শিক্ষার আলো ডেস্ক
দেশের ২৫ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়মের তদন্তে নেমেছে সরকার। আর্থিক দুর্নীতি, তহবিল তছরুপ, উপাচার্য ও ট্রেজারার নিয়োগ না করা, মালিকানা ও ট্রাস্টি বোর্ড নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন যথাযথভাবে না মানার অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এই তদন্তকাজ পরিচালনা করছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
আগামী এক মাসের মধ্যে এই তদন্তকাজ শেষ করে ইউজিসি প্রতিবেদনগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে। তদন্তের আলোকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিরুদ্ধে নেওয়া হবে আইনি ব্যবস্থা।
যে ২৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, সেগুলো হলো নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রাম (ইউএসটিসি), এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, আশা ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, সিলেটের নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক্সিম ব্যাংক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ, সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি, কুমিল্লার ব্রিটানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ফরিদপুরের টাইমস ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, মানিকগঞ্জের এপিআই ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, খুলনার নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি, সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ইবাইস ইউনিভার্সিটি, দি ইউনিভার্সিটি অব কুমিল্লা এবং আমেরিকান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি (আমবান)।
ইউজিসির সূত্র জানায়, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে বেশকিছু গুরুতর অভিযোগ উঠেছে। আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মোটা অঙ্কের সিটিং অ্যালাউন্স গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় বিলাসবহুল গাড়ি কিনে তা ব্যবহার ও পরে এ নিয়ে সমালোচনার মুখে তা ফেরত দেওয়া, বিদেশে ট্রাস্টি বোর্ডের সভার নামে প্রমোদ ভ্রমণ, ছাত্র ভর্তিতে ট্রাস্টি বোর্ড সদস্যদের কোটা রাখার অভিযোগও রয়েছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে ইউজিসি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে।
জানা যায়, চট্টগ্রাম ইউএসটিসির মালিকানা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামের তিন সন্তানের মধ্যে বিরোধ চরমে। এই বিরোধ মেটাতে এর আগে চট্টগ্রামের একটি পক্ষ এবং ইউজিসি ব্যর্থ হয়েছে। বিপুলসংখ্যক বিদেশি শিক্ষার্থী এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় পড়াশোনা করতে আসতেন। এই সংখ্যা এখন কমেছে। ইউজিসির কর্মকর্তারা বলছেন, ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব জমি নেই। রেলওয়ের ৬ দশমিক ২৫ একর জমির ওপর বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত, যা রেলওয়ে থেকে লিজ নেওয়া। অথচ নিজস্ব জমি থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের অন্যতম শর্ত। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ট্রেজারার নেই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়মের তদন্ত করতে চার সদস্যের কমিটি গঠন করেছে ইউজিসি।
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের মধ্যে রয়েছে সেখানে চ্যান্সেলর নিযুক্ত কোনো উপাচার্য ও ট্রেজারার নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে চলা বিভিন্ন কোর্স, কারিকুলাম ও প্রোগ্রাম কর্তৃপক্ষ আপডেট করে না দীর্ঘকাল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলা অনিয়মগুলো খতিয়ে দেখতে ইউজিসি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মাঝে টানা ১২ বছর চ্যান্সেলর নিযুক্ত কোনো উপাচার্য ছাড়াই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অভিযোগ ছিল। এই এক যুগে বিশ্ববিদ্যালয়টি হাজার হাজার সনদ ইস্যু করেছে। সনদে বিশ্ববিদ্যালয়টির মালিক আবুল হাসান মুহম্মদ সাদেক উপাচার্য হিসেবে সই করেছেন। আইন অনুসারে তার সই করার সুযোগ নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুসরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টির সিনেট, সিন্ডিকেট গঠন করা হয়নি বলেও অভিযোগ উঠেছে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে চলা অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ইউজিসি তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
প্রাইম এশিয়া ইউনিভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের আগের চেয়ারম্যান আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা পাচারের অভিযোগ গেছে ইউজিসির কাছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়েকজন ট্রাস্টির বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ইউজিসির কর্মকর্তারা জানান, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়জন শিক্ষকের পিএইচডির সনদ জাল। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক মেসবাহ কামাল এই শিক্ষকদের জাল সনদ চিহ্নিত করেন এবং তাদের চাকরিচ্যুত করেন। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উল্টো অধ্যাপক মেসবাহ কামালকেই চাকরি ছাড়তে বাধ্য করে এবং ওই ছয় শিক্ষককে চাকরিতে পুনর্বহাল করে।
ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ অনুমোদিত আসনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করেছে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেখানে নেই প্রয়োজনীয় ল্যাব ফ্যাসিলিটি। অথচ প্রকৌশল বিষয়ে পড়ানো হচ্ছে। একাধিক প্রোগ্রাম হালনাগাদ করা নেই। নেভাল আর্কিটেকচার বিষয়ে পড়ানো হলেও সেখানে নেই এ বিষয়ের শিক্ষক।
মানিকগঞ্জের এনপিআই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়েও বেশকিছু অভিযোগের তদন্ত শুরু করতে যাচ্ছে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়টির মালিকানা নিয়ে দুই পক্ষের দ্বন্দ্ব, জ্যেষ্ঠ শিক্ষক না থাকায় বেশিরভাগ বিষয়ে প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক দিয়ে পড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, ফরিদপুরের টাইমস ও চুয়াডাঙ্গার ফার্স্ট ক্যাপিটাল ইউনিভার্সিটি চলছে খুঁড়িয়ে। নির্ধারিত ২৫ হাজার ফুট জায়গা নেই। অনেক বিষয়ে শিক্ষকই নেই। সবাই প্রভাষক, নেই কোনো অধ্যাপক। এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সিদ্ধান্ত দিয়ে শিগগিরই কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিতে যাচ্ছে ইউজিসি।
২৫ বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে ইউজিসির তদন্ত প্রশ্নে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘হয়তো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আইন মেনে চলছে না, তাই ইউজিসি তদন্ত করছে।’ তিনি বলেন, ‘অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ভালো করছে, কেউ কেউ ভালো করতে পারছে না। আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্যোক্তা আছি, তাদের খুঁজে দেখতে হবে, কেন ভালো করা যাচ্ছে না।’
এ ব্যাপারে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নানা অভিযোগ জমা পড়ে। গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগগুলোর বিষয়ে ইউজিসিকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমরা চাই সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন মেনে চলুক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
Discussion about this post