এস আলী দূর্জয়
উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজশাহী কলেজ। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ কিংবা এরশাদ বিরোধী আন্দোলন বাঙালির সব গৌরবোজ্জল ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সার্ধশতবর্ষে পদার্পণ করেছে হিরণ্ময় ঐতিহ্যের আধার এই বিদ্যাপীঠ।
প্রমত্তা পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে ১৮৭৩ সালের ১ এপ্রিল রাজশাহী শহরে ‘রাজশাহী কলেজ’ নামে যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির বীজ বপন করা হয়েছিল, তা আজ এক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। মাত্র ছয় ছাত্র নিয়ে পথচলা শুরু করে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর পদচারণে মুখর এই কলেজ।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম কলেজের পরে এটি বাংলাদেশের তৃতীয় প্রাচীনতম কলেজ। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত তদানীন্তন পূর্ব বাংলায় একমাত্র রাজশাহী কলেজেই স্নাতক (সম্মান) পর্যায়ে পাঠদান করা হতো।
এ ছাড়াও, অসংখ্য উজ্জ্বল নক্ষত্র এসেছেন জ্ঞানার্জনে, নিজেকে গড়েছেন, আবার কালের পরিক্রমায় আলো বিলিয়ে চলে গেছেন পরপারে। সেই আলোতে আজও পথ চলে নতুন প্রজন্ম। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ২৮টি সূচকে টানা তিনবার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৪টি সূচকে প্রতিবারই সেরার মুকুট অর্জন করে রাজশাহী কলেজ। মডেল কলেজের স্বীকৃতিও রয়েছে রাজশাহী কলেজের ঝুঁলিতেই।
১৮৮১ সালে স্নাতকোত্তর এবং ১৮৮৩ সালে যোগ হয় বিএল কোর্স চালু হয় কলেজটিতে। স্নাতক কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি মিলে ১৮৭৭ সালের অক্টোবরে। ১৮৮৪ সালে নির্মাণ করা হয় কলেজের প্রথম ভবন (বর্তমান প্রশাসনিক ভবন)। ১৯০২ সালে পুঠিয়ার রানি হেমন্তকুমারী তার নামে একটি হোস্টেল এবং কলেজের অধীনে মহারানি হেমন্তকুমারী সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন।
১৯০৯ সালে মাস্টার্স কোর্স ও বিএল কোর্সের অধিভুক্তি বাতিল করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। কলেজে আইকম, বিকম (পাস) এবং বিকম (সম্মান) কোর্স চালু হয় যথাক্রমে ১৯৫২, ১৯৫৪ এবং ১৯৬১ সালে। এখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে মাস্টার্স ও সম্মান ডিগ্রি প্রদান করছে রাজশাহী কলেজ। চালু রয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক পাঠক্রমও। তবে শিক্ষার্থী নথিভুক্তি বন্ধ হওয়ায় ১৯৯৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত বন্ধ ছিল এ কার্যক্রম।
শিক্ষা কার্যক্রমের বাইরে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনায় রয়েছে পঞ্চাশোর্ধ সহশিক্ষা সংগঠন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- রাজশাহী কলেজ রিপোর্টার্স ইউনিটি (আরসিআরইউ), রোভার স্কাউট, বিএনসিসি, বিতর্ক ক্লাব, রেঞ্জার গাইড, বিজ্ঞান ক্লাব, ক্যারিয়ার ক্লাব, বিজনেস ক্লাব, সংগীত একাডেমি, নৃত্যচর্চা কেন্দ্র, বাঁধন, বরেন্দ্র থিয়েটার, অন্বেষণ, নাট্য সংসদ, আবৃত্তি পরিষদ, ফটোগ্রাফি ক্লাব, রোটার্যাক্ট ক্লাব, এথিক্স ক্লাব, প্রেজেন্টেশান ক্লাব, ক্রিয়েটিভ ক্লাব, ইনোভেশন ক্লাব, রেড ক্রিসেন্টসহ প্রতিটি বিভাগে রয়েছে একটি করে স্বতন্ত্র ক্লাব।
‘সুস্থ দেহ সুস্থ মন’ চিরন্তন সত্যকে সামনে রেখে রাজশাহী কলেজে রয়েছে একটি ব্যায়ামাগার। এখানে শিক্ষার্থীরা তাদের শারীরিক ও মানসিক গঠনে ব্যায়ামসহ নানা অনুশীলন করে থাকেন। নামাজের জন্য রয়েছে দ্বিতল মসজিদ। নগরীর বাইরের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য রয়েছে নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা।
পাঁচশ’র বেশি কম্পিউটার সংবলিত ‘শেখ রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব’ রাজশাহী কলেজেই। ল্যাবে কলেজের সব শিক্ষার্থী বাধ্যতামূলক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ছাড়াও আউটসোর্সিং ও বিভিন্ন প্রোগ্রামিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ ছাড়া, বিভিন্ন বিভাগেও আলাদা ল্যাব রয়েছে।
রাজশাহী কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহা. আব্দুল খালেক বলেন, ১৮৭৩ সালে কলেজিয়েটের মধ্যে প্রতিষ্ঠা হওয়া কলেজটি হাঁটি হাঁটি পা পা করে ১৫০ বছরে পদার্পণ করেছে। দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় উপমহাদেশের অসংখ্য জ্ঞানীগুণী জ্ঞানার্জন করে পুরো বিশ্বে সেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন। সরকারের সুনজর, অভিভাবকদের মানসিকতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরলস পরিশ্রম, রাজনৈতিক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সর্বোচ্চ সহযোগিতায় সফলতার উচ্চ শিখরে পৌঁছেছে কলেজটি।
দক্ষ ও মেধাবী জাতি গঠনে সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়নে চলমান কার্যক্রম অব্যাহত রেখে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নে সোনার বাংলা গড়তে রাজশাহী কলেজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ বলেও মন্তব্য করেন অধ্যক্ষ।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী কলেজ, রাজশাহী।
Discussion about this post