রক্তিম দাশ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর কলকাতা আর মুম্বাইয়ের আধুনিক বাংলা গানের শিল্পীরাও ঝাঁপিয়ে পড়লেন পাক হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার আন্দোলনে। সেই সময় পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক বাংলা গানের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শ্যামল গুপ্ত, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মীরাদেব বর্মণ, সুবীর হাজরা, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়, গোবিন্দ হালদার, মুকুল দত্ত, অমিতাভ নাহা, বিশ্বনাথ দাস, পবিত্র মিত্র প্রমুখ গান লিখেছিলেন। আর এই কালজয়ী গানগুলো সুর দেন শচীন দেববর্মণ, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রাহুল দেববর্মণ, অপরেশ লাহিড়ী, বাপ্পি লাহিড়ী, নীতা সেন, দীনেন্দ্র চৌধুরী, অভিজিৎ, দেবব্রত বিশ্বাস ও সলিল চৌধুরীরা।
৭১ এপ্রিল মাসে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লিখলেন বাঙালির সেই কালজয়ী গান ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রণি।’ আর সেই গানটি সুর করে স্বকণ্ঠে গেয়ে অংশুমান রায় হয়ে উঠলেন কিংবদন্তি। এর আগ পর্যন্ত তিনি কলকাতা তথা বাংলার মানুষের কাছে আধুনিক ঝুমুর গানের পথিকৃৎ হিসাবে পরিচিত ছিলেন। লোকসংগীতের ঘরনার বাইরে বেরিয়ে এসে তার এই একটি গান সেদিন মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া বাংলার দামাল ছেলেদের করেছিল উদ্বুদ্ধ। আকাশবাণী আর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রতিদিনই সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হতো এই গানটি। যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারা আর ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীদের কাছে গানটি ছিল বিপ্লবের এক নয়া নির্দেশিকা। এই কালজয়ী গানটির সৃষ্টিকর্তারা আজ সবাই প্রয়াত। কিন্তু গানটির আবেদন আজও বাংলাদেশের আপামর মানুষকে উদ্দীপিত করে। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনরত তরুণ প্রজন্ম কণ্ঠে এই গানটি ধারণ করে তা প্রমাণ করে দিয়েছেন আরও একবার।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার দক্ষিণ কলকাতার রামগড় কলোনিতে থাকতেন আর তার পাশের পাড়ায় নাকতলা লেনে থাকতেন অংশুমান রায়। আর একটু দূরে গড়িয়ায় থাকতেন লোকসংগীত গবেষক দীনেন্দ্র চৌধুরী। প্রতিদিনই এই তিন বন্ধু মিলিত হয়ে আড্ডা মারতেন রামগড়ের মুরারি মাস্টার(ব্যানার্জি) এর চায়ের দোকানে যার নাম ছিল ‘পাঁচির চায়ের দোকান’। ওই অঞ্চলের বামপন্থী মানুষজন ওখানে আসতেন বলে অনেক বলতেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিট ( সিপিএমের কলকাতার রাজ্য দফতর)। আর মাঝে মাঝেই আসতেন আড্ডা দিতে উপেন তরফদার, নচিকেতা ঘোষ, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়রা। এই চায়ের দোকানে বসেই লেখা হয়েছিল অংশুমান রায়ের ঝুমুরের সুরে ‘দাদা পায়ে পড়ি রে’, ‘ভাঁদোরও আশ্বিন মাসে’-র মতো বিখ্যাত লোকসংগীতগুলো।
আজও এত বছর পরে সেই চায়ের দোকানটি আছে। তবে মালিকানার হাত বদল হয়েছে। এখনও একইভাবে চায়ের দোকানটিতে সকাল সন্ধ্যায় চা হাতে নিয়ে চলে দেদার আড্ডা। এই চায়ের দোকানেই দেখা মিলল প্রবীণ পরিমল চ্যাটার্জির সাথে। উত্তাল সত্তরের সেই দিনগুলির একজন জীবিত সাক্ষী। তার কাছেই শোনা গেল কালজয়ী এই গানটি তৈরির ইতিহাস। তিনি বললেন, ‘আজও আমার স্পষ্ট মনে আছে তখন বাংলাদেশের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমাদের অঞ্চলে শরণার্থীদের ঢল নেমেছে। আমরা যে যা পারছি সাধ্যমত সাহায্য করছি শরণার্থীদের। ৭১ সালের এপ্রিল মাসের ৪ তারিখ সকাল সাড়ে ৭টা নাগাদ গৌরীদা আমি, তপন গোস্বামী, দেবব্রত লাহিড়ীর সাথে বসে চা খাচ্ছিলেন এই চায়ের দোকানে বসে। এই সময় অংশুমানদা এলেন বাজারের ব্যাগ হাতে। দোকানের মালিক মুরারী মাস্টারকে আমরা সবাই দাদু বলতাম। দাদু হঠাৎই গৌরীদাকে বললেন, অংশুমানকে একটা ঠেলা দাও দেখি। গৌরীদা বললেন, আজ ঠেলা দেবো।’
‘মুরারী মাস্টারের ছেলে পোদো চা বানাচ্ছিল। গৌরাদা বললেন, পোদো একটা কাগজ আর কলম দে। পোদো কলম দিলো, কিন্তু কাগজ খুঁজে পাচ্ছিল না। শেষে মাটি থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট কুড়িয়ে নিয়ে, সেটাই ছিঁড়ে লম্বা করে গৌরীদাকে দিল। গৌরীদা আর দু’কাপ চা নিয়ে খেতে খেতে কী যেন লিখল। তারপর অংশুমানদাকে ছেঁড়া সিগারেটের প্যাকেটটা দিয়ে বললো, নে এটা সুর দিয়ে গান কর। একঝলক দেখে ছিলাম। দেখলাম লেখা আছে, শোন একটি মুজিবরের থেকে…। তখন জানি না নিজের অজান্তে কোন ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলাম। এরপর সেদিনই রাত ১০টায় আকাশবাণীর সংবাদ বিচিত্রা শুনলাম বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সাথে সেই গান।’
