ডা.মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন
দেশের মানুষের চেতনার অনির্বাণ এক বাতিঘর ফেব্রুয়ারি ২১। পৃথিবীর ইতিহাসে ভাষা নিয়ে এমন আন্দোলন আর কোথাও হয়নি। যার হাত ধরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়।
পৃথিবীর সব ভাষাই আল্লাহ তায়ালার বিশেষ দান ও অসাধারণ নেয়ামত। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তাদের শিখিয়েছেন ভাষা- (সুরা আর রাহমান : ৩-৪)। ওই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা মানব সৃষ্টির কথা উল্লেখ করার পাশাপাশি ভাষা শিক্ষার বিষয়টিও উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ভাষা না থাকলে মানুষ বিকল। ভাষা ও মানুষ একে অপরের সম্পূরক। ওই আয়াত এ কথারও ইঙ্গিত বহন করে যে, আল্লাহ তায়ালা অন্য কোনো প্রাণীকে মানুষের মতো ভাষা দান করেননি। এ ক্ষেত্রে মানব অন্য সব প্রাণী থেকে আলাদা। তাই পৃথিবীর বুকে যত ভাষাই চালু আছে সবই আল্লাহ তায়ালার এক অসাধারণ নিয়ামত। যার কোনো বিকল্প নেই।
আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে যত নবী-রাসুল প্রেরণ করেছেন সবাইকে স্বজাতি ও এলাকার ভাষা দিয়েই প্রেরণ করেছেন। এভাবে সব আসমানি কিতাবও যে জাতির জন্য নাজিল করেছেন সে জাতির ভাষাতেই নাজিল করেছেন। কোরআন মাজিদে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আমি সব রাসুলকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষি করেই প্রেরণ করেছি, যেন তারা তাদের আল্লাহর হুকুমণ্ডআহকাম পরিষ্কারভাবে বুঝাতে পারে।’ (সুরা ইবরাহিম : ৪)। ওই আয়াতও মাতৃভাষার যথাযথ গুরুত্বের দানের বার্তা বহন করে। এক কথায় ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক ভাষারই গুরুত্ব সীমাহীন এবং এর সযত্ন ও নিয়মতান্ত্রিক চর্চা আমলে ছালেহ বা নেক আমল বলে গণ্য। সেমতে ইসলামের দৃষ্টিতে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার গুরুত্বও সীমাহীন এবং এর চর্চায় আত্মনিয়োগ করাও পুণ্যের আমল বলে বিবেচিত হবে। তাই একে অবহেলা করা বা গুরুত্বহীন মনে করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই; বরং একে স্থান দিতে হবে কোরআন-হাদিস, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও জান্নাতের ভাষা- এক কথায় দ্বীনি ভাষা আরবির পাশেই।
বাংলা ভাষা শিক্ষা করা সবার কর্তব্য; বরং কিছু দীনদার মানুষের তো এর জন্য নিবেদিত প্রাণ হওয়া অপরিহার্য। ইতিহাসের সে অধ্যায় রচিত হয়েছিল এ পূর্ব বাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) কিছু অকুতোভয় যুবক সালাম, রফিক, জব্বার ও বরকতের মতো আরো অনেক যুবকের তাজা রক্তের বিনিময়ে। মাতৃভাষা বাংলাভাষা, যে ভাষার সঙ্গে এ দেশের মানুষের নাড়ির সম্পর্ক। সে ভাষায় কথা বলা তথা মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষায় তারা নিজেদের মহামূল্যবান জীবন নির্দ্বিধায় বিসর্জন দিয়েছিলেন। তাদের এ আত্মদানকে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন যে, তারা শহীদ কি-না?
উল্লেখ্য, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের একক সার্বভৌমত্ব, শেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রিসালাত ও শেষ বিচারের দিনসহ পরকালীন অন্যান্য বিষয়ের প্রতি অকুণ্ঠচিত্তে নিজের আন্তরিক বিশ্বাসের মৌখিক ঘোষণাদান এবং রিসালাতের মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর কাছে প্রেরিত আল্লাহ প্রদত্ত মানবজীবনের বিধান সমাজ জীবনের সর্বস্তরে বাস্তবায়নের সংগ্রামে ইসলামবিরোধী শক্তির হাতে মৃত্যুবরণ করাকেই শহীদ বলে।
মাতৃভাষা ব্যবহার করার অধিকার মানুষের সৃষ্টিগত তথা জন্মগত অধিকার। কারণ মহান আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাকে তার ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দয়াময় আল্লাহ। তিনিই শিক্ষা দিয়াছেন কোরআন। তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ। তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।’ আলোচ্য আয়াতের মাধ্যমে জানা যায়, মানুষ সৃষ্টির সঙ্গে ভাষার অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে। তাই মাতৃভাষা মানুষের একটি সৃষ্টিগত অধিকার। কেউ যদি এ অধিকার ছিনিয়ে নিতে চায় তার প্রতিরোধ করা অপরিহার্য। আর এ প্রতিরোধে কেউ নিহত হলে ইসলামের দৃষ্টিতে সে শহীদের মর্যাদা পাবে। তবে শর্ত হলো, তাদের প্রকৃতভাবে এমন মুসলিম হতে হবে যে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিহত হয়।
আমরা বাংলাদেশের অধিবাসী, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। আমরা আজ মাতৃভাষায় কথা বলি। এর পেছনে এসব শহীদের অবদানই সর্বাগ্রে। কাজেই এ ভাষাশহীদদের প্রতি আমাদেরও কিছু করণীয় রয়েছে। তাই মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় যেসব অকুতোভয় মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিল তারা যদি ইসলামী শাহাদাতের শর্তগুলো পূরণ করে থাকেন, কোরআন-হাদিসের আলোকে তাদের আমরা ইনশাআল্লাহ জান্নাতবাসীই বলব। তাদের নাজাতের ব্যাপারে আল্লাহই সর্বজ্ঞাত। অন্যথায় তাদের ভিতর যদি সে রকম শর্তাবলী অনুপস্থিত থেকেও থাকে, তবুও তারা যেহেতু আমাদের অধিকার আদায়ের জন্যেই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, মুসলিম হিসেবে তাদের জন্য আমাদের কর্তব্য হলো আল্লাহর কাছে মাগফিরাত তথা ক্ষমা ভিক্ষা চাওয়া। কেননা, এটি একটি সদকায়ে জারিয়ার মতো। আর এ সম্পর্কে হাদিসের একটি বর্ণনায় পাওয়া যায় যে, যদি কেউ কোনো সদকায়ে জারিয়ার মতো সৎকর্ম সম্পাদন করে, তাহলে যত প্রাণী তা থেকে উপকৃত হবে, সে ওইসব মানুষের নেকির একটি অংশ পেয়ে যাবে। অবশ্য কোনো কোনো ধর্ম ও সমাজে গান-বাজনার মাধ্যমে তাদের দেব-দেবীদের স্মরণ করে থাকে এবং এর মাধ্যমে তারা তাদের খুশি করার চেষ্টা করে। সেটা তাদের ধর্মীয় ব্যাপার। আমরা মুসলিম, আমাদের ধারণা মতে শহীদরা আখেরাতে অবস্থান করছেন। তাই আমাদের উচিত যেসব কাজ-কর্ম তাদের উপকারে আসে সেসব কাজই বেশি বেশি করা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
Discussion about this post