আবুজার গিফারী
সালেহ বড় ব্যবসায়ী। রতনপুর বাজারে তার পেঁয়াজের আড়ত। পেঁয়াজের আড়ত হলেও এখানে অন্যান্য কাঁচামাল পাইকারি ও খুচরা দামে কেনাবেচা হয়। তিনি উপজেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ী হলেও উচ্চশ্রেণির কিছু ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। দেশের সব ব্যবসায়ীর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য তারা একটি সংগঠনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তারা গত বছরের শুরুতে একটি সভার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসে, বছরের মাঝ বরাবর বাজার থেকে সব পেঁয়াজ গুদামে মজুদ করবে এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তা বাজারে সরবরাহ করবে না। তারপর নির্দিষ্ট সময় শেষে চড়ামূল্যে সেগুলো বাজারজাত করবে। যে কথা সেই কাজ। জুলাই মাসে দেশের সব ছোট-বড় বাজারে পেঁয়াজের সংকট দেখা দেয়। হু-হু করে ৩০ টাকা কেজি দরের পেঁয়াজের মূল্য বেড়ে হয় কেজিপ্রতি ২০০ টাকা।
গতানুগতিক অপরাধপ্রবণতা থেকে ভিন্নধর্মী একটি অপরাধের নাম ভদ্রবেশী অপরাধ। ইংরেজিতে যা White Collar Crime নামে সমধিক পরিচিত। প্রচলিত সাধারণ শ্রেণির অপরাধ যেকোনো শ্রেণির ব্যক্তি দ্বারা সংঘটিত হতে পারে। তবে White Collar Crime চতুর ও উচ্চবিত্ত ব্যক্তিদের দ্বারা সংঘটিত হয়। কার্যত সব শ্রেণির মানুষের ভদ্রবেশী অপরাধ করার সুযোগ থাকে না। এমনকি সাধারণ মানুষ সহজে তা বুঝতে পারে না। অনেক সময় বুঝলেও তাদের কিছু করার উপায় থাকে না। অপরাধ বিজ্ঞানী Sutherland-এ অপরাধ সম্পর্কে পরিচয় দিতে গিয়ে বলেন, আর্থসামাজিকভাবে উচ্চশ্রেণির ব্যক্তি কর্তৃক এমন কর্মকাণ্ড, যা তাদের পেশাগত কাজের প্রক্রিয়ায় ঘটে থাকে। অর্থাৎ এমন একটি কাজ যেটা তাদের পেশাগত দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নির্ধারিত কাজ না করে অবৈধ সুযোগণ্ডসুবিধা গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট কাজটি সম্পন্ন করে। এমনকি অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ উচ্চশ্রেণির এবং অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ার দরুন অপরাধ করেও শাস্তি পায় না। ফলে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যায়।
আপাতদৃষ্টিতে এটি অপরাধ বলে মনে না হলেও অন্তর্নিহিত গুণ বিচারে এটা অবশ্যই অপরাধ বলে বিবেচিত। এজন্য এ অপরাধকে ভদ্রবেশী অপরাধ বলে বিবেচনা করা হয়। প্রত্যেক সমাজেই কমবেশি ভদ্রবেশী অপরাধ সংঘটিত হয়। বাংলাদেশ এর ব্যতিক্রম নয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোর দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো, দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিবিদ, অসৎ ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেআইনি সহযোগিতা ভদ্রবেশী অপরাধের পথকে সুগম করে দেয়। সমাজের উচ্চশ্রেণির লোকরা নিজের স্বার্থের জন্য বিশেষ করে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য এসব অনৈতিক ও অমানবিক কাজ করে। বাংলাদেশে সাধারণত যেসব White Collar Crime লক্ষ্য করা যায়, তার মধ্যে অন্যতম- আয়কর ফাঁকি, আমদানি-রপ্তানি শুল্ক ফাঁকি, ঘুষগ্রহণ, শেয়ারবাজারে কারসাজি, মজুদদারি, বিজ্ঞাপন ও বিক্রিতে মিথ্যা বর্ণনা ইত্যাদি। পাঠকের সুবিধার্থে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো একটু আলোচনা করার প্রয়োজন অনুভব করছি।
১. আয়কর ফাঁকি : এটি এমন একটি অপরাধ, যা আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ হরহামেশাই জড়িত। সঠিক হারে কর দেওয়া তো দূরের কথা, এ দেশের বেশির ভাগ করারোপযোগ্য ব্যক্তি নিজেকে করদাতা হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য প্রয়োজনীয় Taxpayers Identification Number (TIN) পর্যন্ত গ্রহণ করেন না। আয়কর প্রদানের সংস্কৃতি এ দেশে গড়ে ওঠেনি। সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তি থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদসহ প্রায় সবাই এ তালিকার অন্তর্ভুক্ত। সম্প্রতি সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এবং রাজস্ব বোর্ডের তৎপরতায় এসব চিত্র ফুটে উঠেছে।