ওই দিনই আকাশবাণী থেকে প্রথম গানটি প্রচার হয় ‘সংবাদ বিচিত্রা’ নামে একটি অনুষ্ঠানে। যা সেই সময় ছিল আকাশবাণীর অত্যন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। উপেন তরফদার ছিলেন যিনি অনুষ্ঠান প্রযোজক, তিনি হারমোনিয়াম সহযোগে গাওয়া অংশুমানের কণ্ঠে গানটি তার মিনি টেপ রেকর্ডারে ধারণ করে তা প্রচার করেছিলেন। অংশুমান রায়ের গানের ডায়েরি পাতায় লেখা আছে গানটি আকাশবাণীতে প্রথম প্রচার হয়েছিল ৪ এপ্রিল ১৯৭১।
সেদিনের গানটি আকাশবাণীর শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ঘটনা বলতে গিয়ে উপেন তরফদার বলেন, ‘আমার কাছে খবর এলো, দেবদুলালের (মুক্তিযুদ্ধের সময় কালজয়ী শব্দ সেনা) বাড়িতে বাংলাদেশ থেকে চিত্রকর কামরুল হাসান এসেছেন। আমি তার সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য টেপ রেকর্ডার নিয়ে গেলাম। দক্ষিণ কলকাতার লেকে দেবদুলালের বাড়িতে গিয়ে দেখলাম সেখানে রয়েছেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, অংশুমান রায়, দীনেন্দ্র চৌধুরী আর কামরুল হাসান। কামরুল হাসানের সঙ্গে কথা বলা শেষ করে উঠবো, আমাকে গৌরীপ্রসন্ন বললো- অংশুমান আমার লেখা নিয়ে একটা গান সুর করছে শুনে যাও। আমি আবার রেকর্ডার অন করলাম। হারমোনিয়াম নেই। দেবদুলালের বাড়ির নিচের তলায় একজন থাকতেন তার হারমোনিয়াম আনা হলো। তবলা কই? সেই সমস্যার সমাধান করলেন দীনেন্দ্র। একটি মোটা বাঁধানো বই নিয়ে গানের সাথে তাল দিতে থাকলো। গানটা রেকর্ড করলাম।’
‘আকাশবাণীতে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সঙ্গে গানটা সম্পাদনা করে ১৫ মিনিটের অনুষ্ঠান করলাম। সেদিন সংবাদ বিচিত্রায় আর কোনও প্রতিবেদন দিলাম না। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবার জন্য অফিস থেকে বের হলাম রেডিওতে শুনব বলে। শিয়ালদা স্টেশন থেকে আগরপাড়া। ট্রেন থেকে নেমে শুনি সংবাদ বিচিত্রা শুরু হয়ে গেছে। রাস্তার দুপাশে সব বাড়িতে ফুল ভলিউমে রেডিওতে বাজছে অংশুমানের- শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রণি। আর তারপরই বঙ্গবন্ধুর সেই কণ্ঠ- এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম।’
গানটি সেই সময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বলে মনে করেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম স্থপতি শব্দ সৈনিক বেলাল মুহম্মদ। তিনি বলেন, ‘‘তখন পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রচার করা হতো, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটি পরিচালনা করে ভারতীয়রা। এটা যে ঠিক নয়, তা প্রমাণ করার জন্য কোনও ভারতীয় শিল্পীর গান প্রচার করতাম না। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল অংশুমান রায়ের এই গানটি ও কাজী সব্যসাচীর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার আবৃত্তি। প্রতিদিনই বেশ কয়েকবার আমরা এগুলো প্রচার করতাম।’’
এর কয়েক দিন পর কলকাতার হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি মালিক শোভনলাল সাহা ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেখে অংশুমান রায়কে অনুরোধ করেন গানটি তাদের হয়ে রেকর্ড করার। এরপরই গানটি রেকর্ড করা হয় ২২ এপ্রিল ১৯৭১, যা অংশুমান রায়ের গানের ডায়েরির পাতায় লেখা আছে। রেকর্ডটি আজ আর পাওয়া যায় না। যার একটি মাত্র কপি আছে প্রয়াত অংশুমান রায়ের পুত্র ভাস্কর রায়ের কাছে। যাতে দেখা যাচ্ছে রেকর্ডের একদিকে বাংলায় ও অন্যদিকে গানটি ইংরেজিতে গাওয়া হয়েছে। যার কণ্ঠ দিয়েছিলেন করবী নাথ। আর বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। রেকর্ডটির গায়ে লাল রঙের ওপর কালো রঙ দিয়ে লেখা আছে ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’। সুর ও শিল্পী: অংশুমান রায়, গীতিকার: গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার ও পরিচালনা: দীনেন্দ্র চৌধুরী।
এই প্রতিবেদনে দেওয়া ছবিগুলি প্রয়াত অংশুমান রায়ে পুত্র লোকসংগীতশিল্পী ভাস্কর রায়ের সৌজন্যে পাওয়া
ছবির ক্যাপশন:
(১১৭১) পাঁচির চায়ের দোকান যেখানে ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি লেখা হয়েছিল
(০৭১১০) অংশুমান রায়ের ডাইরির পাতায় সেই কালজয়ী গান
(০৭২) হিন্দুস্থান রেকর্ড ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’
(০০৫২১০) ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি রেকর্ড করছেন অংশুমান রায়
Discussion about this post