বিভুরঞ্জন সরকার
মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আত্মদানের ইতিহাস পৃথিবীতে খুব বেশি জাতির নেই, বাঙালিরই আছে। ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রক্ত রঞ্জিত হয়েছিল। কিন্তু বাংলাকে দূরে রাখা বা অবহেলা করার বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছিল ধর্মভিত্তিক এবং কিছুটা কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পরই, উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণর পর থেকেই।
পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠি চেয়েছে একমাত্র উর্দু আর বাঙালি দাবি তুলেছে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার। দাবিটি ছিল অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক। কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাঙালির ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য, আবার পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থাৎ ৫৬ শতাংশ মানুষও ছিলেন বাংলাভাষী। বেশি মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন সে ভাষারই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাওয়ার কথা। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি তাদের কায়েমি স্বার্থে এ চিরায়ত গণতান্ত্রিক নীতিবোধ ভেঙে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে বাঙালি তার প্রতিবাদ জানায়। পাকিস্তান ছিল একটি বহুভাষিক মানুষের দেশ। বাংলাভাষী সংখ্যায় বেশি। এছাড়া উর্দু, সিন্ধি, পস্তুভাষী মানুষও ছিলেন। সেজন্য বাঙালিদের দাবি ছিল একাধিক ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার। একমাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি কিন্তু তোলা হয়নি। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলা হয়েছিল।
পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি যুক্তির ভাষা বুঝতো না। তারা জোরের ভাষা প্রয়োগে পারদর্শী ছিল। আবার বাঙালির রক্তে বহমান প্রতিবাদের ধারা। সংখ্যাল্প মানুষের ভাষাকে ‘একমাত্র’ রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে তাই বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছিল প্রথম মুহূর্ত থেকেই। এই প্রতিবাদী ধারার একটি পরিণতির দিন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার তাৎক্ষণিকভাবে যারা প্রতিবাদ করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন সে সময়ের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর শেখ মুজিব একের পর এক ইতিহাস তৈরি করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি হয়েছেন জাতির পিতা। ইতিহাসের যিনি স্রষ্টা সেই নেতার নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ঘৃণ্য অপচেষ্টাও আমরা দেখেছি। কিন্তু এখন আবার বঙ্গবন্ধুকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে আমরা যেন অন্যদের অবদান ভুলে না যাই। একদিকে বেশি আলো ফেলতে গিয়ে অন্যদিক অন্ধকার করা এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা। এটা যেন আমাদের পেয়ে না বসে। কারণ একুশের মূল চেতনাই হলো সব অন্যায্যতার বিরোধিতা করা।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’। হ্যা, ঢাকার শহর রক্তে ভাসিয়ে সারাদেশে তার দ্যুতি ছড়িয়ে বাঙালি যে গৌরবের সমাচার তৈরি করেছিল তার ধারাবাহিকতাই আমাদের নিয়ে গেছে স্বাধীনতার পথে, গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধে। তাই একুশ আমাদের কাছে অহংকার। একুশ মানে মাথা নত না করা। শুরুতে একুশ ছিল শোকের দিন, শহীদ দিবস। কিন্তু ১৯৫২ থেকে ২০২২-এ এসে একুশে আর শোকের দিন নেই। একুশ এখন উদযাপনের, প্রতিজ্ঞা গ্রহণের, সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণার।
একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা এখনও নগ্নপদে প্রভাতফেরি করি, অমর ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তাদের স্মৃতি তর্পণ করি, ফুলে ফুলে শহীদ মিনারের পাদদেশ ভরে তুলি কিন্তু পরিবেশটা আর শোক দিবসের থাকে না। একুশে এখন উদযাপন করা হয় উৎসবের মেজাজে। এতেও দোষের কিছু নেই। একুশ আমাদের শোকে মুহ্যমান হতে শেখায়নি, শিখিয়েছে প্রতিবাদী হতে, বাধা অতিক্রম করে সামনে এগিয়ে যেতে। আব্দুল গাফফার চৌধুরীর লেখা একটি কবিতা শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গীত হয়ে একুশের অমর সঙ্গীত হয়ে উঠেছে। এমন বাঙালি কি আছেন যার মুখে কখনো ধ্বনিত হয়নি – ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’
না, আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে ভুলিনি। আমাদের জাতীয় জীবনে যখনই কোনো সংকট এসেছে তখনই একুশের স্মরণ নিয়ে আমরা সাহসে বুক বেধেছি। সংকটে আমরা বিহ্বল হইনি। একুশ আমাদের পথ দেখিয়েছে।
এত বছর পরে এসে একটি প্রশ্ন মনে প্রবল হয়ে ওঠে, আমরা একুশকে আড়ম্বর, আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে বন্দি করে ফেলছি না তো? একুশ পালনের আয়োজনের ব্যাপকতা আছে কিন্তু একুশের চেতনার সঙ্গে এসব আয়োজন সঙ্গতিপূর্ণ হচ্ছে কি? বাংলা আজ রাষ্ট্রভাষা। কিন্তু বাংলা ভাষার চর্চা ও ব্যবহারে আমরা কতটুকু যত্নবান? আমাদের মাতৃভাষার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ অটুট আছে তো? বর্তমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য বিদেশি, প্রধানত ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় মনোযোগী হয়ে বাংলাকে ‘অবহেলা’ করে ভুল করছি না তো? বাংলা ভালোভাবে শিখছি না। ইংরেজি বা অন্য বিদেশি ভাষা কি ভালোভাবে শিখছি? ইংরেজি শেখা আর ইংরেজিতে শেখা যে এক নয়,, সেটা আমরা মনে রাখছি তো? ফেব্রুয়ারি মাস এলে আমরা গদগদ হয়ে উঠি, নানা বোলচালে গণমাধ্যম মাতিয়ে রাখি, ফেব্রুয়ারি বিদায় নিলে আমরা বুঝি মনে মনে জপি, ‘একদিন বাঙালি ছিলাম রে’!