২. আমদানি-রপ্তানি শুল্ক ফাঁকি : এক শ্রেণির কাস্টমস কর্মকর্তা, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে প্রায়ই ব্যবসায়ীদের শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগ উঠছে। যেসব দ্রব্যে শুল্ক কম বা শুল্ক নেই সেসব দ্রব্য আমদানির নামে অন্য দ্রব্য আমদানির কাজে দেশের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও বাদ পড়েনি।
৩. ঘুষ গ্রহণ : White Collar Crime-এর সর্বোৎকৃষ্ট ও বিস্তৃত ক্ষেত্র হচ্ছে বিভিন্ন স্তরে ঘুষের আদান-প্রদান। যেসব ব্যক্তি কোনো কাজ করিয়ে নিতে চায়, তারা তাদের নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ঘুষ দেন। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ওইসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর অর্থলিপ্সার কারণে ঘুষ দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। বাংলাদেশে সম্ভবত এমন কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে না যেখানে ঘুষ প্রদান ছাড়া কোনো সেবা পাওয়া যাবে বা কোনো কাজ উদ্ধার হবে। অযোগ্য ব্যক্তিরা তাদের স্বার্থ হাসিলের জন্যও ঘুষ প্রদান করে।
৪. শেয়ারবাজারে কারসাজি : কিছু কিছু কোম্পানি এবং শেয়ারবাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কৃত্রিমভাবে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে দেয়। ফলে সাধারণ মানুষ শেয়ারবাজারে ভিড় জমায়, শেয়ারের দাম বেড়ে যায়। কিছুদিন পর শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা উঠিয়ে ওইসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সরে পড়ে। এভাবে শেয়ারবাজারে কৃত্রিম দাম বৃদ্ধির ফলে সাধারণ শেয়ারহোল্ডাররা ক্ষতিগ্রস্ত হন।
৫. মজুদদারি : বিভিন্ন ধরনের পণ্য বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য মজুদ করে ব্যবসায়ীরা বাজারে ওই পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ফলে চাহিদার তুলনায় জোগান কম হওয়ার কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এভাবে মজুদদারি ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন আমাদের দেশের জন্য একটি চরম সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এটি সব সময় ঘটছে। সুতরাং সালেহসহ অন্য ব্যবসায়ীরা ভদ্রবেশী অপরাধের অন্তর্ভুক্ত এবং তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে বলে চিহ্নিত হবে।
৬. বিজ্ঞাপন ও বিক্রিতে মিথ্যা বর্ণনা : বিজ্ঞাপন হচ্ছে বিপণনের হাতিয়ার। পণ্যদ্রব্য ভোক্তাদের কাছে আকর্ষণীয় করে উপস্থাপনের প্রতিযোগিতায় প্রায়ই উৎপাদনকারীরা মিথ্যার আশ্রয় নেন। যেসব উপাদান ওই পণ্য উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়েছে বা যেসব কাজে ওই পণ্য ব্যবহার উপযোগী বলে বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই তা সঠিক নয়। পণ্যের মোড়কেও অনেক উপাদানের উল্লেখ থাকে যদিও ওই উপাদানগুলো পণ্যটিতে সঠিক পরিমাণে বা আদৌ উপস্থিত থাকে না। যেমন : বাজারে যেসব ফলের জুস পাওয়া যায়, উৎপাদনকারীরা তাদের বিজ্ঞাপনে বিভিন্ন ফলের নাম উল্লেখ করেন এবং মোড়কে সেসব রসালো ফলের আকর্ষণীয় রঙিন ছবি ছাপান। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তারা ওই জুসে ফল নয় বরং ফলের সুগন্ধ (Fruit Flavour) ব্যবহার করেন। এভাবে মিথ্যা বর্ণনার মাধ্যমে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করাও এক ধরনের ভদ্রবেশী অপরাধ।
