তাসলিমা মুনা
মেলা! মেলা! মেলা!
এভাবেই মাইকিং, রংচঙে পোস্টার ও ব্যানার টাঙিয়ে চট্টগ্রাম নগরীতে বছরজুড়েই চলে চোখ ধাঁধানো-কানের পর্দা ফাটানো মেলার প্রচারণা। ঐতিহ্যবাহী পুরনো মেলাগুলোর সাথে নিত্যনতুন যোগ হচ্ছে আরো। নারী উদ্যোক্তা মেলা, ঈদ মেলা, এসএমই মেলা, ফরমালিন মুক্ত আম-জামের মেলা (আমের মৌসুম শেষ হলেও যে মেলা শেষ হয়না), বস্ত্র-শিল্পসহা হরেক রকম। আছে ইদানিং কালের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা।
আবহমানকাল ধরে গ্রামে-শহরে মেলাকে ঐতিহ্যবাহী এক সামাজিক উৎসব হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। মেলাকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন এলাকার স্ব স্ব শিল্পের বিখ্যাত পণ্যসামগ্রী প্রস্তুত হয় এবং আনন্দমুখর পরিবেশে এদের বাণিজ্যিক বিনিময় ঘটে। গ্রামগঞ্জে, সাধারণত বছরের একটা নির্দিষ্ট নির্ধারিত সময়ে মেলায় বিক্রির জন্য নানান কুটিরশিল্প, হস্তশিল্পজাত পণ্য, কৃষিসামগ্রী, ভোগ্যপণ্য ও মনোহারী দ্রব্যের বিপুল সমাহার ও লেনদেন হয়। এদিকে, শহুরে জীবনে বর্ষাকালে বৃক্ষমেলা, স্বাধীনতার মাসে বিজয় মেলা, এবং পুরো ফেব্রুয়ারি জুড়ে বই মেলা বাঙালি ঐতিহ্যে গৌরবের সাথে সংযোজিত হয়েছে। মূলত, বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এবং সল্প সময়ের জন্য আয়োজন করা হয় বলেই মেলা সকলের জন্য বহুল আকাঙ্ক্ষিত।
মেলায় সীমিত সময়ের জন্য বিপুল পরিমাণ পণ্য ও ক্রেতা সমাগম আয়োজন করতে সঙ্গত কারণেই সুবিধাজনক বড় খোলা জায়গা প্রয়োজন হয়। আর তাই যুগ যুগ ধরে গ্রাম-গঞ্জে খোলা মাঠ, বা খালি কৃষিজমিতে মেলার আয়োজন হয়ে আসছে। এই প্রথার অনুকরণে এতকাল শহরেও খোলা মাঠে মেলা আয়োজন হয়েছে। যথেষ্ট পরিমাণ খালি জায়গা থাকায় এবং বছরের একটা ছোট্ট সময়ের মধ্যে মেলা ফুরিয়ে যেত বলে এতদিন খেলার মাঠে মেলা আয়োজন নাগরিক জীবনে সেরকম বিঘ্ন সৃষ্টি করেনি।
কিন্তু বর্তমান সময়ে জনবহুল এই শহরে যেখানে প্রতি ইঞ্চি মাটিতে চলছে স্থাপনা নির্মাণের প্রতিযোগিতা, আকাশ ছোঁয়া দালানের ভিড়ে যেখানে আবদ্ধ আলো-হাওয়া, দখল হয়ে গেছে বেশিরভাগ মাঠ-খাল-জলাশয়, সেখানেও আজো খেলার মাঠে মেলা আয়োজনের সংস্কৃতি বজায় আছে। শুধু তাই নয়, একটি মেলা শেষ না হতেই আরেকটি, এভাবে প্রায় সারা বছর ধরে মেলায় দখল হয়ে থাকছে নগরীর চিরচেনা মাঠগুলো।
যে মাঠ একসময় মুখরিত থাকতো অগণিত শিশু কিশোরের খেলাধূলা, শরীরচর্চা ও বৈকালিক ভ্রমণকারীদের পদচারণায়, যেখানে গাছের ছায়ায় বসে খোলা হাওয়া প্রাণ জুড়াতে পারতেন যে কোন শ্রেণী-পেশার মানুষ, এখন সেই সব মাঠ সারা বছর ঘেরা থাকে টিকেট কাউন্টার সমেত মেলার সীমানায়।
আর দশজন সাধারণ নাগরিকের মতো যে আমিও একসময় অধীর আগ্রহে মেলার অপেক্ষা করতাম, সেখানে আজ মেলার নামে আমার ভীষণ আতঙ্ক হয়। এমনকি মেলার পাশের রাস্তা যানজট পেরিয়ে অতিক্রম করার সময় মেলা নামক বাণিজ্যিক স্বার্থের এই অরুচিকর আয়োজন দেখে প্রচণ্ড ক্ষোভ ও হতাশায় মর্মে মর্মে পীড়িত বোধ করি।
বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরে বেশ কিছু খোলা মাঠ ও পার্ক রয়েছে যেগুলো, হয় কোন বিশেষায়িত সংস্থাধীন (যেখানে সাধারণের প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত), বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান অথবা কোন উন্নয়ন সংস্থার তদারকিতে রয়েছে। বাদবাকি নির্ভেজাল ও সাদাসিধে খেলার মাঠ অর্থাৎ সর্বসাধারণের জন্য যেগুলো উন্মুক্ত এরকম মাঠের সংখ্যা হাতেগোনা মাত্র গুটিকয়।
এরকম প্রসিদ্ধ কিছু মাঠ, যেগুলোর নামের সাথেই জড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের গৌরবময় অতীত, চট্টগ্রামবাসীর আবেগ ও ভালোবাসা, কয়েক বছর আগেও যেখানে সর্বসাধারণের প্রবেশাধিকার ছিল, আজ সেই মাঠগুলো স্বমহিমা হারিয়ে পরিণত হচ্ছে নিছক ব্যবসাক্ষেত্রে।
বিগত বেশ কয়েক বছর যাবত আউটার স্টেডিয়াম, পলোগ্রাউন্ড, ম্সুলিম হাই স্কুল মাঠ এবং বাওয়া স্কুল মাঠ এক নাগাড়ে বাণিজ্যিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লালদীঘি মাঠ হিসেবে পরিচিত মুসলিম হাইস্কুলের নামে যে বিরাট কাঠের বোর্ডটি এতদিন মাঠটির পরিচয় বহন করত এখন সেটি রাতারাতি উধাও হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন যাবত বেষ্টনী দিয়ে ঘিরে ওই মাঠের ভিতর কি ধরনের কর্মযজ্ঞ ঘটেছে তা সাধারণ মানুষের কাছে অস্পষ্ট। এদিকে, সিআরবি শিরিষতলার মাঠ এলাকায় বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের অপ-পরিকল্পনাটিও আজ কারো অজানা নয়।
করোনাকালীন মেলার দৌরাত্ম্য কিছুদিন বন্ধ থাকলেও এখন আবার সেগুলো শুরু হয়েছে। মাঠ দখলের তালিকায় এ বছর নতুন করে নাম লেখালো পাহাড়তলি রেলওয়ে এলাকার সুপ্রাচীন শাহজাহান মাঠ। এখানে এবার প্রথমবারের মতো বাণিজ্য মেলা আয়োজন করা হয়েছে। এই মাঠের সীমানা দেওয়ালের ঠিক ওপারেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতার স্মৃতিবিজড়িত আত্মাহুতির স্থান। বর্ষীয়ান শিরিষ গাছের ছায়ায়, মায়াময় এই মাঠে মেলা শুরুর আগ দিন পর্যন্ত খেলা করেছে অগণিত শিশু-কিশোর। মাঠের তিনপাশ ঘিরে মনোরম বসার স্থানে ছিল এলাকাবাসীর শান্তিময় আনাগোণা।
মেলাতে কেনাকাটা করার কোনরকম আগ্রহ না থাকলেও টিকেট কেটে, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ওই মেলাতে আমি গিয়েছিলাম। স্বচক্ষে দেখে এসেছি কেমন করে আমাদের প্রিয় চট্টগ্রাম নগরের আরো একটি নান্দনিক স্থানের অবমাননা ঘটছে। ঠিক সেই চিরাচরিত কাপড়, তৈজষপত্র, খেলনা-গহনার দোকান, খরচ পোষাতে দোকানির নিম্নমানের পণ্যে গলাকাটা দাম হাঁকা, মাঠের মাঝে দৃষ্টিকটু নকল ফোয়ারা, সস্তা বিনোদনের জন্য প্লাস্টিক দিয়ে বানানো নোংরা জলাধারে হাস্যকর ওয়াটার রাইড, আরো আছে প্রচুর খাবারের দোকান।
