মুসা আহমেদ
বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি ও ভৌগোলিক অবস্থানের ভিন্নতার কারণে তুরস্ক বরাবরই আলোচিত। দেশটি দ্রুত উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে। এর মূলে রয়েছে তাদের আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা। বর্তমানে তুরস্কে মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে শিক্ষাব্যবস্থা বেশ উন্নত, যা ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সেরা দশে। এছাড়া তুরস্কের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়েও প্রথম সারিতে।
প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজারো শিক্ষার্থী শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে তুরস্কে যাচ্ছেন। প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় তুরস্কে বৃত্তির আবেদনের হার বাড়ছে প্রতি বছরই। বর্তমানে তুরস্কের ৫৫টি শহরে শতাধিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন শিক্ষর্থীরা। এর মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, পিএইচডি করছেন বাংলাদেশের পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী।
জানতে চাইলে তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মসয়ূদ মান্নান জাগো নিউজকে বলেন, তুরস্কে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা খুবই উন্নত। এখানকার পড়াশোনার মান এবং পরিবেশ একজন শিক্ষার্থীকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের তুরস্কে উচ্চশিক্ষার অপার সম্ভাবনা রয়েছে।
তিনি বলেন, আগে প্রতি বছর বাংলাদেশের মাত্র ৪০ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হতো, যা আমাদের চাহিদার তুলনায় খুবই কম ছিল। এখন বৃত্তির সংখ্যা ১০০ করেছে তুরস্ক সরকার।
গত বছরের ১২ ডিসেম্বর তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসুগ্লু তার বাসভবনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম ও তুরস্কে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে আমন্ত্রণ জানান। সেখানে এক বৈঠকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তির সংখ্যা ১০০ করার অনুরোধ করেন এ কে আব্দুল মোমেন। তখন বৃত্তি বাড়ানোর আশ্বাস দেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। গত জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হয়েছে।
ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, তুরস্কে শিক্ষাবৃত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও টিউশন ফি, এক বছরের ভাষা (তার্কি) কোর্স, আবাসন ও খাবার, স্বাস্থ্যবিমা, মাসিক সম্মানী ভাতা (স্নাতক ৮০০ লিরা, স্নাতকোত্তর এক হাজার ১০০ লিরা ও পিএইচডিতে ১ হাজার ৬০০ লিরা) দেওয়া হয়। এখন ১ লিরা সমান ৬ টাকার বেশি। এই শিক্ষাবৃত্তিতে প্রথমবার যাওয়া ও পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফেরার বিমান টিকিট অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর বাইরে পার্টটাইম ও পড়াশোনা শেষে ফুলটাম চাকরি এবং নাগরিকত্বের সুযোগও রয়েছে।
আঙ্কারায় তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন, ফাইল ছবি
তুরস্কে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা জানান, তুরস্কের বৃত্তির জন্য আবেদনের পুরো প্রক্রিয়াই হয় বিনামূল্যে। তবে বৃত্তিতে আবেদন করতে হলে স্নাতকের জন্য এসএসসি বা সমমান ও এইচএসসি বা সমমানের পরীক্ষায় ৭০ শতাংশ এবং স্নাতকোত্তর-পিএইচডির জন্য স্নাতক-স্নাতকোত্তরে ৭৫ শতাংশ নম্বর থাকতে হয়। তবে মেডিকেলে ভর্তি হতে চাইলে ৯০ শতাংশ নম্বর লাগবে। তুরস্কে পড়াশোনার ভাষা তুর্কি হলেও কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজিতে পড়ার সুযোগ দেয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী টোফেল বা জিআরই স্কোর থাকতে হয়। তুরস্কে আইইএলটিএস স্কোর গ্রহণযোগ্য নয়।
বয়সসীমা
তুরস্কে স্নাতক, স্নাতকোত্তর, পিএইচডি এবং রিসার্চ প্রোগ্রামে ভর্তির জন্য নির্দিষ্ট বয়সসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে দেশটির সরকার। এখন স্নাতকের জন্য আবেদন করতে একজন শিক্ষার্থীর বয়স হতে হবে ২১ বছরের নিচে। স্নাতকোত্তরে আবেদনের বয়স ৩০ বছরের নিচে। পিএইচডিতে ৩৫ বছরের নিচে। এছাড়া রিসার্চ প্রোগ্রামের জন্য আবেদন করতে বয়স হতে হবে ৪৫ বছরের নিচে।
আবেদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
বৃত্তির জন্য সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডের এককপি পাসপোর্ট সাইজের ছবি, পাসপোর্ট অথবা জাতীয় পরিচয়পত্র অথবা জন্মসনদের স্ক্যান কপি (ইংরেজি কপি হতে হবে), এসএসসি বা দাখিল এবং এইচএসসি বা আলিমের মূল সার্টিফিকেট ও মার্কশিটের স্ক্যানকপি। এছাড়া সব পরীক্ষার সার্টিফিকেট, মার্কশিট, টোফেল ও জিআরইর সার্টিফিকেট (যদি থাকে), দুটি রেফারেন্স লেটার (বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের হলে ভালো হয়), যত ধরনের এক্সট্রা কারিকুলার সার্টিফিকেট আছে (রচনা প্রতিযোগিতা, স্কাউট, বিএনসিসি, জিপিএ-৫ সংবর্ধনা, কোনো এনজিও বা অন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ করা ইত্যাদি)।
মাদরাসা শিক্ষার সুযোগ
তুরস্কের মাদরাসাগুলোতে নবম শ্রেণি থেকে বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে। এক্ষেত্রে জেডিসিতে ভালো রেজাল্ট থাকতে হবে। থাকা-খাওয়া ফ্রি এবং হাতখরচের জন্য তিন থেকে চার হাজার টাকা দেওয়া হয়। মাদরাসায় চার বছরের কোর্স (নবম-দ্বাদশ শ্রেণি) শেষ করে ভালো রেজাল্ট করতে পারলে তুরস্কে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ধারাবাহিকভাবে অনার্স, মাস্টার্স ও পিএইচডি বৃত্তির সুযোগ থাকে।
আবেদনের ঠিকানা
তুরস্কের শিক্ষাবৃত্তির জন্য আবেদন অনলাইনে করতে হয়। পুরো প্রক্রিয়াই হয় বিনামূল্যে। আগ্রহীরা আবেদন করতে পারবেন turkiyeburslari.gov.tr ওয়েবসাইট থেকে। প্রতি বছর ১০ জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রুয়ারিরপর্যন্ত শিক্ষাবৃত্তির আবেদন নেওয়া হয়।
তবে বৃত্তির আবেদন করার সময় বিশ্ববিদ্যালয় এবং সাবজেক্ট বাছাই করতে হয়। এক্ষেত্রে যাদের রেজাল্ট ভালো এবং ওপরে উল্লেখিত সব যোগ্যতা রয়েছে, তারা তুরস্কের ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পছন্দ করতে পারেন। যারা যোগ্যতার দিক থেকে একটু দুর্বল, তারা অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় বাছাই করে দিলে বৃত্তি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি।
নতুন আবেদনকারীরা বিস্তারিত জানতে পারবেন তুরস্কে পড়াশোনা করা বাংলাদেশিদের কাছ থেকে। তুরস্কে অধ্যায়নরত বা অধ্যায়ন শেষে বসবাসরতদের একাধিক ফেসবুক গ্রুপও রয়েছে।
শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে তুরস্কের সেলজুক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে স্নাতকোত্তর করছেন বাংলাদেশের লাবিব ফয়সাল। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, তুরস্কে জুন, জুলাই ও আগস্ট- এ তিন মাস গ্রীষ্মের বন্ধ থাকে। প্রতি বছর একাডেমিক সেশন শুরু হয় সেপ্টেম্বরে। অর্থাৎ প্রতি বছর তিন মাস ছুটি পাওয়া যায়। এই ছুটিতে ফুলটাইম কাজ করার সুযোগ রয়েছে। পড়াশোনা চলাকালে কেউ যদি চাকরি করতে চান, সে ক্ষেত্রে স্কলারশিপ কমিটির লিখিত কিছু নিয়ম মেনে কাঙ্ক্ষিত চাকরি করতে পারবেন।
লাবিব ফয়সাল বলেন, পড়াশোনা শেষে যদি কেউ চাকরি নিয়ে ভাবেন সেক্ষেত্রে যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবেন সেই প্রতিষ্ঠান থেকে সরকারিভাবে প্রয়োজনীয় ‘কাজের অনুমতিপত্র’ নিয়ে বৈধভাবে চাকরি করতে পারবেন। কাজের অনুমতিপত্রসহ পাঁচ বছর চাকরি করার পর তুরস্কের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে পারবেন। চাকরি ছাড়াও নির্ধারিত পরিমাণ টাকার বিনিয়োগ অথবা বাসস্থানের মালিকানার মাধ্যমেও নাগরিকত্বের সুযোগ রয়েছে।
তুরস্কের প্রথম সারির কিছু বিশ্ববিদ্যালয়
তুরস্কের সব বিশ্ববিদ্যালয়ই মানসম্মত। তবে কয়েকটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে রয়েছে আঙ্কারা ইউনিভার্সিটি, মিডল ইস্ট টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি, গাজি ইউনিভার্সিটি, হাজিতেপে ইউনিভার্সিটি, ইস্তাম্বুলের বোয়াজিসি ইউনিভার্সিটি, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি, মারমারা ইউনিভার্সিটি, ইস্তাম্বুল ইউনিভার্সিটি, এস্কিশেহের আনাদোলু ইউনিভার্সিটি, ইজমির এগে ইউনিভার্সিটি ও ডোকুজ এইলুল ইউনিভার্সিটি।সৌজন্যে-জাগো নিউজ
Discussion about this post