এ ছাড়া মানি লন্ডারিং, ইন্স্যুরেন্স প্রতারণা, শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার থেকে কৌশলে বঞ্চিত করা, উন্নয়ন খাতের অর্থ আত্মসাৎ, রোগীর শরীরে বিনা প্রয়োজনে অস্ত্রোপচার, সরকারি হাসপাতালে সঠিকভাবে রোগী না দেখে প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখার প্রবণতা, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি থেকে পার্সেন্টেজ নেওয়ার জন্য ডাক্তার কর্তৃক রোগীকে নিম্নমানের ওষুধ প্রেস্ক্রাইভ করা অথবা নিজের লাভের জন্য অপ্রয়োজনে মাত্রাতিরিক্ত ওষুধ প্রেস্ক্রাইভ করা। এমনকি প্রকৌশলী কর্তৃক অর্থ আত্মসাৎ-পূর্বক নিম্নমানের সেতু ও রাস্তাঘাট তৈরি, দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা কর্তৃক প্রতিপক্ষ থেকে ঘুষ নিয়ে রিমান্ডে কাউকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা। আবার পুলিশ রিমান্ডে দাগি আসামিকে কোনো কথা বের করতে কোনো ধরনের নির্যাতন করবে না বলে সংশ্লিষ্ট অপরাধীর পক্ষ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ নেওয়া। পাশাপাশি পুলিশ কর্তৃক ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮-এর ৫৪ ধারায় ধৃত নিষ্পাপ ব্যক্তিকে প্রভাবশালী মহলের চাপে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া, আইনজীবী কর্তৃক মক্কেলের সঙ্গে অসদাচরণ ও হয়রানি, মক্কেলের গোপন তথ্য অন্যপক্ষের কাছে সরবরাহ করা ইত্যাদি বিষয়গুলো ভদ্রবেশী অপরাধের অন্তর্ভুক্ত।
আজ ভদ্রবেশী অপরাধীরা রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। কিন্তু রাষ্ট্রের ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধীরা শাস্তির বলয়মুক্ত। অপরাধীদের ক্ষমতার কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনেক সময় আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হিমশিম খেয়ে যায় এবং যাচ্ছে। তা ছাড়া ভদ্রবেশী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে নির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। ফলে অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট অপরাধ যে আইনের অধীন বিচারযোগ্য সে আইনের অধীন বিচারের জন্য মনোনীত হয় এবং শাস্তি পায়। বিশেষ আইন থাকলে যতটা দ্রুত অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনা যেত বিশেষ আইন না থাকায় সেটা সম্ভব হয় না। ভদ্রবেশী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কতগুলো পদক্ষেপ আমলে নেওয়া যেতে পারে। যেমন : সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে বিশেষ করে যে দপ্তরগুলোতে এ অপরাধ নিয়মিত হয় সে দপ্তরগুলোতে আচরণবিধি-সংক্রান্ত কোড প্রণয়ন করা। আর যদি নির্দিষ্ট কোড থাকে তাহলে সেটার সুষ্ঠু প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’- এই প্রবাদটিকে ভুল প্রমাণ করতে হবে। অর্থাৎ আইন শুধু থাকলেই হবে না বরং আইনের সুষ্ঠু ও যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। অন্যদিকে ভদ্রবেশী অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিধান নিশ্চিত করতে হবে। ফলে অপরাধ চিহ্নিত করে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হবে। এ ছাড়া দণ্ডবিধিতে পৃথক একটি অধ্যায় সংযোজন করা যেতে পারে। সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোতে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং ভদ্রবেশী অপরাধীকে দল থেকে বহিষ্কার করা। সেই সঙ্গে আমাদের সচেতন নাগরিক হতে হবে। কারণ আমাদের সম্মেলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভদ্রবেশী অপরাধীদের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব। এরা শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্রের জন্য একটি ভয়ানক ব্যাধি। অনেকটা অনিরাময়যোগ্য ব্যাধির মতো। এ অপরাধের ভয়াবহতা করোনাভাইরাস, মরণঘাতী ক্যানসার কিংবা ভয়ানক এইডস অপেক্ষা কম নয়। সুতরাং সময় এসেছে সোনার বাংলা গড়ার। সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভদ্রবেশী অপরাধীদের চিহ্নিত করে সুন্দর পরিবেশ তৈরির এটাই উপযুক্ত সময়।
লেখক : শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ,ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post