বালিময় ফুচকা, অস্বাস্থ্যকর বিরিয়ানি-কাবাবের দোকান থেকে শুরু করে সবরকম রাইড, সবকিছুরই অতি উচ্চমূল্য। সুস্থ বিনোদনের সুযোগ নগরীতে খুব কম থাকায় এসমস্ত আয়োজনে সাড়াও মন্দ নয়, আয়োজক ব্যবসায়ীরা বাড়াচ্ছে মুনাফা।
তাই, ফের সেই পুরনো আশঙ্কা উঁকি দিচ্ছে। মেলার সময়সীমা হয়তো বাড়ানো হবে। এই মেলা শেষ হলে হয়তো ভিন্ন নামে শুরু হবে নতুন আরেক মেলা। এই মাঠে আর হবে না কোন ক্রিকেট ম্যাচ, বর্ষাকালে কাদামাঠে ফুটবল খেলা, মাঠের রাজা কিশোর-যুবাগণ অসহায় দৃষ্টিতে চোখের সামনে হাতছাড়া হয়ে যেতে দেখবে ওদের এতদিনকার আপন রাজত্ব।
সাধারণ জনগণ কিন্তু মেলাবিরোধী নয়। মেলা এখনো সামাজিক জীবনে বিনোদনের অনুষঙ্গ। বরং, নগর জীবনের সাথে তাল মিলিয়ে মেলার ধারণাকে নতুন করে সাজানো উচিত। তখন নতুন অবয়বে মেলাও নাগরিক সাধারণের দেহমনের পুষ্টিবিধানের সহায়ক হবে।
মেলার জন্য খোলা মাঠ ব্যবহৃত হতে হবে, এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত মাঠে মেলা বা অন্য কোনরকম বাণিজ্যিক আয়োজন করা যাবে না। সেক্ষেত্রে মেলার জন্য উপযুক্ত আকারের কমিউনিটি হলগুলো বেছে নেয়া যেতে পারে। অগণিত শপিংমলের শহর চট্টগ্রামের বহু শপিংমল এখন প্রায় ক্রেতাশূন্য। সেই সমস্ত মলেও হয়তো মেলা আয়োজন সম্ভব। লাগাতার ছোটখাট মেলা না করে বড় আকারে সীমিত সময়ের মধ্যে মেলা শেষ করতে হবে।
এবারে বাণিজ্য মেলার বিশেষ আকর্ষণ আরএফএল, প্রাণ, হাতিল ফার্নিচার, লিভার ব্রাদার্সের মতো নামকরা প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি শাহজাহান মাঠের মেলায় দেখতে পাওয়া যায়নি। এর কারণ জানা না থাকলেও আমি তাদের সাধুবাদ জানাই। বছর জুড়ে এসমস্ত কোম্পানি নিজেদের শোরুম ও ওয়েবসাইটে সফল বিক্রয় উৎসব করে থাকে। সঙ্গত কারণেই তারা খেলার মাঠে বাণিজ্য মেলা বর্জন করে নিজেদের সফল ব্যবসা নীতি বজায় রাখতে পারেন।
সুস্থ দেহমন নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য খোলা মাঠ নাগরিকের অতি আবশ্যকীয় চাহিদা ও অধিকার। মেলা, কৃত্রিম ওয়াটার ওয়ার্ল্ড, এমিউজমেন্ট পার্কের সস্তা বিনোদন কখনই দিতে পারে না স্বাভাবিক জীবনের স্বতঃস্ফূর্ততা। সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত পরিসর ও নির্বিঘ্ন পায়ে হাঁটার পথ না থাকলে, অবাধে পাহাড়, জলাশয়, বৃক্ষরাজি ধ্বংস হতে থাকলে এই নগর ক্রমে বিষণ্ন, হতাশাগ্রস্ত, প্রাণহীন ইট-পাথরের জঙ্গলে পরিণত হবে।
খেলা-ধুলা, শরীরচর্চা ও প্রাতঃভ্রমণের খাতিরে চট্টগ্রাম শহরের সমস্ত মাঠ সর্বসাধারণের জন্য অবমুক্ত করা হোক। সুস্থতা ও প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসুক করোনাক্রান্ত নাগরিক জীবনে।
লেখক: যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরাম
Discussion about this post