শিক্ষার আলো ডেস্ক
৭০ বছরেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানের গীতিকার ও সুরকার কবি শামসুদ্দিন। কবিকে তার প্রাপ্য সম্মান দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন পরিবার ও এলাকাবাসী। তবে কবিকে মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক।
জানা গেছে, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিলে নামে বাংলার দামাল ছেলেরা। কলা ভবন থেকে বের হয়ে মিছিলটি এগিয়ে চলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন রফিক, জব্বার, সালাম, বরকতসহ আরও অনেকে। প্রতিবাদস্বরূপ সেদিন রাতেই বাগেরহাটের চারণ কবি শেখ শামসুদ্দিন আহমদ রচনা করেন ‘রাষ্ট্রভাষা’ নামে ভাষা আন্দোলনের প্রথম গান।
‘রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনও করিলিরে বাঙালি, তোরে ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি। ও বাঙালি…ওওওও।’ নিজের লেখা গান গেয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্র-জনতাকে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি। জানা যায়, সে সময় তিনি শহরের বিভিন্ন স্থানে ‘রাষ্ট্রভাষা’ গান গেয়ে ভাষা অন্দোলনে গতি সঞ্চার করেন। তার এ গান এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠে যে স্বল্প সময়ে মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও গানটি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের।
১৯১৫ সালে বর্তমান বাগেরহাট জেলার সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের ফতেপুর গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চারণকবি শামসুদ্দিন। তার বাল্যশিক্ষা শুরু হয় বাগেরহাট টাউন স্কুলে (বর্তমান বাগেরহাট বহুমুখী কলেজিয়েট স্কুল)। এখানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি লোখাপড়া করেন। তবে পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ হয়নি।
শামসুদ্দিনের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। অভাবের সংসারে শামসুদ্দিনের ছেলেমেয়েরাও পড়ালেখা করতে পারেননি। এর মধ্যে মেয়ে লাইলি বেগম মারা গেছেন বছর খানেক আগে। ছোট ছেলে মুকুল শেখ ঢাকায় চাকরি করেন। শামসুদ্দিনের বড় ছেলে শেখ দেলোয়ার হোসেন খোকন বাড়িতেই থাকেন। তিনি বলেন, আমার বাবা হাটবাজারে ফেরি করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করতেন। একইসঙ্গে গান লিখতেন। ভাষা আন্দোলন নিয়েও তিনি গান লিখেন। গানগুলো জনপ্রিয়ও ছিল। তবু তিনি রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি পাননি। আমরা চাই অন্তত মরণোত্তর সম্মাননা যেন তিনি পান।
ফতেপুর গ্রামের বাসিন্দা এনামুল হক বলেন, চারণকবি শেখ শামসুদ্দিন ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক। ভাষা আন্দোলনের সময় লেখা তার গান সারা বাংলাদেশে তখন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল,অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছাত্র-জনতার মধ্যে। অথচ ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর পার হলেও এখনো কেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি তিনি পাননি। সরকারের কাছে আমাদের এলাকাবাসীর দাবি ভাষা আন্দোলনের প্রথম গানের গীতিকার ও সুরকার এই কবিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
বেমরতা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনোয়ার হোসেন টগর বলেন, স্থানীয়ভাবে কবির সম্মানে তার বাড়ির সামনে একটি গেট, কবরটা বাঁধাইসহ ইউনিয়ন পরিষদে কবির নামে একটি পাঠাগার নির্মাণ করা হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তিনি আজ পর্যন্ত স্বীকৃতি পাননি। সরকারের কাছে প্রয়াত কবির মরণোত্তর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবি জানান তিনি।
বাগেরহাটের প্রবীণ শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মোজাফ্ফর হোসেন বলেন, চারণকবি শামসুদ্দিন পেশায় তেলবিক্রেতা ছিলেন। তবে ছোটবেলা থেকেই তিনি গান পরিবেশনা করতেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে তার প্রথম গান গণজাগরণে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। ভাষা আন্দোলনের পরে অনেক অনুষ্ঠানেই চারণকবি শামসুদ্দিনকে নিয়ে যাওয়া হতো গান পরিবেশনের জন্য। তবে পরবর্তী সময়ে অভাব-অনটনে ভুগে তার মৃত্যু হয়।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, ভাষা আন্দোলনের সময় চারণকবি শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ তার গানের মাধ্যমে জনসাধারণকে ভাষা আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। কবির রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কবির পরিবারের সদস্যদের সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন তিনি।
১৯৭৪ সালে চারণকবি শেখ শামসুদ্দিনের জীবনাবসান ঘটে। বাগেরহাট-পিরোজপুর সড়কের পাশে নিজ গ্রাম ফতেহপুরে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন তিনি। courtesy- dhaka post
Discussion about this post