তুষার আবদুল্লাহ
একহাত দূর থেকে প্রথম রাষ্ট্রপতি দেখেছিলাম ২০০১ সালের ২৩ জানুয়ারি। সেদিন জনশুমারির আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রের প্রথম নাগরিককে গণনা করার মধ্য দিয়ে। মধ্যরাত থেকে ভাসমান মানুষ গণনার প্রতিবেদন করা শেষে সকাল নয়টায় গিয়ে হাজির হয়েছিলাম, বঙ্গভবনে। প্রথম নাগরিককে গণনা ভুক্ত করতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর কর্মকর্তারা হাজির।
বাংলাদেশ টেলিভিশন, ডিএফপি এবং একুশে টেলিভিশন যাওয়ার সুযোগ পাবে রেড জোনে। সেখানে প্রথম নাগরিকের দেখা পাবো। যিনি প্রথম নাগরিক, তাকে তো এক দশকের বেশি সময় ধরে দূর থেকে দেখে আসছি। বলা যায়, পুরোটাই পত্রিকা এবং টেলিভিশনে।
স্বৈরাচারের পতন, তিন জোটের রূপ রেখা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়া, স্বপদে ফিরে যাওয়া এবং পুনরায় দায়িত্ব নেওয়ার প্রক্রিয়াগুলো দেখে, এতটুকু বুঝেছিলাম, তিনি সকলের চেয়ে ভিন্ন। আলোর বাইরে থাকতে পছন্দ করেন এবং অবশ্যই ব্যক্তিত্ব, সততা, নির্মোহ ও সংযমী মানুষ হিসেবে, তিনি বিরল।
তাই তার সামনে গিয়ে দাঁড়ানো খুব সহজ মনে হচ্ছিল না। কেমন যেন প্রধান শিক্ষকের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো বুক ঢিপ ঢিপ করছিল। কিন্তু তিনি যখন এলেন, কত সহজ ভাবে কথা বললেন। কত সরল অভিব্যক্তি। মনে হচ্ছিল দাদা ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আমি। ভালোবাসাময় চাহনিটা তেমনই ছিল ।
স্বৈরাচারের পতন, তিন জোটের রূপ রেখা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়া, স্বপদে ফিরে যাওয়া এবং পুনরায় দায়িত্ব নেওয়ার প্রক্রিয়াগুলো দেখে, এতটুকু বুঝেছিলাম, তিনি সকলের চেয়ে ভিন্ন।
তারপর আর রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি। তিনি ১৯৯১ সালে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, সেটা নিজে থেকে হতে চাননি, এটি সবার জানা। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনুরোধেই তিনি শর্ত সাপেক্ষে দায়িত্ব নিয়েছিলেন।
শর্ত ছিল, পূর্বপদে ফিরে যাওয়ার। তিনি ফিরে গিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে। পরে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখনো দলের সভানেত্রীর অনুরোধে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন।
এর আগে ১৯৯১ সালে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থেকে সংসদীয় সরকারে ফেরত যাওয়ার জন্য তিনি গণভোটের আয়োজন করেছিলেন। জনগণ তাকে চায় কি চায় না, অর্থাৎ ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য সেই গণভোট ছিল না।
অনেককে দেখছি উনার মৃত্যুর পর ঐ গণভোটকে জিয়াউর রহমানের গণভোটের সঙ্গে মিলিয়ে ফেলছেন। এটি করা হলে রাজনৈতিক ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হবে। একই সঙ্গে নির্মোহ কোনো মানুষের প্রতি যে আমাদের শ্রদ্ধা জানানোর কোনো সক্ষমতা নেই, তারও প্রমাণ দেওয়া হবে।
২০০১ এর নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ হয়তো মনে কষ্ট পেয়েছিল। মনে হচ্ছিল বরফ জমেছিল সম্পর্কে। কিন্তু প্রয়াণের পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা, শোক এসেছে প্রত্যাশিত ভাবেই।
বঙ্গভবনে বা কাজের সূত্রে যারা তার কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, তারা এখনো নমিত তার ব্যক্তিত্বের কাছে। দায়িত্ব থেকে চলে যাওয়ার পরও দৃশ্যের বাইরে ছিলেন তিনি।
তাকে নিয়ে রাজনীতির কাদা মাঠে কাবাডি খেলা যাবে হয়তো অনেক। কারণ আকারে ছোট মানুষটির যে দৃঢ়তার প্রাচীর ছিল, আপোষহীনতার বর্ম ছিল, তা ভেদ করতে পারেনি কোনো রাজনীতি।
প্রথম নাগরিক বা ক্ষমতার শীর্ষে যারা আহরণ করেন, তাদের সন্তান ও পরিবারের পরিচিতি আমাদের খুঁজে বের করতে হয় না। বহুদূরবর্তী পরিচিতের হুংকারেই কেঁপে উঠি আমরা। অথচ তিনি চলে যাওয়ার পরও এদেশের জনগণ, তার সন্তান ও পরিবার সম্পর্কে কতটুকু জানেন?
প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনে নিজেকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখা, পরিজনেরা যেন তার পদের প্রভাবে কোনো সুবিধাভোগী না হোন, এজন্য নিজেকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করতে পারার যে, মানব গুণ, সেটি আমরা বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ ছাড়া কয়জনের মধ্যে দেখেছি।
বঙ্গভবনে বা কাজের সূত্রে যারা তার কাছে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন, তারা এখনো নমিত তার ব্যক্তিত্বের কাছে। দায়িত্ব থেকে চলে যাওয়ার পরও দৃশ্যের বাইরে ছিলেন তিনি। ক্ষমতার দিনগুলো নিয়ে কোনো মন্তব্য নেই।
এমন সংযমের পরিচয় দিতে পেরেছেন, পারেন যিনি, তাকে বাহ্যিকভাবে সাধারণ আকারের মনে হতে পারে, কিন্তু তার আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক দৃঢ় পর্বত। তাকে প্রণতি জানাই।
লেখক- তুষার আবদুল্লাহ । গণমাধ্যমকর্মী
Discussion about this post