠনটি চলচ্চিত্রবিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এছাড়া লেখকমনস্ক শিক্ষার্থীদের বিকাশে ‘আগন্তুক’ নামে একটি ট্যাবলয়েড পত্রিকা ও ‘ফ্ল্যাশব্যাক’ নামে ম্যাগাজিন প্রকাশ করে।
রক্তদাতাদের সংগঠন ‘বাঁধন’
মানবিক সংগঠন হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলে ১৯৯৭ সালে যাত্রা শুরু করে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের সংগঠন ‘বাঁধন’। যার প্রধান কেন্দ্র এখন টিএসসিতে। সংগঠনটির স্লোগান হলো- ‘একের রক্ত অন্যের জীবন, রক্তই হোক আত্মার বাঁধন’। বাঁধনের কার্যক্রম এখন ছড়িয়েছে দেশব্যাপী।
১৭টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ৫৩টি জেলায় ৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয়সহ স্বেচ্ছায় রক্তদান ও রক্তদানে উদ্বুদ্ধকরণের কাজ করছে সংগঠনটি।
মানবিক সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস ভয়েজ অ্যান্ড হিউম্যানিটি’
এছাড়া মানবিক ও স্বেচ্ছাসেবী নতুন নতুন সংগঠনও গড়ে উঠেছে টিএসসিকে ঘিরে। ‘মানবিক চোখে, মানবিক বিশ্ব’ এই স্লোগান নিয়ে ২০১৭ সালে গড়ে ওঠে ‘হিউম্যান রাইটস ভয়েজ অ্যান্ড হিউম্যানিটি’। যেখানে মানবাধিকার সচেতনতা ও বিভিন্ন মানবিক কাজ করছেন সংগঠনটির সদস্যরা। এমনকি করোনাকালেও অনলাইনে স্বল্প পরিসরে অব্যাহত রেখেছিলেন তাদের সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও সহায়তার কাজ।
সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন’
টিএসসির সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন এক মাত্রা যোগ করেছে ‘ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন’। ‘না বলা কথাগুলো না বলেই হোক বলা’ এই স্লোগান নিয়ে ২০১১ সালে পথচলা শুরু। এই সংগঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, রোহিঙ্গা সমস্যা, পরিবেশ বিপর্যয়, দুর্নীতি, যানজট, নারীদের সামাজিক অবস্থা ও সচেতনতা নিয়ে নানা প্রোগ্রাম করে আসছেন শিক্ষার্থীরা।
ক্যারিয়ার ক্লাব
শুধু সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনই নয়। ২০০৯ সালে শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্যারিয়ার সম্পর্কে সচেতনতা গড়ার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যারিয়ার ক্লাব’। প্রতিবছর বিভিন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপ, জব ফেয়ার ইত্যাদি আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক চাকরির জগতে শিক্ষার্থীদের সুযোগ তৈরি করে দেয় ক্লাবটি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি
টিএসসির পুরনো সংগঠনের মধ্যে আরেকটি ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি’। ১৯৮৫ সালে গড়ে ওঠা সংগঠনটি শিক্ষার্থীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখেছে এখনো। এই সংগঠনের অনেকে পেশাগত জীবনে বিভিন্ন গণমাধ্যমের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ডাকসু নির্বাচনের পেছনেও ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির অগ্রণী ভূমিকা।
সংগঠনটির সভাপতি মেহেদী হাসান বলেন, একাডেমিক শিক্ষার পাশাপাশি সহ-শিক্ষাটা বেশি কাজে লাগে একজন শিক্ষার্থীর জীবনে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি একটি বড় শিক্ষা। একজন শিক্ষার্থীর বাস্তব জীবনের সঙ্গে পরিচয়ে বেশ ভূমিকা রাখে সংগঠনগুলো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-নির্দেশনা ও পরামর্শদান বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এবং অ্যাডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ড. মেহ্জাবীন হক জাগো নিউজকে বলেন, করোনার কারণে আত্মহত্যার পরিমাণটা কিছুটা বেড়ে গেছে। এমনটা হয়েছে সারা পৃথিবীতেই। স্বাভাবিক জীবন যখন ব্যাহত হয়, অনিশ্চয়তায় পড়ে, তখন মনের মধ্যে একটা প্রভাব পড়ে। সেই সঙ্গে আর্থিক সংকট, চাপ, উৎকণ্ঠা তৈরি হয় শিক্ষার্থীর মনে। এগুলো কমাতে সংগঠন বেশ ভূমিকা রাখে। এখানে এসে সে তার কথাগুলো বলতে পারে কিংবা কাজের মাধ্যমে সেই চাপটা মাথা থেকে হারিয়ে ফেলে।
টিএসসির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সৈয়দ আলী আকবর বলেন, লেখাপড়া করলেই পরিপূর্ণ মানুষ হবে তা কিন্তু নয়। পড়ার পাশাপাশি নানা গুণাবলী অর্জন করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সংগঠনগুলো একজন শিক্ষার্থীর মাঝে এসব গুণাবলী বিকশিত করে। তাই জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি নতুন কিছু শেখা ও নিজেকে বিকশিত করার জন্য এসব কাজে সম্পৃক্ততা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, সংগঠনে সম্পৃক্ততা একজন শিক্ষার্থীকে মানসিক হতাশা দূর করে দেয়। মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কম থাকলে একাকীত্ব ও হতাশা গ্রাস করে। ফলে ঘটে নানা দুর্ঘটনা। করোনাকালে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা হতাশ হয়ে আত্মহত্যাও করেছেন। এতে বুঝা যায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক এসব সংগঠনগুলোর গুরুত্ব রয়েছে।
সংগঠনগুলোতে বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি তদারকির কাজ করে থাকে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক সংগঠনগুলো রয়েছে, সেগুলো শিক্ষার্থীদের দ্বারাই পরিচালিত। ফলে শিক্ষার্থীদের সাংগঠনিক দক্ষতা ও নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। সৌজন্যে-জাগো নিউজ
Discussion about this post