আমরা যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথা ভুলে না যাই: ‘রাষ্ট্রিক কাজে সুবিধা করা চাই বই-কি, কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কাজ দেশের চিত্তকে সফল ও সমুজ্জ্বল করা’। সে কাজ আপন ভাষা নইলে হয় না। দেউড়িতে একটা সরকারি প্রদীপ জ্বালালে চলে কিন্তু একমাত্র তারই তেল জোগাবার খাতিরে ঘরে ঘরে প্রদীপ নেবানো চলে না’। একুশ তো ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালানোরই বলিষ্ঠ প্রত্যয়।
আমরা মাতৃভাষায় শিক্ষার বিস্তার চেয়েছি, এখনো চাই। ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে চাই। আমরা উদারতা ও মানবিকতার প্রসার চাই। আমাদের দেশে শিক্ষিতের হার বাড়ছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষিত বাড়ছে কি? প্রগতিকামী না হয়ে একধরনের অন্ধত্ব কি আমাদের অনেককে গ্রাস করছে না? ধর্ম চর্চা বাড়ছে। কিন্তু মনের প্রসারতা বাড়ছে না। শান্তি ও সম্প্রীতির স্থান করে নিচ্ছে উগ্রতা এবং অসহিষ্ণুতা। একুশের চেতনার কথা বললে আমাদের অবশ্য সংকীর্ণতা ও কূপমণ্ডূকতার উর্দ্ধে উঠতে হবে।
বাংলা একাডেমি আয়োজিত মাসব্যাপী বইমেলা এখন একুশ উদযাপনের বড় অনুষঙ্গ। বইমেলার ব্যাপ্তি বেড়েছে। গত বছর করোনার কারণে বইমেলার আয়োজনে বিঘ্ন ঘটেছিল। এবারও তাই। তবে এটা বিশেষ পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতা। এটা স্থায়ী নিয়ম নয়। বরং এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল এলাকা জুড়ে প্রতি বছর বইমেলা হওয়াই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালেও ছয় শতাধিক প্রকাশনা সংস্থা বইমেলায় স্টল দিয়েছে। কিন্তু এই প্রকাশনা সংস্থাগুলো বই প্রকাশে কতটুকু যত্নবান? খুব চিন্তাভাবনা বা পরিকল্পনা করে কি বই প্রকাশ করা হয়ে থাকে? প্রতিদিন মেলায় শত শত নতুন বই এলেও তার মধ্যে কতগুলো বই মানসম্পন্ন, পাঠযোগ্য? হাজার হাজার মানুষ মেলায় আসা-যাওয়া করেন। এর মধ্যে কতজন বই কেনেন? সারা বছরে যদি একটি ভালো বই তিনশ কপিও বিক্রি না হয় তাহলে চলবে কেন? বই প্রকাশের সংখ্যা দেখে মনে হয় আমাদের দেশে লেখক বাড়ছেন- এটা আনন্দের বিষয়। কিন্তু একই সঙ্গে পাঠক না বাড়লে তো তাকে আদর্শ অবস্থান বলা যাবে না।
আমাদের সাহিত্যের মান নিয়েও প্রশ্ন আছে। গল্প-কবিতা-উপন্যাস-প্রবন্ধ কতটা পাঠকদের নজর কাটতে পারছে? সৃজনশীলতা-মননশীলতায় আমরা কি পিছিয়ে পড়ছি? বর্তমান সময়ের সেরা লেখক কে – এই প্রশ্ন যদি কারো মনে আসে তাহলে জবাব পাওয়া যাবে কি? একুশে উদযাপনের সময় এই সব প্রশ্নের জবাব খোঁজা প্রয়োজন বলেই মনে হয়। অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশ সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হচ্ছে, প্রযুক্তি ব্যবহারেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, সরকার দাবি করছে বাংলাদেশ এখন ‘উন্নয়নের রোল মডেল’। আমরা যদি সমৃদ্ধ জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারি তাহলে সেটা তো একুশের চেতনারই জয় বলে মনে হবে।
কিন্তু রাজনীতির দিকে তাকালে কি আমাদের মনে হয় আমরা একুশের চেতনার আলোকবাহী? দেশের রাজনীতি দোষারোপ, সংঘাত ও অনিশ্চয়তা থেকে বের হতে পারছে না – এ দায় কার? গণতন্ত্র চর্চাতেও যে আমরা শিশুকাল অতিক্রম করতে পারছি না – এটাও কি একুশে উদযাপনে আমাদের পীড়িত করে না? চিন্তনে ও মননে আমরা যদি বিকশিত হতে না পারি তাহলে একদিন হয়তো আমরা একুশের মর্মবাণী ভুলে কেবল খোলস নিয়েই মাতামাতি করবো। আমরা ভেতরে-বাইরে সমান রাঙা হওয়ার চেষ্টা থেকে যেন পিছু না হটি।
একুশে উদযাপনের সময় এই কামনাই করি যে, তেমন দুর্দিন বা দুঃসময় যেন আমাদের জীবনে না আসে।
Discussion about this post