শেখ শাহরিয়ার জামান
ভূ-রাজনৈতিক এবং ভূ-অর্থনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে ইন্দো-প্যাসিফিক পলিসি ডকুমেন্ট তৈরি করছে বাংলাদেশ। পলিসি ডকুমেন্টে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা এবং কোনও সামরিক জোটে যোগ না দেওয়ার বিষয়টি জোরালোভাবে থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়া এই অঞ্চলের দেশগুলোর অন্তর্ভুক্তির প্রতি জোর দিতে চায় ঢাকা।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘আমরা একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ইন্দো-প্যাসিফিক চাই। অন্তর্ভুক্তিমূলক বলতে আমরা বোঝাতে চাইছি, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে কোনও ধরনের দ্বন্দ্ব থাকবে না এবং এখানে যেন কাউকে বাদ না দেওয়া হয়।’
তিনি বলেন, ‘এখানে যদি সামরিক কোনও জোটের বিষয় থাকে, তবে সেটি আমরা পরিহার করবো। তবে অর্থনৈতিক বিষয়গুলোতে আমরা সম্পূর্ণভাবে একমত পোষণ করি।’
ইন্দো-প্যাসিফিক কী
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ভৌগলিকভাবে কত বড় সেটি ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছে একাধিক দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রতি প্রকাশিত ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী, প্রশান্ত মহাসাগরের মার্কিন উপকূল থেকে শুরু করে গোটা ভারত মহাসাগর এর অন্তর্ভুক্ত।
অস্ট্রেলিয়া ২০১৭ সালে প্রকাশিত ফরেন পলিসি হোয়াইট পেপারে বলা হয়েছে, পূর্ব ভারত মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত। আবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল থেকে দক্ষিল প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত। এখানে একটি জিনিস পরিষ্কার ভৌগোলিকভাবে প্রতিটি দেশ বা অঞ্চলের ইন্দো-প্যাসিফিক মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান রযেছে।
তবে, রাজনৈতিকভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন আছে যার মধ্যে চারটি মূল্যবোধভিত্তিক উপাদান আছে। সেগুলো হচ্ছে, প্রতিটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে সম্মান, শান্তিপূর্ণ উপায়ে দ্বন্দ্ব নিরসন, স্বাধীন ও উন্মুক্ত বাণিজ্য এবং আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধা।
এই ভিশন অর্জনের জন্য আলাদা আলাদাভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ কিছু দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি বা কৌশলপত্র প্রণয়ন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে পাঁচটি বৃহৎ উপাদান আছে। আবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কৌশলপত্রে সাতটি বৃহৎ উপাদান আছে।
ইন্দো-প্যাসিফিকে যুক্ত হওয়া যায় না
অনেকের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে ইন্দো-প্যাসিফিকে কবে বাংলাদেশ যোগ দেবে বা এখানে যুক্ত হওয়ার জন্য চুক্তিপত্রে কবে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করবে। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে অবস্থান করছে এবং সে জন্য এখানে যুক্ত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
আবার রাজনৈতিকভাবে ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশনের চারটি উপাদানের প্রতিটি বাংলাদেশ সমর্থন করে। অন্যভাবে ব্যাখ্যা করলে ভিশনেও যুক্ত হওয়া যায় না; বরং ভিশনকে সমর্থন করা বা একমত পোষণ করা যায়।
অন্যদিকে, যে কয়টি দেশ বা জোট ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ঘোষণা করেছে, সেটি তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থ অর্জনের জন্য করেছে। সেখানেও বাংলাদেশের যুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। সে জন্য বাংলাদেশ তার নিজস্ব পলিসি ডকুমেন্ট তৈরি করার উদ্যোগ নিয়েছে।
বাংলাদেশের অবস্থান
২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে লেখা এক চিঠিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লেখ করেছেন যে, ‘সবার জন্য সমৃদ্ধি বয়ে আনবে এমন স্বাধীন, উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশন বিষয়ে বাংলাদেশ একমত পোষণ করে।’
ইন্দো-প্যাসিফিক পলিসি ডকুমেন্ট
যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কয়েকটি দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করেছে। আবার কিছু দেশ ইন্দো-প্যাসিফিক পলিসি ডকুমেন্ট তৈরি করেছে। বাংলাদেশও এ বিষয়ে পলিসি ডকুমেন্ট তৈরি করতে চায়।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এখানকার অনেক দেশ তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক পলিসি ঘোষণা করেছে। আমাদের যে পলিসি তৈরি করা হয়েছে, সেটি অনুমোদনের জন্য দেওয়া হবে। এটি অনুমোদন হয়ে গেলে শিগগিরই সেটি ঘোষণা করা হবে।’
নিরাপত্তা
বাংলাদেশ নিরাপত্তার বিষয়টি শুধু সংকীর্ণ প্রতিরক্ষা বা সামরিক দৃষ্টিকোন থেকে নয়; বরং সামগ্রিক নিরাপত্তা উপাদান যেমন; খাদ্য, পানি, জলবায়ু, জ্বালানি এবং সর্বোপরি মানব নিরাপত্তার দৃষ্টিকোন থেকে দেখে।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘সুনীল অর্থনীতির সম্ভাবনা, কোস্টাল কানেক্টিভিটি, কনটেইনার চলাচলে লজিস্টিক সমস্যাগুলো মসৃনভাবে সমাধান কীভাবে করা যায়, সেগুলো এখানে আমাদের মূল লক্ষ্য থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘শুধু বাণিজ্যিকভাবে চিন্তা করলেও এখানকার পরিবেশ নিরাপদ থাকা দরকার। বাংলাদেশ ছাড়াও অন্যান্য দেশগুলো যাতে করে সুমদ্রে অবাধে চলাচল করতে পারে এবং সার্বিক ইন্দো-প্যাসিফিকের যে লক্ষ্য সেটির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন কোনও কৌশল না থাকাটাই আমাদের কাম্য।’
Discussion about this post