রণেশ মৈত্র
বাংলা ভাষা, বাঙালি জাতির মাতৃভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে জাতিকে পথে নামতে হয়েছিল প্রধানত দু’বার। প্রথমবার ১৯৪৮ সালে এবং দ্বিতীয়বার ১৯৫২ সালে। ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনে নারীর ভূমিকা আজও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পেলেও বাঙালি জাতীয়তাবোধ এবং জাতীয় চেতনা বিকাশে ভাষা আন্দোলন সর্বাধিক অবদান রেখেছিল।
বাঙালিকে খাঁটি মুসলমান বানানোর জন্য তারা প্রথমেই হাতে নিয়েছিল বাঙালির মাতৃভাষা বাংলাকে একটি তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদায় নামিয়ে দেওয়ার এক ঘৃণ্য চক্রান্ত। বাংলা মুসলমানের ভাষা নয়- ইসলামবিরোধী ভাষা এই বক্তব্য নিয়ে মঞ্চে এসেছিলেন মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ও তার দল মুসলিম লীগের বাঙালি-অবাঙালি নেতারা। এর সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটল ১৯৪৮ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে। পাকিস্তান নতুন রাষ্ট্র, তাই তার নতুন কিছু আইনকানুন, নতুন কিছু দিকনির্দেশনা স্থির করার লক্ষ্যে আহূত ওই অধিবেশনে পূর্ব বাংলা থেকে অন্য অনেকের মধ্যে অংশগ্রহণ করেছিলেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি সংসদে প্রথম দাবি উত্থাপন করলেন- সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তানি নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
এই দাবি উত্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান। খাজা নাজিমুদ্দিন প্রমুখ বলেন, বাংলা কদাপি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না। কারণ বাংলা হলো ভারতের ভাষা, হিন্দুর ভাষা, ইসলামবিরোধী ভাষা। এ দাবি যারা উত্থাপন করেন তারা পাকিস্তানের দুশমন, ভারতের দালাল। ধীরেন নাথ দত্ত হার মানার মানুষ ছিলেন না। তিনি অধিবেশন পরিত্যাগ করে যত দ্রুত পূর্ব বাংলায় ফিরে আসেন। দেশি-বিদেশি বেতারে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ওই অধিবেশনের খবর প্রকাশিত হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বামপন্থি যুবকরা ধীরেন দত্তকে বিপুল সংবর্ধনা দেন। ঠিক ওই মুহূর্ত থেকেই বলা যায়, সাম্প্রদায়িকতার পশ্চাদপসরণের প্রক্রিয়া। ছাত্রসমাজের নতুন ধারার ঐক্য গড়ে উঠতে থাকে- সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন করতে হবে; আন্দোলনের দিন স্থির হলো ১১ মার্চ, ১৯৪৮। গঠিত হলো ভাষা আন্দোলন ধারাবাহিকভাবে পরিচালনার জন্য একটি সংগঠন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। সারাদেশের তরুণ ছাত্রসমাজের মুখ থেকে ‘মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ’ পরিবর্তে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘হিন্দু-মুসলিম ভাই ভাই’ স্লোগান উচ্চারিত হয়। ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী হরতাল পালিত হলো। তার প্রস্তুতি চলতে থাকল পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে- দেশের প্রতিটি স্কুল ও কলেজে। সর্বত্র গঠিত হতে থাকল সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। বসে থাকেনি মুসলিম লীগ সরকারও। আন্দোলন বানচাল করার জন্য ১৪৪ ধারার নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো। কিন্তু আন্দোলনকারী ছাত্রসমাজ মিছিল বের করবেই। ভাষা আন্দোলনের শুরুতে জনগণের সামনে লাখো কণ্ঠে আওয়াজ তোলে- ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘১৪৪ ধারা জারি করা চলবে না-চলবে না’, ‘ভাঙবোই- ষড়যন্ত্রের ৪৪ ধারা ভাঙবোই’।
১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল আর মিছিল করার মধ্য দিয়েই ভাষা আন্দোলনের উদ্বোধন হলো ১১ মার্চ। ১৯৪৮ সালে বাংলার রাজপথে চলল গুলি। চলল ব্যাপক ধরপাকড়। কেউ অল্পদিনে মুক্তি পেলেন, কাউকে-বা বছরের পর বছর আটকে রাখা হলো। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পতাকা দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছিল। এই সময়কালের মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর ‘উর্দু অ্যান্ড উর্দু অ্যালাউ শেল বি দ্য স্টেট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান’ উক্তির সঙ্গে সঙ্গে তীব্র প্রতিবাদ এক ছাত্রনেতার। তিনি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘নো’। তৎক্ষণাৎ আর বক্তৃতা না দিয়ে তিনি পালিয়ে গেলেন করাচি। এমন আরও নানা ঘটনার পর ১৯৫২ এলো। ইতোমধ্যে গঠিত হয় আবদুল মতিনের নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। আর রাজনৈতিক নেতা ও সুশীল সমাজের সমবায়ে গঠিত হয় মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ এবং ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনকালে জেলে আটক ছিলেন। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় আলোচিত হয়, ২১ ফেব্রুয়ারিতেও যদি ১৪৪ ধারা জারি করা হয় তা হলে কর্তব্য কী হবে তা নিয়ে। সভায় সামনে নির্বাচন থাকায় ১৪৪ ধারা জারি হলে তা ভাঙা ঠিক হবে না বলে দুটি দলের প্রতিনিধিদের কেউ কেউ বলেন। এই বক্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ব্যাপক আলাপ-আলোচনা করে স্থির হয় ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ডাকা ছাত্র সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে কিংবা হবে না- এই উভয় মতই ব্যাখ্যা করে ছাত্রদের মতামত আহ্বান করতে হবে। তাতে সাধারণ ছাত্ররা যেদিকে সমর্থন দেবেন, তা-ই মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি। উত্তাল ঢাকা মহানগরী, উত্তাল সমগ্র পূর্ব বাংলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় বিশাল ছাত্রসভা শুরু হলো। সভাপতিত্ব করেন গাজীউল হক। ছাত্রনেতারা দুটি মত ব্যাখ্যাসহ পেশ করলে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করার। ঢাকা শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা মিছিল করে সারা রাস্তা স্লোগান দিতে দিতে জমায়েত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক বটতলায়। মেয়েরাও আসে, যেন জীবন দিতে প্রস্তুত তারা। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১০ জন করে গেট দিয়ে বেরোতে শুরু করলেন ছাত্রছাত্রীরা। সামনে মেয়েরা। পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে গগণবিদারী স্লোগান দিয়ে মিছিল অগ্রসর হতে থাকল সাবেক অ্যাসেমব্লি হাউসের দিকে। উদ্দেশ্য ছিল, অধিবেশন চলা অবস্থায় তারা গিয়ে স্পিকার ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দেবেন। কিন্তু কিছুদূর অগ্রসর হতেই মেডিকেল কলেজের কাছে পুলিশ গুলি চালাল। ঝরে পড়ল কয়েকটি অমূল্য প্রাণ। রক্তে ভেজা রমনার পথ থেকে মৃতদেহগুলো পুলিশ সরিয়ে ফেলল। অ্যাসেমব্লিতে গিয়ে পৌঁছাল গুলির খবর। বেরিয়ে এলেন আন্দোলনের সমর্থনে পরিষদ সদস্য মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ। কংগ্রেসদলীয় সদস্যরা প্রতিবাদে ফেটে পড়লেন। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল ভাষা আন্দোলনের মিছিলে গুলির খবর। প্রতিবাদে পরদিনও হরতাল আহূত হলো দেশব্যাপী। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানের বাঙালিবিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে সক্ষম হয়েছিল। রাষ্ট্র বা ব্যক্তি অপর কোনো ধর্মে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসীর বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচার চালানো কিংবা কেউ অন্য ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আক্রমণ করবে না। রাষ্ট্র হবে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ- এই প্রত্যয়গুলো স্পষ্ট হলো।
ক্রমান্বয়ে বাঙালি সংস্কৃতির আদি রূপ প্রকাশিত হতে থাকল। যেমন বাংলা ভাষায় ইতিহাস, সাহিত্য ও উপন্যাস, গল্প, কবিতার বই এবং নাটক প্রকাশিত হতে থাকল। একুশে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন শুরু হলো। শহীদ বেদিতে পুষ্পার্পণ (যাকে পাকিস্তানি নেতারা ইসলামবিরোধী বলে আখ্যায়িত করতেন) বেদির চারদিকে মেয়েরা আলপনা আঁকা শুরু করলেন। দেশব্যাপী অনেক সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠতে শুরু করল। নাট্যাভিনয় শুধু শুরু হলো তাই না, তাতে নারীর ভূমিকায় নারীর অভিনয় পুনরায় শুরু হলো; নৃত্যশিল্পের বিকাশ ঘটল। বাংলা চলচ্চিত্রে নতুন নতুন গণমুখী ভাবধারার নির্মল বিনোদন তৈরি হতে থাকায় এ শিল্পের বিকাশ ঘটল। এভাবে বাঙালি চেতনা ও বোধ যে জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি করল তা যে কোনো দেশের জন্যই গৌরবজনক। বস্তুত এভাবে বহুমুখী ধারায় একুশ আমাদের ভাবনার মোড় ফেরাল।
আজকের সার্বিক রূপটি বিবর্ণ। আন্দোলনের পর কেটে গেছে সাত দশক। কথা ছিল একুশের চেতনা ও অর্জন দিনে দিনে আমরা আরও বিকশিত করে তুলব, কিন্তু ঘটল এর বিপরীত। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, গাজীউল হক, আবদুল মতিন, তোয়াহা প্রমুখকে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাদের কোনো ভাস্কর্য গড়ে তোলা হলো না, পাঠ্যবইয়ে তাদের উপযুক্ত মর্যাদা দেওয়া হলো না। একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জাতীয় প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসা হলো। ভাষা আন্দোলন না হলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না- এমন কথা মুখে বললেও আজও ভাষাসংগ্রামীদের কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করে তার সরকারি গেজেট প্রকাশ করা হলো না। ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক যে সংবিধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়েছিলেন, তা উল্টে দিয়ে সংবিধানটির ইসলামীকরণ করা হলো। শিক্ষাব্যবস্থার সাম্প্রদায়িকীকরণ করা হলো।
রণেশ মৈত্র :রাজনীতিক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
raneshmaitra@gmail.com
Discussion about this post