বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার করোনাভাইরাসের কারণে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব উত্তরণে চারটি মূল কার্যক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে। যা অবিলম্বে অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট তিন মাসে স্বল্প মেয়াদে, আগামী অর্থবছরে এবং মধ্য মেয়াদে পরবর্তী তিন অর্থবছরে বাস্তবায়ন করা হবে।
বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সোমবার (১৩ এপ্রিল) জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন। তার এ বক্তব্যে তিনি নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানান। একইসঙ্গে যারা করোনা মোকাবিলায় কাজ করছেন, তাদের জন্য প্রণোদনার ঘোষণাও দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাঙালির সর্বজনীন উৎসব বাংলা নববর্ষ। করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে পয়লা বৈশাখে বহিরাঙ্গণের সব অনুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এটা করা হয়েছে বৃহত্তর জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে।’ পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান গণমাধ্যম এবং ডিজিটালি উদযাপন করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ঘরে বসেই এবারের নববর্ষের আনন্দ উপভোগ করবো।’
চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ও বিভিন্ন সংস্থার যেসব সদস্য সামনের কাতারে থেকে করোনাভাইরাস-আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন, ধন্যবাদের পাশপাশি তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার কথা জানান তিনি। তাদের সবার জন্য বিমার ব্যবস্থা করা হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেন সকার প্রধান।
তিনি বলেন, ‘দায়িত্ব পালনকালে যদি কেউ আক্রান্ত হন, তাহলে পদমর্যাদা অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য থাকছে ৫ থেকে ১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্য বিমা এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ৫ গুণ বৃদ্ধি পাবে।’ কেউ যাতে চিকিৎসা বঞ্চিত না হন, সেদিকে লক্ষ্য রাখার জন্য এসব কর্মীর প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইসের কারণে গোটা বিশ্ব আজ অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা আভাস দিচ্ছে। করোনার কারণে বিশ্বের ২৫০ কোটিরও বেশি মানুষ আজ ঘরবন্দি। কোথাও লকডাউন, কোথাও গণছুটি, আবার কোথাও কারফিউ জারি করে মানুষকে ঘরবন্দি করা হয়েছে। বাংলাদেশেও গত ২৫ এ মার্চ থেকে ২৫ এ এপ্রিল পর্যন্ত একটানা ৩২ দিন সাধারণ ছুটি বলবৎ হয়েছে। জরুরি সেবা কার্যক্রম ছাড়া সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আজ দেশের সিংহভাগ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ছোটখাটো কারখানা বন্ধ। গণপরিবহন ও বিমান চলাচল স্থগিত। আমাদের আমদানি-রফতানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বেশিরভাগ দেশে প্রবাসী ভাইবোনেরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। স্থবিরতা নেমে এসেছে রেমিটেন্স প্রবাহে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্ব ব্যবস্থার বাইরে নই। বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা আমাদের অর্থনীতির জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা জানি না, এই সংকট কতদিন থাকবে এবং তা আমাদের অর্থনীতিকে কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। তবুও সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা ইতোমধ্যে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি. যা জিডিপির ৩.৩ শতাংশ।’
সরকার প্রধান জানান, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব উত্তরণে চারটি মূল কার্যক্রম নির্ধারণ করা হয়েছে। যা অবিলম্বে অর্থাৎ চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট তিন মাসে স্বল্প মেয়াদে,আগামী অর্থবছরে এবং মধ্য মেয়াদে পরবর্তী তিন অর্থবছরে— এই তিন পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হবে। চারটি কার্যক্রম হচ্ছে: (১) সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা: সরকরি ব্যয়ের ক্ষেত্রে ‘কর্মসৃজনকেই’ প্রাধান্য দেওয়া হবে। (২) আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ প্রণয়ন: অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা, শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে বহাল রাখা এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখাই হলো আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের মূল উদ্দেশ্য। (৩) সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি: দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণ, দিনমজুর এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা হবে। (৪) মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা: অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব উত্তরণে মুদ্রা সরবরাহ এমনভাবে বৃদ্ধি করা যেন মুদ্রাস্ফীতি না ঘটে।
তিনি জানান, বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমগুলো অব্যাহত রাখার পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় নিম্নোক্ত কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো— (১) স্বল্প আয়ের মানুষদের বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করার জন্য ৫ লাখ মেট্রিক টন চাল এবং ১ লাখ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ করা হয়েছে। (২) শহরাঞ্চলে বসবাসরত নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর জন্য ওএমএস-এর আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে চাউল বিক্রি কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। (৩) দিনমজুর, রিকশা বা ভ্যানচালক, মোটর শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, পত্রিকার হকার, হোটেল শ্রমিকসহ অন্যান্য পেশার মানুষ, যারা দীর্ঘ ছুটি বা আংশিক লক-ডাউনের ফলে কাজ হারিয়েছেন, তাদের এককালীন নগদ অর্থ দেওয়া হবে।
(৪) সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় পরিচালিত ‘বয়স্ক ভাতা’ ও ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের জন্য ভাতা’ কর্মসূচির আওতা সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১০০টি উপজেলায় শতভাগে উন্নীত করা হবে। (৫) জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কেউ গৃহহীন থাকবেন না, তা নিশ্চিত করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শিল্পখাতে যেসব আর্থিক প্যাকেজ গ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোর পুনরায় উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে। একখণ্ড জমিও ফেলে রাখা চলবে না। কৃষি খাতে দেওয়া প্রণোদনাগুলো আবারও জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘করোনাভাইরাসের মহামারি থেকে আমাদের বাঁচতে হবে। আমরা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছি। যখন যে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, তা নেওয়া হচ্ছে। এ মুহূর্তে আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার মজুত রয়েছে।’ তিনি দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘কিছু কিছু স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। এেই সংকটকালে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আপনারা ভয় পাবেন না। ভয় মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে। কেউ আতঙ্ক ছড়াবেন না। সরকার সব সময় আপনার পাশে আছে। আপনারা বিভ্রান্ত হবেন না।’
গণমাধ্যম কর্মীদের দায়িত্বশীলতার সঙ্গে সঠিক তথ্য তুলে ধরে এই মহামারি মোকাবিলায় সহযোগিতার অনুরোধ জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘এ আঁধার কেটে যাবেই। বাঙালি বীরের জাতি, বিজয়ী জাতি। আমরা সস্মিলিতভাবে করোনাভাইরাসজনিত মহামারিকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবো।’
Discussion about this post