আবদুল কাইউম
আওয়ামী লীগ সরকারের চলতি মেয়াদে প্রথম মেগা প্রকল্প হিসেবে চালু হচ্ছে পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র। আজ সোমবার (২১ মার্চ) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় উপস্থিত হয়ে এর উদ্বোধনের কথা রয়েছে। এদিন এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের পাশাপাশি দেশের শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণাও দেবেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে দেশে সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে শতভাগ দূষণমুক্ত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হবে।
পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী (পূর্ত) মো. রেজওয়ান ইকবাল খান জানান, ২০২০ সালের ৮ ডিসেম্বর এখান থেকে উৎপাদিত ৬২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে দক্ষিণবঙ্গের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। এর আগে গোপালগঞ্জ থেকে পায়রা বন্দর পর্যন্ত ১৬০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করা হয়। কিন্তু গোপালগঞ্জের গ্রিড থেকে ঢাকার আমিন বাজার পর্যন্ত সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ এখনও চলছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ওই লাইন নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার কথা।
তিনি আরও জানান, পদ্মায় রিভার ক্লোসিং লাইন নির্মাণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। সেটি কমপ্লিট হলে খুব দ্রুত সময়ে নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে। আগামী ডিসেম্বরে ওই কাজ সম্পন্ন হলেই জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
এদিকে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সহকারী প্রকৌশলী সাইম রহমান জানান, প্ল্যান্টে প্রতিদিন বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ২৯ কোটি ছয় লাখ লিটার পানি প্রয়োজন হয়। যার ৯৫ ভাগ দ্বিতীয়বার শোধন করে কেন্দ্রে ব্যবহার করা হয়।
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার খোরসেদুল আলম বলেন, কয়লাভিত্তিক এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতিদিন ১৩ হাজার টন কয়লা লাগবে। যা ইন্দোনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে সরাসরি বন্দরের নিজস্ব টার্মিনালে ভিড়ছে। কয়লা ব্যবহারে পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। আছে শ্রমিকদের জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা।
তিনি আরও জানান, কয়লাবাহী জাহাজ সরাসরি টার্মিনালে ভিড়ানোর পর সরাসরি সর্বাধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কনভেয়ারের মাধ্যমে কয়লা কারখানায় পৌঁছে যাচ্ছে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরও বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১৩তম আলট্রা সুপারক্রিটিক্যাল প্রযুক্তি ব্যবহারকারী দেশ। জ্বালানি সাশ্রয়ী পরিবেশবান্ধব ক্লিন কোল প্রযুক্তির বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দক্ষতা ৪৪ দশমিক ২৯ শতাংশ। সালফার নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে ফ্লু গ্যাস ডিসালফারাইজেশন (এফজিডি) স্থাপন করা হয়েছে। ফ্লাইঅ্যাশ কমাতে ৯৯ শতাংশ দক্ষতাসম্পন্ন ইলেক্ট্রো স্ট্যাটিক প্রেসিপিটেটর (ইএসপি) বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে।
তবে কয়লা পরিবহনে নদীর নাব্য সংকট ভোগাচ্ছে বলে জানান প্রকল্প পরিচালক (প্রধান প্রকৌশলী) শাহ্ আব্দুল মওলা হেলাল। তিনি বলেন, ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এখন আমাদের প্রতিদিন সাড়ে ছয় হাজার টন কয়লা দরকার হচ্ছে। তবে রাবনাবাদ চ্যানেলে নাব্য সংকটের কারণে মাদারভেসেল সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারছে না। এতে অনেকটা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, ২০২০ সালে নিজস্ব ওয়েতে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করায় মাত্র সাতটি মাদারভেসেল সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পেরেছিল। যেগুলোর ধারণ ক্ষমতা ছিল ৪৫ থেকে ৫০ হাজার টন। এরপর ড্রেজিং না হওয়ায় ছোট ছোট ভেসেলে করে ২০ থেকে ২৫ হাজার টন কয়লা বহন করানো হচ্ছে। তবে বর্তমানে পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষ রাবনাবাদ চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিং করায় পুনরায় মাদারভেসেলে কয়লা আনা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে বাংলাদেশের নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার কোম্পানি ও চায়না ন্যাশনাল মেশিনারি ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট করপোরেশনের (সিএমসি) মধ্যে যৌথ চুক্তি হয়। পরে ২০১৬ সালের ২৯ মার্চ বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে ঠিকাদার নিয়োগের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। পরে ১২ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের প্রায় ৮০ শতাংশ ঋণ দেয় চীনের এক্সিম ব্যাংক ও চায়না ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। মূল কাজের পুরো তদারকিও করেছেন চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
করোনাকাল পেরিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সমাবেশ
এদিকে করোনা মহামারির কারণে প্রায় দুই বছর পর ঢাকার বাইরে কোনও সমাবেশে অংশ নেননি প্রধানমন্ত্রী। সোমবার প্রথমবারের মতো তিনি তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র উদ্বোধনের পর সুধী সমাবেশে অংশ নেবেন। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি সাজানো হয়েছে নতুন সাজে। শেষ হয়েছে প্যান্ডেল সাজানোর কাজ। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হয়েছে কলাপাড়া উপজেলার ধানখালী ইউনিয়ন।
সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্নের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন প্রকল্প পরিচালক (প্রধান প্রকৌশলী) শাহ্ আব্দুল মওলা হেলাল। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের পরপরই এখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে সরবরাহ শুরু হবে। এর ফলে, সুপার ক্রিটিক্যাল প্রযুক্তিতে শতভাগ দূষণমুক্ত কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের সূচনা করবে বাংলাদেশ। পাশাপাশি ওইদিন দেশে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে বরণ করতে আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এই সফরে মন্ত্রী পরিষদের সদস্য, সংসদ সদস্য, ৩০ জনের অধিক বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
Discussion about this post