নাসির আহমেদ
বাংলা সাহিত্যেরই নতুন দুয়ার খুলে দিল অমর একুশে; ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভাষাশহীদদের স্মরণে কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামের সাহিত্য সংকলন প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
কিন্তু এই ঐতিহাসিক সংকলনেরও আগে রাজধানী থেকে বহু দূরের শহর চট্টগ্রামে বসে একটি কবিতা লিখে ইতিহাসে নিজেকে অমরতা দিলেন এক তরুণ কবি, তার নাম মাহবুব উল আলম চৌধুরী (১৯২৭-২০০৭)। ওই সময় তিনি যত না ছিলেন কবি, তার চেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন রাজনীতি সচেতন প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের আগেই মাহবুব উল আলম চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের সকল রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অগ্রগামী কর্মী। তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সীমান্ত’ নামের এক অসামান্য সাহিত্য পত্রিকা, যা প্রগতিশীল রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক চেতনার শক্ত প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছিল। সংগত কারণেই ২৫ বছরের টগবগে যুবক মাহবুব উল আলম চৌধুরী বাহান্ন সালে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের ভাষা আন্দোলনে। তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক। জোর প্রস্তুতি চলছে ভাষা আন্দোলন সফল করার। দিনরাত পরিশ্রমের ধকলে মাহবুব উল আলম চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়েন। ঢাকায় যে দিন মিছিলে গুলি চালানো হয়, তার আগেই জ্বর এবং জলবসন্তে আক্রান্ত হন তিনি। প্রচণ্ড জ্বরে শয্যাশায়ী কবি খবর পেলেন ঢাকার রাজপথে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়েছে, রফিক, বরকত, জব্বার, সালামসহ অনেক তরুণের আত্মত্যাগের খবর। দুঃখের ক্রোধে আবেগে বিহ্বল কবি মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী সেই জ্বরাক্রান্ত শরীরেই শয্যাশায়ী অবস্থায় লিখে ফেললেন অমর একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি- ফাঁসীর দাবী নিয়ে এসেছি’। লেখার ক্ষমতাও তার ছিল না, মুখে মুখে বললেন একের পর এক সেইসব পঙ্ক্তিমালা, যা শরীর গঠন করেছে এই দীর্ঘ কবিতার।
ক্রোধান্বিত বেদনাতুর কবি হাত বাড়ালেন কাগজ-কলমের খোঁজে। এতটাই অসুস্থ ছিলেন তিনি যে, নিজের হাতে লেখার ক্ষমতাও ছিল না। কবি মুখে মুখেই বলতে থাকলেন একের পর এক কবিতার চরণ, আর শুনে শুনে তা লিখে নিচ্ছিলেন কবির ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ননী ধর :
এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে/রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়ার গাছের তলায়/যেখানে আগুনের ফুলকির মতো/এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ/সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি…
এখানেই ইতিহাসের তথ্য হয়ে ওঠে ঘটনাপ্রবাহ। ‘কিছুক্ষণ পর সেখানে উপস্থিত হন কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সাংবাদিক-সাহিত্যিক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। সিদ্ধান্ত হলো কবিতাটি দ্রুত প্রকাশ করার। ঠিক হলো আন্দরকিল্লায় কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসে কবিতাটি পুস্তিকা আকারে ছাপা হবে। তবে সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কাজটি সমাধান করাও এক দুরূহ ব্যাপার। তাই পরিকল্পনা নেওয়া হলো সারারাত গোপনে প্রেসে কাজ করে সকালেই পুস্তিকাটি প্রকাশ করার। শীতের গভীর রাত, কম্পোজ ও প্রুফের কাজ প্রায় শেষ- এমন সময় পুলিশ হানা দিল প্রেসে। খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস লুকিয়ে পড়লেন। প্রেসের কর্মচারীরা অতি দ্রুত এবং দক্ষতার সঙ্গে সম্পূর্ণ কম্পোজ ম্যাটার এমনভাবে লুকিয়ে ফেললেন যে, পুলিশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পেল না। পুলিশ চলে যাওয়ার পর আবার পুরোদমে শুরু হলো ছাপার