গোলাম মোরশেদ
কর্মসংস্থান বাজার সম্পর্কে অস্পষ্ট ধারণার কারণে বেশিরভাগ চাকরি প্রত্যাশী ও শিক্ষার্থী শ্রমবাজারের লক্ষ্যে নিজেদের যথার্থভাবে প্রস্তুত করতে পারে না। চাকরি প্রত্যাশী ও শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ জানেই না তারা দেশের শ্রমবাজারের জন্য প্রস্তুত কিনা!
এই বিষয়টি ব্যাখ্যার আগে বাংলাদেশের শিক্ষা, শ্রমবাজার, কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেওয়া যাক। বর্তমানে বাংলাদেশ যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে তার মধ্যে অন্যতম হলো ‘শিক্ষিত বেকারত্ব’।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশের সামগ্রিক বেকারত্বের হার ৪.২%, যা ইতোমধ্যে করোনার প্রভাবে বৃদ্ধি পেয়ে ৫.৩% (আইএলও ২০২১)-তে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে দীর্ঘসময় কর্মহীন থাকার হারও অনেক বেশি, যেমন, এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে কর্মহীন থাকার হার ১৫.২%। আর কর্মহীনদের মধ্যে শিক্ষিতের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী নিরক্ষরদের তুলনায় শিক্ষিত বেকারত্ব তিনগুণ বেশি। আবার শিক্ষার স্তর ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষিতদের মাঝে বেকারত্বের হার আরও বেশি। যেমন, নিম্ন মাধ্যমিকের তুলনায় উচ্চমাধ্যমিক পাসকৃতদের বেকারত্ব প্রায় চারগুণ আর স্নাতকদের মাঝে তিনগুণ বেশি। অর্থাৎ সামগ্রিকভাবে দেশে স্বল্পশিক্ষিতের তুলনায় স্নাতক-স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী কর্মহীন ব্যক্তির সংখ্যা বেশি।
প্রতিবছর বেকারত্ব যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে তার বড় অংশই শিক্ষিত ব্যক্তি। ‘শিক্ষিত বেকার’ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে শ্রমবাজারের সমন্বয়হীনতা। ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী, দেশে শুধু ৫০টি পাবলিক ও ১০৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অধ্যয়নরত প্রায় ৪৭ লাখ শিক্ষার্থী। এছাড়া মাদ্রাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানে রয়েছে আরও কয়েক লাখ শিক্ষার্থী। কিন্তু দেশের শ্রমবাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, এখানে যেসব বিষয়ের চাহিদা বেশি তার জোগান কম। আর যেসব বিষয়ের চাহিদা তুলনামূলক কম, তার জোগান বেশি। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে কলা ও মানবিক বিষয়ে অধ্যয়নরত ৪২.১১%, সামাজিক বিজ্ঞানে ২৫.২০%, বাণিজ্যে ১৯.৮১%, বিজ্ঞানে ৭.৮২%, প্রকৌশল ও কারিগরিতে ১.৬৬%, শিক্ষায় ০.৯৫%, কৃষিতে ০.৭৮%, জীববিজ্ঞানে ০.৫৭%, আইনে ০.২৩%, চিকিৎসায় ০.১৭%, চারুকলায় ০.০৬%, ফার্মেসিতে ০.০২%, এবং ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট ও অন্যান্যতে ০.৬৩%।
বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী থাকলেও শ্রমবাজারে তাদের জন্য বিশেষায়িত কর্মের সুযোগ তুলনামূলক কম। অন্যদিকে শ্রমবাজারে বিজ্ঞান ও বাণিজ্যের বিষয়গুলোর চাহিদা বেশি থাকলেও তার জোগান কম। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজগুলোতে এমন কিছু বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর কোর্স চালু রয়েছে, শ্রমবাজারে যেগুলোর কোনও নির্দিষ্ট ক্ষেত্র সৃষ্টি করা সম্ভব হয়নি। এ কারণে শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে ভারসাম্যহীনতার দুষ্ট চক্রে পড়ছে।
গত কয়েক বছরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ১৮ লাখ নতুন জনশক্তি শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। যার প্রায় অর্ধেকই উচ্চশিক্ষিত। ইউজিসির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে শুধু দেশের ৪৬টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় (১৫টি অধিভুক্ত/অঙ্গীভূত কলেজের শিক্ষার্থী ছাড়া) থেকেই স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৫ লাখ। যদিও গত ৫ বছরে দেশে গড়ে ১৯ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার আগামী ৫ বছরে গড়ে ২২ লাখের বেশি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চায়। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রভাবে ইতোমধ্যে বিশ্ব শ্রমবাজারে যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হয়েছে তাতে এই লক্ষ্য অর্জন কঠিন হবে বলেই মনে হচ্ছে।
তবে এই বেকারত্বের কারণ হিসেবে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকে দায়ী না করে বরং তাদের কর্মসংস্থানে অংশগ্রহণের চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতাগুলো নিবিড় অনুসন্ধান দরকার। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে শিক্ষার্থীরা সিলেবাসভিত্তিক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি শ্রমবাজারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রায়োগিক দক্ষতা কম অর্জন করছে। বর্তমানের শ্রমবাজার অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। অথচ শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবে জনসম্পদে পরিণত হতে পারছে না। এমনকি উচ্চশিক্ষার ক্যারিকুলামের অনেক ক্ষেত্রেই আধুনিক প্রযুক্তি ও প্রায়োগিক দক্ষতা উন্নয়নের বিষয়গুলো এখনও অন্তর্ভুক্ত হয়নি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলো শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী জনশক্তি তৈরি করতে না পারায় দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। বর্তমান শ্রমবাজারে দক্ষতা অর্জন ব্যতীত শুধু সনদ অর্জনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান অসম্ভব। একজন শিক্ষার্থী শুধু একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে ডিগ্রি অর্জনের মাধ্যমে শ্রমবাজারের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে না। সেটা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয়ে হলেও না। ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি শ্রমবাজারের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে চাহিদা অনুযায়ী দক্ষতা তৈরি করতে হবে।
চাকরির বাজারে তত্ত্বীয় জ্ঞানের চেয়ে প্রায়োগিক জ্ঞানের চাহিদা বেশি। একটা ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে অর্জিত সনদ কিংবা ঈর্ষণীয় ফলাফল হয়তো কিছু চাকরির বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনে অগ্রাধিকার দেয়, কিন্তু সফলতা নির্ভর করে ব্যক্তির প্রায়োগিক জ্ঞান এবং দক্ষতার ওপর। বর্তমান শ্রমবাজার বিবেচনায় একজন শিক্ষার্থীকে প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি অবশ্যই যে দুটি বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে তা হলো, প্রযুক্তিগত এবং ভাষাগত দক্ষতা। কম্পিউটারসহ বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারে যে যতবেশি জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করবে, শ্রমবাজারে সে ততবেশি এগিয়ে থাকবে। আর মাতৃভাষার পাশাপাশি ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় দক্ষতার গুরুত্ব অপরিসীম।
যেকোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করে অবশ্যই বিশেষায়িত খাতে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ রয়েছে। তবে আমাদের দেশীয় শ্রমবাজারের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি বিষয়ের বিশেষায়িত সেক্টর এখনও বিস্তৃত নয়। তাছাড়া যেকোনও খাতে ক্যারিয়ার গড়তে সনদ অর্জনের পাশাপাশি প্রায়োগিক জ্ঞান ও দক্ষতাই বেশি দরকার। কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে থাকতে চাইলে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি দক্ষতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক সনদ কিংবা ভালো ফলাফল কর্মক্ষেত্রে প্রবেশপত্র মাত্র। হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে একজন ভালো ফলাফলধারী কিছু কিছু পজিশনের জন্য আবেদনের যোগ্যতায় অন্যজন থেকে এগিয়ে থাকে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে সফলতা নির্ভর করে ব্যক্তির জ্ঞান ও দক্ষতার ওপর।
তাই শিক্ষাজীবনে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি পাঠ্যবহির্ভূত (এক্সট্রা-ক্যারিকুলাম) কার্যকলাপের সঙ্গে সংযুক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের শ্রমবাজারের লক্ষ্যে প্রস্তুত করতে শিক্ষাব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে। যেখানে সিলেবাসে দক্ষতা উন্নয়নমূলক এক্সট্রা-ক্যারিকুলামে জোরারোপ করতে হবে। নেতৃত্বগুণ বৃদ্ধির জন্য ছাত্র রাজনীতি, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, খেলাধুলা, ছাত্র-সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন ধরনের স্বেচ্ছাসেবী কাজের সঙ্গে সংযুক্ততা ক্যারিয়ার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিক্ষাজীবনেই দক্ষতা উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পড়াশোনা করে ক্যারিয়ার গঠন কঠিন, যদি না সে দক্ষতা অর্জন করে। তাই নীতিনির্ধারক পর্যায় থেকে দেশের উচ্চশিক্ষার ধরন ও মান বিশ্লেষণ জরুরি।
লেখক: প্রোগ্রাম অফিসার, প্রজ্ঞা বাংলাদেশ।
Discussion about this post