কাজ। কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের কর্মচারীদের উদ্যম এবং তৎপরতায় গোপনে পুস্তিকাটির প্রায় ১৫ হাজার কপি বিক্রয় ও বিতরণের জন্য মুদ্রণ ও বাঁধাইয়ের কাজ শেষ হয়। এর দাম রাখা হয় দুই আনা। ২৩ ফেব্রুয়ারি লালদীঘির ময়দানে কবিতাটি প্রথম জনসম্মুখে আবৃত্তি করলেন চৌধুরী হারুনুর রশীদ। কবিতা শুনে ময়দানে জড়ো হওয়া জনতা ফেটে পড়ল বিক্ষোভে। মুহুর্মুহু স্লোগানে কেঁপে উঠল পাক মসনদ। শতসহস্র বুলেটের চাইতেও এই ক’টি লাইন কত শক্তিশালী তার প্রমাণ মিলল- পাক সরকার কবিতাটি কিছু দিনের মধ্যেই বাজেয়াপ্ত করল। কবিতাটি নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী, প্রতিবাদ সভায় কবিতাটির পাঠক চৌধুরী হারুনুর রশীদ, প্রকাশক কামাল উদ্দিন আহমদ বি.এ.-র বিরুদ্ধে জারি করা হলো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। চৌধুরী হারুনুর রশীদ এবং প্রেস ম্যানেজার দবির আহমদ চৌধুরীকে দ্রুত গ্রেপ্তারও করা হয়।
দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ থাকার পরে চৌধুরী জহুরুল হক এই কবিতার দুর্লভ কপি উদ্ধার করেন। কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরী ওই কবিতা যে কী তীব্র আবেগে বিহ্বল হয়ে রচনা করেছিলেন, তা আজ উপলব্ধি করা যায়। তিনি ওই কবিতায় লিখেছেন :ওরা চল্লিশজন কিংবা আরো বেশি /যারা প্রাণ দিয়েছে ওখানে- রমনার রৌদ্রদগ্ধ কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়…”।
চট্টগ্রামে বসে আজ থেকে ৭০ বছর আগে অনুমান করা অসম্ভব ছিল ঢাকায় গুলিতে কতজন নিহত হয়েছেন! স্থবির প্রায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় তথ্যের আদান-প্রদান আজকের মতো সহজ ছিল না। কিন্তু মাহবুব উল আলম চৌধুরী যে চল্লিশজনের কিংবা তারও বেশি তরুণের মৃত্যুর কথা লিখেছিলেন, সেই সংখ্যা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে তার শোকের তীব্রতা আর ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ। যে শহীদদের তিনি তুলনা করেছিলেন ভবিষ্যতের লইয়া রাগো কিংবা আইনস্টাইনের মতো বিশাল সম্ভাবনাময় ব্যক্তিত্বে। শহীদরা প্রাণ দিয়েছিলেন, যা রক্ষা করতে তার উপমা ব্যবহার করেছিলেন কবি ভাটিয়ালি গান, বাউল, কীর্তনের মতো বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতির। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রমেশ শীল, জসীম উদ্দীনের মতো কবিদের কাব্যের ঐশ্বর্য রক্ষার জন্য তারা প্রাণ দিয়েছিলেন বলে কী অসামান্য উপমা ব্যবহার করেছেন তিনি। শহীদদের কবি দেখেছিলেন বাঙালির ঐতিহ্যবাহী হাজার বছরের সংস্কৃতি রক্ষার সৈনিক হিসেবে।
একুশের প্রথম কবিতাটির শেষাংশে কবি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, পরবর্তীকালে তা-ই বাস্তবে রূপ লাভ করেছে। শহীদদের উদ্দেশ করে তিনি লিখেছিলেন :’খুনী জালিমদের নিপীড়ন কারী কঠিন হাত/ কোন দিনও চেপে দিতে পারবে না/ তোমাদের সেই লক্ষ্যদিনের আশাকে,/ যেদিন আমরা লড়াই করে জিতে নেব/ ন্যায় নীতির দিন/ হে আমার মৃত ভাইরা/ সেই দিন নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে/ তোমাদের কণ্ঠস্বর/ স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চীৎকারে/ ভেসে আসবে।… তোমাদের আশা অগ্নিশিখার মতো জ্বলবে/ প্রতিশোধ এবং বিজয়ের আনন্দে। মুক্তিযুদ্ধের ১৯ বছর আগেই মাহবুব উল আলম চৌধুরী দেখেছিলেন এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিজয়ের ভবিষ্যৎ স্বপ্ন। একেই বলে বাইবেলিক ভার্স। এমন কবিতা লেখা যায় না, এটা নাজিল হয় কবির স্নায়ুকোষে।
মাহবুব উল আলম চৌধুরীর জন্ম ১৯২৭। ১৯৪৭ সালে, দেশ বিভাগের অব্যবহিত পর তিনি প্রকাশ করলেন ‘সীমান্ত’ নামে একটি উন্নত মান ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার সাহিত্য সাময়িকী। পত্রিকা প্রকাশ করতে গিয়ে মাহবুব উল আলম চৌধুরীকে নানা হয়রানির সম্মুখীন হতে হয়েছে। এর পরও তিনি হতোদ্যম হননি। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ‘সীমান্ত’র প্রকাশনা অব্যাহত ছিল।
লেখক
কবি
Discussion about this post